পাঁচ’শ নারী পাচারের সঙ্গে জড়িত শৈলকুপার কে এই বস রাফি?
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১২:০২ এএম, ৪ জুন,শুক্রবার,২০২১ | আপডেট: ০২:২০ পিএম, ২৪ নভেম্বর,রবিবার,২০২৪
ছোট বেলায় তিন ছেলের মধ্যে আশরাফুল ওরফে রাফিকে হাফেজ বানিয়ে দিনের খেতমত করার ইচ্ছা ছিল পিতা আইনুদ্দীন মন্ডলের। কিন্তু সে আশা পুর্ণ হয়নি। মাদ্রাসা পালিয়ে গান, বাজনা, মিউজিক ভিডিও এবং কৌতুক নিয়ে ডুবে থাকতো সে। অভাব অনটনের সংসারে বাড়ি ছেড়ে ঢাকায় কিছুদিন গার্মেন্টেসে কাজ করে আশরাফুল। সেখান থেকে বাড়ি ফিরে বিয়ে করে ঝাউদিয়া কবিরপুর গ্রামে। দারিদ্রতার কারণে প্রথম স্ত্রী তালাক দিয়ে চলে যায়। হুট করে নিখোঁজ হয় আশরাফুল। এক বছরের বেশি সময় তার কোন সন্ধান ছিল না। পরিবারের লোকজন ধরেই নিয়েছিল আশরাফুল হয়তো আর জীবিত নেই। এক বছর পর বাড়িতে ফোন করে জানায় সে ভারতে আছে। বেশ ভালো আছে। পুরানো গাড়ির ব্যবসা করছে। কিন্তু তার নারী পাচারের কথা পরিবারের কেও জানতো না। এ পর্যন্ত ৫০০ নারী পাচার করেছে বস রাফি। এই ঘৃন্য পথই বদলে দেয় রাফির জীবন ও আর্থিক অবস্থা।
টিকটকারদের বস ও নারী পাচারকারী চক্রের হোতা শৈলকুপা উপজেলার নাদপাড়া গ্রামের আশরাফুল ইসলাম রাফি হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান। নারী পাচার করে আশরাফুলের এখন মাঠে ৮/১০ বিঘা জমি। হাতে নগদ টাকা। গ্রামে ফ্লাট বাড়ি। ঘরে এসি ও ওয়াশিং মেশিন। চড়ে বেড়াতো ৩ লাখ টাকার মটরসাইকেলে। সারুটিয়া ইউনিয়নের ৭ নং ওয়ার্ডের সদস্য আশরাফুলের প্রতিবেশি ওয়াজেদ আলী মেম্বর জানান, গ্রামের একেবারেই হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান আশরাফুল মন্ডল ওরফে রাফি। এখনো তার এক ভাই গোলাম মোস্তফা ভ্যান চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছে। আরেক ভাই মাসুদও নিরুদ্দেশ। গ্রামবাসি ধারণা সেও ভারতের বেঙ্গালুরে আস্তানা গেড়েছে। ইউপি মেম্বর ওয়াজেদ আলীর ভাষ্যমতে, রাতারাতি রাফির আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার রহস্য গ্রামের কেও জানতো না। পত্রিকায় খবর পড়ে এখন জানতে পেরেছে রাফি নারী পাচারসহ নানা অপরাধ কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িয়ে আশরাফুল মন্ডল ওরফে রাফি কোটি টাকার সম্পদক গড়ে তুলেছে।
ঈদের আগে বাড়ি এসে রাফি ১০/১৫ বিঘা জমি কেনার জন্য দালাল নিয়োগ করে। জমি কেনার জন্য কথাবার্তাও চলছিল। কিন্তু শৈলকুপা উপজেলা প্রশাসন ভারত থেকে আসার কারণে রাফিকে কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে নিয়ে যায়। গ্রামবাসির ভাষ্যমতে ৫ মাস আগেও রাফি এক ঝাক সুন্দরী মেয়ে গ্রামে নিয়ে এসে মহড়া দেয়। তাদের ভাগ্যে কি ঘটেছে তা কেও জানে না। রাফির বৃদ্ধ পিতা আইনুদ্দীন মন্ডল জানান, ৮ বছর আগে তার ছেলে পাড়ি জমিয়েছিল ভারতের বেঙ্গালুরুতে। তারপর সেখানে কি করতো তা ছিল অজানা। রাফি তার দ্বিতীয় স্ত্রী ও বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে ভারতেও নিয়ে গেছে। র্যাবের কাছে রাফি জানিয়েছে বেঙ্গালুরুতে গিয়েই আয়ত্ত করে নেয় তামিল ভাষা। গাড়ি চালানোর সুবাদে শহরের আনাচে-কানাচে তার চেনা জানা হয়। একসময় কাজ নেয় বেঙ্গালুরের একটি রিসোর্টে। সেখানে থাকাকালীন সময়ে বেঙ্গালুরের অনেক পতিতালয়ের দালালের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। তারপর থেকে সে নিজেও জড়িয়ে পড়ে দালালিতে। একপর্যায়ে বাংলাদেশে তার ঘনিষ্ঠদের সঙ্গে শুরু করে নারী পাচার। মডেলিংয়ে সুযোগ, ভালো চাকরি দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে দেশের নি¤œœ ও মধ্যবিত্ত ঘরের তরুণীদের টার্গেট করে পাচার করতো ভারতে। আবার ভারত থেকে কিছু কিছু তরুণীকে পাচার করতো দুবাইসহ আরো কিছু পর্যটন ভিত্তিক দেশে। এভাবে মাত্র আট বছরেই আন্তর্জাতিক পাচার চক্রে নাম লেখায় বস রাফি। এই সময়ে রাফি প্রায় পাঁচ শতাধিক তরুণীকে পাচার করেছে। রাফি ও তার সহযোগীরা র্যাব’র কাছে গ্রেপ্তারের পর চাঞ্চল্যকর এ সব চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে। র্যাব জানায়, সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের কর্ণাটক রাজ্যের রাজধানী বেঙ্গালুরুতে বাংলাদেশের এক তরুণীকে বিবস্ত্র করে পৈশাচিক কায়দায় নির্যাতনের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনার ভারতের বেঙ্গালুরু পুলিশ রিফাজুল ইসলাম বাবু ওরফে টিকটক হৃদয় বাবু, সাগর, মোহাম্মদ বাবা শেখ, হাকিল ও দুই নারীসহ মোট ৬ জনকে গ্রেপ্তার করে।
এ ঘটনার সূত্র ধরেই আশরাফুল মন্ডল ওরফে বস রাফি ও তার সহযোগী ম্যাডাম সাহিদা (৪৬), মোঃ ইসমাইল সরদার (৩৮) ও মো. আব্দুর রহমান শেখকে (২৬) গ্রেপ্তার করে র্যাব।
র্যাব জানায়, চক্রটি বিভিন্ন প্রতারণামূলক ফাঁদে ফেলে এবং প্রলোভন দেখিয়ে নারী ও তরুণীদের পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার করতো। এই পাচার কাজের সঙ্গে দেশি-বিদেশিসহ প্রায় ৫০ জন এই চক্রের সঙ্গে জড়িত। চক্রের মূলহোতা হচ্ছে বস রাফি। গ্রেপ্তারকৃত অন্যান্য সদস্যরা তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী মাত্র। এই চক্রটি সন্দরীদের প্রলোভন দেখিয়ে উচ্ছৃঙ্খল জীবনে আকৃষ্ট ও অভ্যস্ত করে তুলতোা। পরবর্তীতে তাদেরকে পার্শ্ববর্তী দেশ বা উন্নত দেশের বিভিন্ন মার্কেট, সুপারশপ, বিউটি পার্লারসহ বিভিন্ন ধরণের ভালো বেতনের চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে যৌনবৃত্তিতে নিয়োজিত করার উদ্দেশ্যেই ভারতে পাচার করতো। সেখানে পাচারের পর তাদেরকে বিভিন্ন নেশা জাতীয় ও মাদকদ্রব্য সেবন করিয়ে জোরপূর্বক অশালীন ভিডিও ধারণ করে ব্ল্যাকমেইল করতো যাতে পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য হয়।
র্যাব জানায়, তরুণীদের বৈধ বা অবৈধ উভয় পথেই সীমান্ত অতিক্রম করানো হতো। তারা কয়েকটি ধাপে পাচারের কাজটি করতো। প্রথমত: ভুক্তভোগীদের তারা দেশের বিভিন্ন স্থান হতে সীমান্তবর্তী জেলা যেমন, যশোর, সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহ নিয়ে আসতো। তারপর তাদরেকে সীমান্তবর্তী বিভিন্ন সেফ হাউজে রাখা হতো। সেখান থেকে সুবিধাজনক সময়ে লাইন ম্যানের মাধ্যমে অরক্ষিত এলাকা দিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করাতো। পরে পাশ্ববর্তী দেশের এজেন্টরা তাদেরকে রিসিভ করে সীমান্ত নিকটবর্তী সেফ হাউজে রাখতো। সুবিধাজনক সময়ে কলকাতার সেফ হাউজে পাঠাতো। এ ভাবেই পাচারকৃত তরুনীরা বেঙ্গালুরু তে পৌছে যেত। অন্ধকার জগতের লাল নীল আলোয় তরুনীদের যৌন কাজে বাধ্য করা হতো। এ ভাবেই শৈলকুপার হতদরদ্রি ঘরের যুবক আশরাফুল মন্ডল এক সময় হয়ে ওঠে বস রাফি।