মাহবুব আলী খান: এক ক্ষণজন্মা দেশপ্রেমিকের প্রতিচ্ছবি
আতিকুর রহমান রুমন, বিশেষ প্রতিনিধি, দিনকাল
প্রকাশ: ০৯:৫২ এএম, ৩ নভেম্বর,মঙ্গলবার,২০২০ | আপডেট: ০৭:১২ পিএম, ১৯ নভেম্বর,মঙ্গলবার,২০২৪
আতিকুর রহমান রুমন: সভ্যতার ইতিহাসে এমন কিছু মানুষের সন্ধান পাওয়া যায়; যারা তাদের মহান কীর্তি দিয়ে দেশ ও জাতিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন অনেক দূর। রিয়ার এডমিরাল মাহবুব আলী খান ছিলেন সে রকমই এক সৎ, কর্মীষ্ঠ, দেশপ্রেমিক মহান পুরুষ। যতদিন জীবিত ছিলেন দেশের জন্য নিবেদিতভাবে কাজ করেছেন। নিষ্ঠা, কর্মদক্ষতা, সততা ও মানুষের প্রতি অকুন্ঠ ভালবাসা তাঁর পারিপার্শ্বিক জগৎকে উজ্জ্বল আলোকময় করে তুলেছিল। অমায়িক ব্যবহার, গভীর জ্ঞান ও প্রশ্নাতীত সততায় তাঁর আভিজাত্যই উদ্ভাসিত হতো বার বার।আজ ৩রা নভেম্বর সেই মহান পুরুষের ৮৬তম জন্মদিন। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ সরকারের সাবেক যোগাযোগ উপদেষ্টা, সাবেক কৃষিমন্ত্রী ও সাবেক নৌবাহিনী প্রধান। বর্ণাঢ্য কর্মময়জীবনের অধিকারী এ সৎ ও মহান দেশপ্রেমিকের জন্ম ১৯৩৪ সালের ৩ নভেম্বর সিলেট জেলার বিরাহীমপুরের এক সম্ভ্রান্ত ও বিখ্যাত মুসলিম পরিবারে। তার পিতা ব্যারিস্টার আহমেদ আলী খান প্রথম মুসলিম হিসেবে তৎকালীন ভারতে ১৯০১ সালে ব্যারিস্টার হন। তিনি নিখিল ভারত আইন পরিষদের সদস্য (এমএলএ) ও আসাম কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। যুক্তরাজ্যের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি তিনটি বিষয়ে এমএ ডিগ্রিও নেন। হায়দ্রাবাদ নিজামের প্রধান আইন উপদেষ্টা ছিলেন তিনি।
এম এ খানের মাতা ছিলেন জুবাইদা খাতুন। অবিভক্ত বিহার, আসাম ও উড়িষ্যার জমিদার পরিবারের খান বাহাদুর ওয়াসিউদ্দিন আহমেদএর কন্যা। আহমেদ আলী খানের অপর ভাই গজনফর আলী খান ১৮৯৭ সালে ভারতে চতুর্থ মুসলিম হিসেবে আইসিএস লাভ করেন। গজনফর আলী খানকে তাঁর কর্মদক্ষতার স্বীকৃতি স্বরূপ ব্রিটিশ সরকার ১৯৩০ সালে তাঁকে ‘অফিসার অব দি ব্রিটিশ এম্পায়ার’ এবং সি.আই.ই উপাধিতে ভূষিত করে। এম এ খানের দাদা ছিলেন তৎকালীন ভারতের বিশিষ্ট চিকিৎসক খান বাহাদুর আসসাদার আলী খান। তিনি বিহার ও আসামের দারভাঙ্গা মেডিকেল কলেজের প্রতিষ্ঠাতা এবং পাটনা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। তিনি ১৯২৪ সালে সিলেটের বিরাহীমপুরে নাফিজা বানু চ্যারিটেবল হাসপাতাল ও ১৯৩০ সালে সিলেট মাতৃমঙ্গল নার্সিং ট্রেইনিং সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেন। এম এ খানের পিতার মামা জাস্টিস আমীর আলী কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি ছিলেন। এম এ খানের দাদা খান বাহাদুর আসসাদার আলী ছিলেন স্যার সৈয়দ আমীর আলীর জামাতা। স্যার সৈয়দ আমীর আলী ছিলেন ইংল্যান্ডের রয়্যাল প্রিভি কাউন্সিলের সদস্য এবং ইন্ডিয়ান ভাইসরয়েজ এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের সদস্য। স্যার সৈয়দ আমীর আলীর বিখ্যাত দুটি গ্রন্থ হলো ‘হিস্ট্রি অব সারাসেন’ ও ‘স্পিরিট অব ইসলাম’। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল এমএজি ওসমানী ছিলেন এম এ খানের চাচাতো ভাই। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে এম এ খান ছোট। সবার বড় বোন সাজেদা বেগম। মেজভাই বিশিষ্ট চিকিৎসক ডা. সেকেন্দার আলী খান। মরহুম ডা. সেকেন্দার আলী খানের মেয়ে আইরিন জোবায়দা খান, যিনি মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল এবং আন্তর্জাতিক উন্নয়ন আইন সংস্থার মহাপরিচালক। ২০২০ সালের ১৮ জুলাই জাতিসংঘ কর্তৃপক্ষ সংস্থাটির বাক ও মত প্রকাশ বিষয়ক বিশেষ র?্যাপোটিয়ার হিসেবে আইরিন খানকে নিয়োগ দিয়েছে।
পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, সিলেটের বিরাহীমপুর, কলকাতা ও পুরান ঢাকার ৬৭ পুরানা পল্টন লাইনের বাড়িতে এম এ খানের শৈশব ও কৈশোর অতিবাহিত হয়। তিনি কলকাতা ও ঢাকায় প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। ছোটবেলা থেকেই ছিলেন শান্ত, ধীর ও চিন্তাশীল।
১৯৫৫ সালে সৈয়দা ইকবালমান্দ বানুর সঙ্গে বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের দুই কন্যা শাহিনা খান জামান (বিন্দু) এবং ডা. জুবাইদা রহমান (ঝুনু)। শাহিনা খান জামান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে পড়াশোনা করেন। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত এয়ার কমডোর সৈয়দ শফিউজ্জামান এম এ খানের জ্যেষ্ঠ জামাতা।ছোট কন্যা জুবাইদা রহমান ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে চিকিৎসাশাস্ত্রে ডিগ্রি লাভ করেন এবং ইমপেরিয়াল কলেজ, লন্ডন থেকে ৫৫টি দেশের সকল শিক্ষার্থীদের মধ্যে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে মাস্টার্স অফ কার্ডিওলজি ডিগ্রী অর্জন করেন। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বড় পুত্র এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান তার কনিষ্ঠ জামাতা। তাদের কন্যা ব্যারিস্টার জায়মা রহমান এম এ খানের একমাত্র নাতনি। জায়মা রহমান লন্ডনের কুইন ম্যারি ইউনিভার্সিটি থেকে আইনে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করার পর ‘ইনার টেম্পল’ থেকে বার অ্যাট’ল অর্জন করেন। এম এ খান ১৯৫২ সালে ক্যাডেট হিসেবে পাকিস্তান নৌবাহিনীর নির্বাহী শাখায়যোগ দেন এবং কোয়েটায় সম্মিলিত বাহিনী স্কুল থেকে সম্মিলিত ক্যাডেট হিসেবে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
তিনি উচ্চতর শিক্ষার জন্য যুক্তরাজ্যের ডারমাউথেরয়্যালনেভাল কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশন লাভ করে ব্রিটিশ বিমানবাহিনীর রণতরী ট্রায়ামপতে ১৯৫৪ সালে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। ১৯৫৬ সালের ১মে স্থায়ী কমিশন লাভ করেন। এরপর তিনি রয়্যাল কলেজে এবং গ্রিনউইচসহ ইংল্যান্ডের রয়্যালনেভাল ইনস্টিটিউশনে বিভিন্ন কোর্স সমাপ্ত করেন। ১৯৬৩ সালে কমনওয়েলথ দেশগুলোর মধ্যে শ্রেষ্ঠ কৃতী অফিসার হিসেবে তিনি যুক্তরাজ্যে রানী এলিজাবেথ কর্তৃক পুরস্কৃত হন। এম এ খান ১৯৬৩ সালে যুক্তরাজ্যের এইচএম ভূমি থেকে টর্পেডো ও অ্যান্টি-সাবমেরিন ওয়া ফেয়ার অফিসার হিসেবে উত্তীর্ণ হন। তিনি পাকিস্তানের নেভাল স্টাফ কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশন লাভ করেন।করাচিতে পাকিস্তান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্টে তিনি সিনিয়র ম্যানেজমেন্ট কোর্স সমাপ্ত করেন। এম এ খান ১৯৬০ সালে পিএনএস তুগ্রিলের গানারি অফিসার ছিলেন এবং ১৯৬৪ সালে পিএনএস টিপু সুলতানের টর্পেডো ও অ্যান্টি-সাবমেরিন অফিসার ছিলেন। ১৯৬৭-৬৮ সালে তিনি রাওয়ালপিন্ডিতে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে জয়েন্ট চিফস সেক্রেটারিয়েট স্টাফ অফিসার (ট্রেইনিং এবং মিলিটারিঅ্যাসিস্ট্যান্স) হিসেবে কর্মরত ছিলেন।তিনি ১৯৬৯ সালে পিএনএস মুখতার-এ মাইন সুইপার প্রধানও ছিলেন। তিনি ১৯৭০ সালে পিএনএস হিমালয়ে টর্পেডো ও অ্যান্টি-সাবমেরিন স্কুলের অফিসার-ইন-চার্জ এবং করাচিতে সিওয়ার্ডডিফেন্স অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে থেকেই তাঁর পোস্টিং ছিলো তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে। সেখানে তিনি স্ত্রী ও দুই কন্যাসহ অবস্থান করছিলেন। যুদ্ধের সময় পাকিস্তান সরকার এমনিতেই বাঙালিদের আর বিশ্বাস করছিলোনা, তার উপর এম এ খানের দেশের জন্য অনুভূতি টের পেলে তাঁকে এবং আরো কিছু বাঙালী অফিসারকে সপরিবারে গৃহবন্দি করার পরিকল্পনা করি হয়। এই পরিকল্পনার তথ্য পাবার পর তিনি ১৯৭৩ সালে পাকিস্তানে তাঁর বাসার সকল কার্যক্রম স্বাভাবিক দেখিয়ে সপরিবারে এক পোশাকে পালিয়ে আফগানিস্তান এবং ভারত হয়ে বাংলাদেশে আসেন।
বাংলাদেশে ফেরত আসার পর ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে যোগদানের পর তাকে নেভাল কমডোর পদে দায়িত্ব দেয়া হয় একই বছর অক্টোবরে তিনি চট্টগ্রামে মার্কেন্টাইল একাডেমির প্রথম বাঙালি কমান্ড্যাট নিযুক্ত হন। ১৯৭৪ সালে নৌ-সদর দফতরে পারসোনেল বিভাগের পরিচালক হিসেবে তাকে নিয়োগ করা হয়। ১৯৭৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি নৌবাহিনীর সহকারী স্টাফ প্রধান (অপারেশন ও পারসোনেল) নিযুক্ত হন। ১৯৭৬ সালের ডিসেম্বরে রয়্যাল নেভি কর্তৃক হস্তান্তরিত বাংলাদেশ নৌবাহিনীর প্রথম রণতরী বিএনএস ওমর ফারুক (সাবেক এইচএমএএসল্যান্ডাফ)-এর অধিনায়ক হন। এ রণতরী গ্রহণের পর তিনি তা নিয়ে আলজেরিয়া, যুগোস্লাভিয়া, মিসর, সৌদি আরব এবং শ্রীলঙ্কার বন্দরগুলোতে শুভেচ্ছা সফরের পর দেশে ফিরে আসেন। ১৯৭৯ সালের ৪ নভেম্বর তিনি নৌবাহিনীর স্টাফ প্রধান নিযুক্ত হন এবং ১৯৮০ সালের ১ জানুয়ারি রিয়ার এডমিরাল পদে উন্নীত হন।স্বাধীনতা যুদ্ধের পর বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে বিশ্বমানের আধুনিক ও যুগোপযোগী করতে তিনি নিরলসভাবে কাজ করেছেন। বাংলাদেশ নৌবাহিনীর আইন প্রণয়ন করেছেন তিনি। দেশের সমুদ্রসীমা রক্ষা, সমুদ্রে জেগে ওঠা দ্বীপের দখল রক্ষা, দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপ বাংলাদেশের দখলে রাখা, সমুদ্র এলাকায়জলদস্যু দমন, সুন্দরবন এলাকায় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়ে নৌবাহিনীকে সচেষ্ট করতে তার নেতৃত্ব বিশেষ ভূমিকা চিরস্মরণীয়। তিনি সরকারের সশস্ত্র বাহিনীর বেতন ও পেনশন কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। বাহিনীগুলোর বেতন কাঠামো এই কমিটির দীর্ঘদিনের বিশেষ বিবেচনার ফল। তিনি দেশের প্রশাসনিক পুনর্গঠনে জাতীয় বাস্তবায়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। বাংলাদেশে উপজেলা পদ্ধতির প্রবক্তাও তিনি। ১৯৮২ সালে দেশে সামরিক আইন জারিকালে এডমিরাল এম এ খান উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিযুক্ত হন। এ সময় যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা করা হয় তাকে এবং ১৯৮২ সালের ১০ জুলাই থেকে ১৯৮৪ সালের ১ জুন পর্যন্ত তিনি যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।এ সময় শাহজালাল সেতু, লামাকাজী সেতু ও শেওলা সেতুসহ দেশের অন্যান্য স্থানেও বড় বড় কাজের সূচনা হয়। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের কৃষি মন্ত্রীর দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন।
আতিকুর রহমান রুমন
লেখক : সাংবাদিক-কলাম লেখক
০১৫৩৪-৩১০৩২৯