পাবলিকের মতো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি নিয়োগ দেবে সরকার
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০২:০৮ এএম, ১৫ আগস্ট,রবিবার,২০২১ | আপডেট: ০৬:০১ পিএম, ১৭ সেপ্টেম্বর,মঙ্গলবার,২০২৪
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা প্রশাসনিক ও আর্থিক অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধ করতে মালিকদের একগুচ্ছ ক্ষমতা কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। সে জন্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনা বডি ‘ট্রাস্টি বোর্ডের’ ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ করা হচ্ছে। বাইরে থেকে সিন্ডিকেট সদস্যও বাড়ানো হচ্ছে। এছাড়া ট্রাস্টির পছন্দের লোককে ভিসি বানানোর প্রক্রিয়া পুরোপুরি বন্ধ করতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি নিয়োগ দেবে সরকার। এসব পরিবর্তন এনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০’ পরিবর্তন করতে যাচ্ছে সরকার। খুব শিগগিরই এটি শিক্ষা মন্ত্রণালয় হয়ে মন্ত্রিপরিষদে পাঠানো হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এমন তথ্য জানা গেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ বোর্ড অব ট্রাস্টিজে শিক্ষাবিদদের অন্তর্ভুক্ত করার বিধান আসছে। ট্রাস্টি বোর্ডের পরিধি ৯ জনের পরিবর্তে ১৫ জন করে অন্তত ৫ জন শিক্ষাবিদ রাখার বিধান রেখে বিদ্যমান বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন সংশোধনের সুপারিশ করা হচ্ছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি নিয়োগ দেবে সরকার। অর্থাৎ এখন ট্রাস্টি বোর্ড থেকে ভিসির প্যানেল দেয়ার যে সুপারিশ রয়েছে সেটি রহিত হবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মতোই সরকারই নিয়োগ দেবে ভিসি-প্রোভিসি ও কোষাধ্যক্ষ। সংশোধনী প্রস্তাবে রয়েছে সিন্ডিকেটে ইউজিসি মনোনীত শিক্ষাবিদ সদস্য যুক্ত করা, প্রতি দুই মাসে অন্তত একটি করে সিন্ডিকেট সভার আয়োজন, টিউশন ফি নির্ধারণের তথ্য ইউজিসিকে অবহিতকরণ, যৌন হয়রানি রোধ ইত্যাদি। বোর্ড অব ট্রাস্টিজে (বিওটি) বর্তমানে ন্যূনতম ৯ জন এবং সর্বোচ্চ ২১ সদস্য রাখার বিধান আছে। প্রস্তাবে ন্যূনতম সদস্য ১৫ এবং এক-তৃতীয়াংশ বা ৫ জন শিক্ষাবিদ রাখার কথা বলা হয়েছে। এছাড়া আইনের সংশ্লিষ্ট ধারা সংশোধন করে শিক্ষক নিয়োগ ও অর্থ কমিটিসহ একাডেমিক উন্নয়নে বিভিন্ন কমিটি গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। এসব কমিটির প্রধান থাকবেন ভিসি। ভিসিকে সিন্ডিকেটের কাছে দায়বদ্ধ থাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। অস্থায়ী ক্যাম্পাসের জায়গা ২৫ হাজার বর্গফুটের পরিবর্তে ৩৫ হাজার বর্গফুট করার প্রস্তাবও আছে বলে জানা গেছে।
জানা গেছে, উচ্চশিক্ষার মান নিশ্চিত করতে ২০২০ সালে আগস্ট মাসে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। আইনটি যুগোপযোগী করার উদ্দেশ্যে সংশোধন, সংযোজন ও পরিমার্জনের সুপারিশ করতে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। কমিটিকে এক মাসের মধ্যে আইন সংশোধনের প্রয়োজনীয় সুপারিশ করতে বলা হয়েছিল। কিন্তু গত এক বছরেও কমিটি সুপারিশ প্রতিবেদন দাখিল করতে পারেনি। সে কমিটি সম্প্রতি সভা করে এসব পরিবর্তনের বিষয় চূড়ান্ত করেছে। আইনটি খসড়া চূড়ান্ত করতে আরও দুই-এক দফা সভা হতে পারে। আইন সংশোধনের সুপারিশ প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে জমা দেবে কমিটি। কমিটির আহ্বায়ক বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য বিশ্বজিৎ চন্দ বলেন, ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা আইনে বেশকিছু পরিবর্তনের জন্য আমরা সুপারিশ করতে যাচ্ছি। এ নিয়ে কয়েক দফা বৈঠক হয়েছে। আরও দুই-একটি সভা দরকার হবে। এরপর প্রতিবেদন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া হবে।’
সংশ্লিষ্টরা জানান, আইন সংশোধনের জন্য কমিটির সুপারিশ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জমা দেয়ার পর মন্ত্রীর নেতৃত্বে বৈঠক করে তা চূড়ান্ত করে মন্ত্রিপরিষদে পাঠানো হবে। মন্ত্রিপরিষদে চূড়ান্ত অনুমোদন পেলে তা চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য যাবে জাতীয় সংসদে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন পরিবর্তন করে প্রস্তাবিত সুপারিশ অন্তর্ভুক্ত হলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকারি ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বাড়াবে বলে মনে করেন মালিকদের সংগঠন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি।
সংগঠনের সহ-সভাপতি ও ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের ভিসি অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পুরোপুরি চলে প্রাইভেট অর্থায়নে। এখানে পাবলিক-প্রাইভেটে পার্থক্য। এখন সরকার যদি সবকিছুতে হস্তক্ষেপ করতে আসে তবে তা হবে অপ্রত্যাশিত।
তিনি বলেন, ‘একাডেমিক উন্নয়ন, বৈষম্য নিরসন এবং সমতা প্রতিষ্ঠা যেকোনো প্রস্তাবকে আমরা স্বাগত জানাই। তবে অনিয়মের কথা বলে ইউজিসি বা অন্য কোনো সংস্থার নিয়ন্ত্রণ আরোপের বিধান যুক্ত করা হলে তা হবে অপ্রত্যাশিত। তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আর হাইস্কুলের কোনো পার্থক্য থাকবে না।’
ইউজিসি সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯১ সালে প্রথম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের অনুমতি দেয়া হলেও এগুলো মনিটরিং করার জন্য কোনো আইন ছিল না। ২০১০ সালে প্রথমবারের মতো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন সংসদে পাস হয়। এরপর আইনটি নানা সংশোধনী আনতে বিভিন্ন মহলের দাবি ওঠে। এর প্রেক্ষিতে ২০১৫ সালের শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির উদ্যোগে এই আইন আধুনিকায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়। এ লক্ষ্যে ওই বছর অক্টোবর মাসে ৫ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। এতে সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কয়েকজন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং ইউজিসির প্রতিনিধি সদস্য হিসেবে ছিলেন। ওই কমিটি বহু আগে প্রতিবেদন দাখিল করে। কিন্তু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিওটি সদস্যদের একটি বড় অংশের বিরোধিতার কারণে সংশোধনী ধামাচাপা পড়ে যায়। পরে ২০১৮ সালের ২৭ মে সংসদীয় কমিটির বৈঠকে সংশোধনীর ওপর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় (মালিক) সমিতির প্রতিনিধিদের নিয়ে শুনানি হয়। এতে সমিতির চার সদস্য যোগ দেন এবং প্রত্যেকেই বিভিন্ন ধারার ওপর আনা সংশোধনী প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করেন। এ কারণে কার্যক্রম আর এগোয়নি। সর্বশেষ ৪ আগস্ট এটি নিয়ে বৈঠক করে আইনটির খসড়া প্রায় চূড়ান্ত করেছে।