রোজিনা ইসলামের জামিন শুনানির রায় বিলম্বের ঘটনাকে ‘ওল্ড প্রাকটিস’ - মির্জা ফখরুল
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০২:৫৩ এএম, ২১ মে,শুক্রবার,২০২১ | আপডেট: ০৩:২৯ এএম, ২২ নভেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের জামিন শুনানির রায় বিলম্বের ঘটনাকে ‘ওল্ড প্রাকটিস’ উল্লেখ করে ‘এটাই রাষ্ট্রের বর্তমান চরিত্র’ বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
আজ বৃহস্পতিবার বিকালে এক ভার্চুয়াল আলোচনা সভায় তিনি এই মন্তব্য করেন।
মির্জা ফখরুল বলেন, কোথায় যাবেন? জুডিশিয়ারি! আজকে রোজিনা ইসলামের জামিনের শুনানি হয়েছে। রায় দিবে রবিবার। সেইম ওল্ড প্রাকটিস। এখানে ড. খন্দকার মোশাররফ আছেন, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী সাহেব আছেন, গয়েশ্বর চন্দ্র রায় আছেন, আমাদের সাংবাদিক নেতা শওকত মাহমুদ সাহেব আছেন। আমাদের সঙ্গে যে কি আচরণ করার হয় সেটা তো আমরা ধর্তব্যের মধ্যে নেই না। আমরা রাজনীতিবিদ, আমাদের প্রাপ্য-এটা হবে। কিন্তু দ্যাটস দি রিয়েলিটি। এই জিনিসটা আমাদের বুঝতে হবে এটাই রাষ্ট্রের চরিত্র। এই রাষ্ট্র যারা শাসন করছেন তারা রাষ্ট্রকে একদলীয় শাসন ব্যবস্থার রাষ্ট্র বাকশাল প্রতিষ্ঠার জন্য তারা অতীতেও করেছিলেন, সেই লক্ষ্যে তারা কাজ করছেন।
তিনি বলেন, দুর্ভাগ্য আমাদের যে, আজকে আওয়ামী লীগের মতো একটি দল যারা একসময় জনগণের ভিত্তি ছিলো, তারা জনগণের অধিকারের জন্য আন্দোলন করেছেন তাদের কাছে এখন জনগণ কেউ নয়। তারা জনগণের পাশেও নেই। তাদের এখন কাজী জেবুন্নেসার মতো আমলা অথবা পুলিশ, র্যাব এই ধরনের সম্প্রদায়কে নিয়ে তাদের টিকে থাকতে হচ্ছে। এটা একদিকে যেমন লজ্জার, ধিক্কার, আরেকদিকে তেমনি ভীতিরও। আজকে ফ্যাসিবাদী ভীতি ছড়িয়ে সমস্ত দেশকে একেবারে একটা অন্ধকারের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। সেই ফ্যাসিবাদকে আমাদের পরাজিত করতে হবে- সেটাই একমাত্র মুক্তির পথ। সংগ্রাম-আন্দোলন এবং মুখোমুখি হওয়া-এটা ছাড়া আমাদের আর কোনো বিকল্প পথ নেই। দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার আপোসহীন সংগ্রাম থেকে সকলকে শিক্ষা নিয়ে সামনে এগুনোর কথাও বলেন বিএনপি মহাসচিব।
মির্জা ফখরুল বলেন, রোজিনা ইসলামের ঘটনা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, সামগ্রিক যে বাংলাদেশের আজকে চেহারা, সেই চেহারার একটা অংশ। সি ইজ নট অনলি দ্যা ভিকটিম, এখানে ধারাবাহিকভাবে ইতিপূর্বে এই আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই একের পর এক এই সাংবাদিকদের ওপর নির্যাতন নেমে এসেছে, সংবাদপত্র, গণমাধ্যমের ওপর নির্যাতন নেমে এসেছে, সংবাদপত্র বন্ধ করে দেয়া হয়েছে এবং সাংবাদিকদের দেশ থেকে চলে যেতে বাধ্য করা হয়েছে, হত্যা পর্যন্ত করা হয়েছে। আজকে বাংলাদেশের যে চিত্র সেই চিত্র কিন্তু শুধু সংবাদপত্রের জন্য নয়, বাংলাদেশের মানুষের জন্যে অত্যন্ত ভীতিকর একটা চিত্র। আজকে দেখুন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই তারা কিন্তু একটা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে। সেই লক্ষ্যটি হচ্ছে, দেশে এমন একটা রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা সেই রাষ্ট্র ব্যবস্থায় জনগণের কোনো বক্তব্য থাকবে না, ভিন্নমত ধারণ করবার, পোষণ করবার কোনো উপায় থাকবে না। সরকার তথাকথিত উন্নয়নের নামের লুটপাট, তাদের ডাকাতি চালিয়ে যেতে থাকবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সেজন্য তারা সংবিধানকে কেটে-ছেঁটে তাদের মতো করে নিয়েছে, দুর্নীতির চিত্র যাতে প্রকাশ না পায় সেজন্য গণমাধ্যমের ওপর আঘাত করে চলেছে। আজকে একদিকে যেমন সংবাদপত্রের ওপর আঘাত আসছে অন্যদিকে মানুষের অধিকার নিয়ে যে কাজ করেন তাদের ওপরও আঘাত আসছে চরমভাবে। যারা জনগণের অধিকার নিয়ে কথা বলেছেন, যারা রাজনৈতিক অধিকার নিয়ে কথা বলেছেন তাদেরকে কারারুদ্ধ করা হচ্ছে অথবা তাদেরকে নির্যাতন করা হচ্ছে। দেখুন নারী অধিকার আন্দোলনের নেত্রী অ্যাডভোকেট নিপুণ রায় চৌধুরীকে তার একটা ফেক অডিও তারা (সরকার) এই সংবাদ মাধ্যমের মধ্য দিয়ে ছেড়ে দিয়ে তাকে গ্রেফতার করেছে, তিনবার তাকে রিমান্ডে পাঠিয়েছে। এখন পর্যন্ত তাকে জামিন দেয়া হচ্ছে না। একইভাবে আমাদের ৪/৫শ নেতা-কর্মীকে গত ২৬ মার্চ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকায় আসা নিয়ে যে নারকীয় ঘটনা সরকার ঘটালো তার মাধ্যমে এদেশের আলেম-উলামা, রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদেরকে গ্রেফতার করলো তা এখনো অব্যাহত রেখেছে।
রোজিনা ইসলামের ঘটনার প্রসঙ্গ টেনে বিএনপি মহাসচিব বলেন, যখন আমাদের লোকজনদেরকে ধরে নিয়ে যায়, যখন রিমান্ডে দেয়, যখন মারধর করে, নির্যাতন করে, গুম করে, খুন করে তখন আমরা দেখি যে, দুর্ভাগ্যভাবে অনেক সংবাদ মাধ্যম সেগুলো সম্পর্কে নীরব থাকে। কেউ কেউ আবার আপনার ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াতে সেটাকে ডিফেন্ড করে সরকারের ভূমিকাটা কী। এই জিনিসগুলো কিন্তু ডাবল স্ট্যান্ডার্ড। আজকে কেনো এই অবস্থা? রোজিনা ইসলামের পক্ষে সব সাংবাদিকরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন শুনলাম। আমি মনে করি-এই ঐক্য কতক্ষণ টিকবে? সাগর-রুনির হত্যাকান্ডের পর দুই পক্ষই তারা একসাথে রাস্তায় নেমেছিলেন। ৪/৫ দিনও যায়নি। একজন আপনার উপদেষ্টা হয়ে গেছেন সরকারের, আর কয়েকজন হালুয়া-রুটি দিয়ে তাদেরকে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়। আমার কথাগুলো দুঃখিত আমি স্পষ্ট করে বলছি। তিনি বলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা হালুয়া-রুটির সন্ধানে থাকবো, যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা এই ফেভারের সন্ধানে থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত এই যে, রোজিনা ইসলামের মতো সাহসী সাংবাদিক যারা নিজের জীবন বিপন্ন করে আজকে সত্য কথাগুলো তুলে ধরে তাদেরকে রক্ষা করতে পারবে না এটাই বাস্তবতা। আজকে অলিউল্লাহ নোমান লন্ডনে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন, আজকে মাহমুদুর রহমানকে দেশে ছেড়ে পালিয়ে যেতে হয়েছে, শফিক রেহমানকে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে হয়েছে। যে নির্যাতন তাদের ওপর হয়েছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমি এটাও বলতে শুনেছি যে, মাহমুদুর রহমান কোনো সাংবাদিক নন, সম্পাদক নন, এটাও বলতে শুনেছি শফিক রহমান তো আসলে কোনো সাংবাদিক নন। এই যে ডাবল স্ট্যান্ডার্ড এটা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের অনুসন্ধানী ও সাহসী সাংবাদিকতার জন্য তাকে সাধুবাদ জানান মির্জা ফখরুল। আমি তাকে বাহবা জানাই। একই সঙ্গে তাকে শ্রদ্ধা করি তিনি অত্যন্ত ঝুঁকি নিয়ে সত্য প্রচার করেছেন এবং তার ওপর যে নির্যাতন হয়েছে, এই নির্যাতনের মধ্যেও তিনি নতি স্বীকার করেননি। তিনি বলেছেন যে, আমার প্রতি অন্যায় হয়েছে। বিএনপির উদ্যোগে ‘অবরুদ্ধ গণতন্ত্র, শৃঙ্খলিত গণমাধ্যম, মুক্তির পথ কী?’ শীর্ষক এই আলোচনা সভা হয়।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, আজকে গণমাধ্যম বন্দি যে বন্দি তার ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র একটি প্রমাণ সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের ওপর নির্যাতন, হেনেস্তা ও অপমানের ঘটনা, সর্বশেষে তাকে গ্রেফতার হতে হয়েছে। আমি মনে করি বাংলাদেশে যে সরকার রয়েছে, এই সরকার ফ্যাসিবাদী সরকার। তাদের বাকশালী শাসন প্রতিষ্ঠার ফ্যাসিবাদী চরিত্রের ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র প্রতিফলন হচ্ছে রোজিনার ওপর ঘটনা। আজকে গণমাধ্যম শৃঙ্খলিত, গণতন্ত্র বন্দি। এই সরকার মুক্তিযুদ্ধের সব অর্জনকে ধ্বংস করে দিয়ে ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার করে দেশটাকে ধ্বংসের কিনারায় নিয়ে গেছে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটনাতে হলে দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে হবে, জনগণের শাসন ফিরিয়ে আনতে হবে।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি শওকত মাহমুদ বলেন, আজ রক্তবীজের ছাপ কিন্তু সর্বত্র ছড়িয়ে গেছে। এই জেবুন্নেসাকে যেরকম দেখেছেন, এই জেবুন্নেসা হচ্ছে আমাদের সামনে এই চরিত্র যে, আমলাতন্ত্রে জেবুন্নেসায় ভরে গেছে। যারা মনে করে যে, শেখ হাসিনা বিদায় হলেও, শেখ হাসিনার চাইতেও বড় বিপদ হবে তাদের (আমলা), তারা কিন্তু রক্তবীজের ঝাড়রাই কিন্তু এই স্বৈরাচারকে টিকিয়ে রাখার জন্য আজকে কাজ করছে। আমরা আজকে ভেবে-চিন্তে ঐক্য গড়ে আমি মনে করি যে, ঈমানী আন্দোলনে মাঠে নামতে হবে আপোসহীনভাবে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সভাপতিত্বে ও প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানির পরিচালনায় আলোচনা সভায় আরো বক্তব্য রাখেন বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, মানবাধিকার সম্পাদক অ্যাডভোকেট আসাদুজ্জামান প্রমুখ। সাংবাদিকদের মধ্যে জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি কামাল উদ্দিন সবুজ, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি আবদুল হাই শিকদার, বর্তমান সভাপতি কাদের গনি চৌধুরী, জাতীয় প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস খান ও মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট এলিনা খান এই ভার্চুয়াল আলোচনায় অংশ নেন।