সরকার ‘মেগা প্রকল্প’ নামে দেশটাকে ‘ফোকলা’ করে দিচ্ছে - মির্জা ফখরুল
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০২:১৫ এএম, ১৫ মার্চ,সোমবার,২০২১ | আপডেট: ০৭:১৭ এএম, ২০ সেপ্টেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
সরকার ‘মেগা প্রকল্প’ নামে দেশটাকে ‘ফোকলা’ করে দিচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এলাকায় বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের একটি গার্ডার ধসে দুর্ঘটনার প্রসঙ্গ টেনে আজ রবিবার এক প্রকাশনা অনুষ্ঠানে তিনি এই অভিযোগ করেন। জাতীয় প্রেসক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী হলে জাতীয়তাবাদী প্রকাশনা সংস্থার উদ্যোগে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের লেখা ‘কুপির বাতির গণতন্ত্র’ গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন উপলক্ষে এই অনুষ্ঠান হয়। জাতীয়তাবাদী প্রকাশনা সংস্থা এই গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে। পৃষ্ঠার বইটির মূল্য রাখা হয়েছে তিন শ ষাট টাকা। গ্রন্থের প্রচ্ছদ এঁকেছেন ফারজানা আহমেদ।
মির্জা ফখরুল বলেন, একটা ঘটনা ঘটেছে আজকেই আপনারা দেখেছেন, এয়ারপোর্টের সামনে এলিভেটেড এক্সপ্রেসের গার্ডার ভেঙে পড়েছে এবং ৪ জন ইনজুয়েন্ড হয়েছে দু জন চীনাসহ। চিন্তা করেন এই জনগণের টাকা নিয়ে যেসব তৈরি করা হচ্ছে সেটা হঠাৎ করে ভেঙে পড়ছে। তাহলে এসব প্রকল্পের মান কি হচ্ছে? আমরা বারবার বলছি যে, এই মেগা প্রজেক্ট দিয়ে উন্নয়নের ধোঁয়া তুলে আপনি দেশটাকে একেবারে ফোকলা করে দিচ্ছেন।
তিনি বলেন, গতকাল না পরশু একটা খবর আছে- ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম ফাস্টেড ট্রেন হবে। দুটি চীনা কোম্পানি তারা টাকা দেবে অর্থাৎ সাপ্লাইয়ার্স ক্রেডিট যেটা বলা হয় এবং সেটা দিয়ে তৈরি হবে। আর আমাদের পকেট থেকে প্রতিটি মুহূর্তে চাল কিনতে যাবেন, লবণ কিনতে যাবেন ভ্যাট দিয়ে দিয়ে সব কেটে নিয়ে যাওয়া হবে। গোটা বাংলাদেশের উন্নয়ন কিন্তু তাই হচ্ছে এখন। এই উন্নয়ন মানে হচ্ছে যে, মানুষের পকেট কেটে তারা তাদের পকেট ভারী করছে। এসব কমিশন এজেন্সি, এসব টাকা-কন্ট্রাক্ট সবকিছু তাদের।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, পৃথিবীর বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এবং মানব সভ্যতার বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতিকে এমন একটা জায়গায় নিয়ে আসা হয়েছে, যেখানে এখানে ডার্টি বললে খুব একটা খারাপ কিছু বলা হয় না। আপনারা দেখুন, চারদিকে তাকিয়ে- কয়েকদিন আগে সিএনএনের একটা রিপোর্টের বেরুলো যে, ভারতে যারা নির্বাচন করছেন তাদের মধ্যে ৪০ শতাংশ ক্রাইমের সঙ্গে জড়িত এবং দেয়ার রেজিস্টার্ডস এ ক্রিমিনালস। যারা আইন ভঙ্গ করেন তারা আইন তৈরি করার জন্য নির্বাচন করছেন। তারা পার্লামেন্টে যাবেন। একই অবস্থা দেখেছেন কয়েকদিন আগে আমেরিকাতে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আমেরিকার জনগণ তাকে ভোট দিয়ে নির্বাচন করেছে। তিনি নির্দেশ দিয়ে তার পার্লামেন্টকে তিনি আক্রমণ করেন এবং সেখানে আইন যারা তৈরি করেন তারা জীবনের ভয়ে সেইভ হাউজে গিয়ে আশ্রয় নিলেন। আমরা এই বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি করে দেখছি, আমরা রাজনীতিকে কোথায়, কিভাবে একেবারে অন্ধকার ঘরে নিয়ে চলে গেছে। যেখানে কুপি বাতি দিয়েও খুঁজে পাওয়া যাবে না। একটা নোংরা, একটা নর্দমাতে নিয়ে গিয়ে উপস্থিত করেছে। এই অন্ধকারের মধ্যে অন্তত কুপি বাতির আলোটা জ্বালিয়ে যিনি নিজেকে আমাদের সামনে আরো বেশি, আরো বেশি করে মহান করে তুললেন সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল। তার এই বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে আসতে পেরে আমি নিজে ধন্য হয়েছি। কারণ আমাদের একজন রাজনীতিবিদ আজকে লিখছেন না কেউ, তিনি বই লিখছেন।
মির্জা ফখরুল বলেন, দুর্ভাগ্যের কথা যে, আজকে যে সমাজে আমরা বাস করছি, যে রাষ্ট্রে বাস করছি, এখানে সুস্থ, সুন্দর, সত্য- এগুলো প্রায় বিরল প্রজাতির মতো হয়ে গেছে। সেখানে আলালের সেই লেখা নিঃসেন্দেহে আমাদের কিছুটা আলো দেখায়। আমি সব সময় খুব আশাবাদী লোক। উই উইল ওভার কাম। এই অন্ধকার কেটে যাবে এবং নিঃসন্দেহে আমরা আলো দেখতে পারবো। কুপি বাতির বরাতে গণতন্ত্রকে আলোতে নিয়ে আসতে হবে। আলালের বই থেকে আপনারা সেই জায়গাগুলো বের করে নেবেন সেখানে আমরা ভবিষ্যতে আলো দেখতে পাবো, ভবিষ্যতে আমরা বিশ্বকে সুন্দর দেখতে পাবো, সত্যকে দেখতে পাবো এবং আমরা গণতন্ত্রের আসল চেহারা দেখতে পাবো।
গ্রন্থটি লেখার কারণ ব্যাখ্যা করে লেখক সাবেক সংসদ সদস্য সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, কুপি বাতি কেনো? কুপি বাতি হচ্ছে এই কারণে যে, সেই কুপি বাতি আমলের কথা স্মরণ করা। যখন বিদ্যুৎবিহীন সমাজ ব্যবস্থা ছিল কিন্তু বিদ্যুতের আলোতে আলোকিত মানুষরা ছিলেন যাদের অন্তর্জগৎ ছিল বিদ্যুতের আলোকে আলোকিত। সেই মানুষের সংখ্যা আজ দিন দিন কমে যাচ্ছে, সেই মানুষের সংখ্যা অনেক কমে গেছে। যারা আছে তারা চুপচাপ আছেন, নিশ্চুপ আছেন। এই কারণে আমাদের ডিজিটাল সিস্টেমের অনেক কিছু আমাদের ভালো লাগে না, আমরা এনালগে ফিরে যেতে চাই। যে এনালগে আমরা জীবনের প্রতিচ্ছবি খুঁজে পাই, জীবনের দর্পণ খুঁজে পাই। সেই দিনগুলোতে ফিরে যাওয়ার যে তাগিদ সেই তাগিদ থেকে আমার মধ্যে একটা চেতনা কাজ করেছে- যে এলইডির আলোকে যত আলোকিত হোক, আজকে উন্নয়ন যে পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছাক কুপি বাতির সেই অবস্থা গণতন্ত্র সেই পর্যায়ে রয়ে গেছে।
তিনি বলেন, যদি গণতন্ত্র সেই পর্যায়ে নাই থাকে, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের যে নির্বাচন যেখানে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থীদের ভোট দিয়েছিল তখন তো এই অঞ্চলে কোনো নির্বাচন কমিশন ছিল না। পূর্ব পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্র বিভাগের তত্ত্বাবধানে সেই নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তারপরেও যুক্তফ্রন্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল। কোনো নির্বাচন কমিশনের প্রয়োজনই ছিল না দেখা গেছে। নির্বাচন নিয়ে কোনো বিতর্ক ওঠেনি। ১৯৭০ সালে আইয়ুব খান-ইয়াহিয়া খানের আমলে নির্বাচন হয়েছে, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ে নৌকার পক্ষে ভোট দিয়েছে, সেদিনও তো নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন ওঠেনি। আজকে ৫০ বছর পরে নির্বাচন নিয়ে ধ্বংসস্তূপ আমরা দেখতে পারছি। নির্বাচন কমিশন এখন নাম পরিবর্তন করে ‘নির্বাসন কমিশন’ হয়েছে। যেখান থেকে গণতন্ত্রকে নির্বাসন করা হয়। তাহলে কুপি বাতি বলব না কী বলব? এই চেতনার জন্য কি মুক্তিযোদ্ধারা লড়াই করেছেন, মঞ্চে বসে থাকা তারা রক্ত দিয়েছেন, অনেকে জীবন দিয়েছেন, অনেক পরিবারে সেই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণ করে মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত তারা চোখের অশ্রু ফেলেন। ২০০৮ সালের ২৪ এপ্রিল রংপুর কারাগারে থেকে জামিনে মুক্তির পর জেল গেট থেকে পুনরায় গ্রেফতারের সংবাদ শুনে মারা যান আলালের মা উম্মে কুলসুম। কারাগারে বন্দি অবস্থায় মায়ের মৃত্যু সংবাদ তিন দিন পরে কারা কর্তৃপক্ষ থেকে জানার সংবাদ শুনে নিজের মর্মবেদনার কথা বলতে বলতে গিয়ে অশ্রুসজল হয়ে পড়েন এই আলাল। আমি কারাগারে ছিলাম। আমার মা মারা গেছেন, আমাকে তিন দিন পরে জানানো হয়েছে। আমি আমার মায়ের লাশটাও দেখতে পারি নাই। এদেশের রাজনীতি করার অপরাধটা কি এই। বর্তমান সরকারের আমলে আলালের বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা ২১৩টা। এই গ্রন্থটি আলাল তার মরহুম মা উম্মে কুলসুম, মরহুম পিতা সৈয়দ আলতাফ হোসেন এবং শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীরউত্তমের স্মরণে উৎসর্গ করেন।
বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের সভাপতিত্বে ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ফজলুল হক সৈকতের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবিএম ওবায়দুল ইসলাম, সাবেক অধ্যাপক মোর্শেদ হাসান খান ও জাতীয় প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস খান, গ্রন্থের প্রকাশক মো. জহির দীপ্তি বক্তব্য রাখেন।
অনুষ্ঠানে বিএনপির প্রশিক্ষণবিষয়ক সম্পাদক এবিএম মোশাররফ হোসেন, স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক ডা. রফিকুল ইসলাম, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্র্য ইসলাম অমিত, নির্বাহী কমিটির সদস্য আবু নাসের মুহাম্মদ রহমাতুল্লাহ, মহিলা দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদিকা হেলেন জেরিন খান, ওলামা দলের আহবায়ক শাহ নেসারুল হক, কৃষক দল নেতা মাইনুল ইসলামসহ বিএনপি ও তার অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।