খালেদা জিয়ার সুচিকিৎসায় আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের দাবি বিএনপির
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৩:১৩ এএম, ২৩ ফেব্রুয়ারী,মঙ্গলবার,২০২১ | আপডেট: ০৯:০০ পিএম, ২১ সেপ্টেম্বর,শনিবার,২০২৪
বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী অসুস্থ বেগম খালেদা জিয়ার বিদেশে সুচিকিৎসায় সরকারের আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে বিএনপি।
আজ সোমবার দুপুরে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান এই দাবি জানান।
তিনি বলেন, আমরা যতটুকু জানি তিনি (বেগম খালেদা জিয়া) দারুণভাবে অসুস্থ। তাঁর সুচিকিৎসা প্রয়োজন যে চিকিৎসা এখানে সম্ভব নয়। এমন কি যে হাসপাতালে তিনি ছিলেন সেখানেও সম্ভব হয় নাই। প্রয়োজনে সুচিকিৎসার জন্য তাঁর বাইরে যাওয়া হয়ত দরকার হবে। এই ব্যাপারে সরকারেরে একটা নিষেধাজ্ঞা আছে আপনারা জানেন। আমরা দাবি জানাব, এই ব্যাপারে যে নিষেধাজ্ঞা সেটা প্রত্যাহার করা হোক এবং দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার এই মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা হোক যেন তিনি তাঁর চিকিৎসার প্রয়োজনে যখন যেখানে যেতে চান তিনি যেতে পারেন।
গত বছরের ২৫ মার্চ থেকে সরকার নির্বাহী আদেশে বেগম খালেদা জিয়ার সাজা ছয় মাস স্থগিত করে তাঁকে মুক্তি দেয়ার পর থেকে তিনি গুলশানে নিজের বাসা ‘ফিরোজায়’ আছেন। প্রথম দফার পর পরিবারের আবেদনের আরো ৬ মাস সাজা মওকুফ করা হয় যার মেয়াদ আগামী ২৪ মার্চ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। গুলশানের বাসায় বেগম খালেদা জিয়ার ভাই-বোন ও তাদের পরিবারের সদস্যরা ছাড়া অন্য কেউই দেখা করতে পারেন না। দলের পক্ষ থেকে বেগম খালেদা জিয়া ‘গৃহবন্দি’ বলে অভিযোগ করা হচ্ছে।
সরকারের আরোপিত নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কে নজরুল ইসলাম খান বলেন, যদিও এই নিষেধাজ্ঞাটা অমানবিক ও অযৌক্তিক। কারণ এদেশের ইতিহাস বলে যে, অসুস্থতার কারণে রাজনৈতিক নেতাদের বাইরে যাওয়ার বহু দৃষ্টান্ত আছে। এমনকি জেলে থাকা অবস্থাও বাইরে যাওয়ার দৃষ্টান্ত আছে। কিন্তু দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার এ ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রাখা হয়েছে।
আমরা মনে করি, এই অযৈাক্তিক ও অমানবিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা দরকার। দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া তিন বারের প্রধানমন্ত্রী, বার বার বিরোধী দলীয় নেত্রী, দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় মানুষ। তিনি নিজেই সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন তাঁর শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে যে, কখন কোথায় চিকিৎসার জন্য যেতে চান। এবং যেটাই প্রয়োজন হবে সেটা যাতে বিঘ্নিত না হয় সরকারের উচিত সেটা নিশ্চিত করা।
সরকারের নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়ে বিএনপির অবস্থান জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিচ্ছি না। এটা রাজনৈতিক বিষয় না, এটা তাঁর চিকিৎসার বিষয়। বেগম খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিতাদেশের দ্বিতীয় দফা মেয়াদও শেষ প্রান্তে এ পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপির চাওয়া কি জানতে চাইলে নজরুল ইসলাম খান বলেন, এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক ব্যাপার আর কি। আমরা তো বরাবর, বারবার আমরা বলেছি- আমরা তাঁর নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করি। কারণ আমরা বিশ্বাস করি তাঁকে সাজাই দেয়া হয়েছে অন্যায়ভাবে, বিনা অপরাধে।
আপনি যেটা বললেন যে, যারা অপরাধে দন্ডপ্রাপ্ত হয়েছে এবং বেগম খালেদা জিয়ার চেয়েও বেশি দন্ডপ্রাপ্ত তাদেরকেও মুক্তি দেয়া হয়েছে। কেনো দেয়া হয়েছে সেটা আপনারাও জানেন। কারণ এটা বেগম খালেদা জিয়ার জন্য প্রযোজ্য না। তিনি সরকারের আপনজন না, প্রতিপক্ষ। যদি সরকার তাঁর প্রতি যে আচরণ করছে যেটা প্রতিপক্ষের না, শত্রুর আচরণ।
তিনি বলেন, আমরা মনে করি, সরকার সকলের সরকার হওয়া উচিত। যেটা প্রমাণ করার জন্য হলেও অবিলম্বে তাঁকে নিশঃর্ত মুক্তি দেয়া এবং তিনি যাতে স্বাধীনভাবে জীবন-যাপন করতে পারেন, সুচিকিৎসা নিতে পারেন এবং নাগরিক হিসেবে তাঁর যে অধিকার সেই অধিকার প্রয়োগ করতে পারেন।
বেগম খালেদা জিয়া বর্তমানে কেমন আছেন জানতে চাইলে নজরুল ইসলাম খান বলেন, এই ব্যাপারে তাঁর যারা চিকিৎসক টিম এবং তাঁর আত্মীয়স্বজনদের বক্তব্য আপনারা বিভিন্ন সময়ে জানছেন এবং প্রকাশও করছেন। এর বাইরে তো বলার কিছু নাই। কারণ আমরা তো তাঁর সাথে দেখাই করতে পারি না। আমরা আপনাদের মতো যতটুকু জানি তিনি দারুণভাবে অসুস্থ। তাঁর সুচিকিৎসা প্রয়োজন।
বেগম খালেদা জিয়ার সুচিকিৎসার ব্যত্যয় হলে বোঝা যাবে সরকার তাঁর সুচিকিৎসা চান না বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, একজন অসুস্থ মানুষ সুচিকিৎসা না পেলে যেটা হতে পারে সেটা সরকারের বিবেচনায় নেয়া দরকার। জনগণ সেটা বোঝে।
গত ২০ ফেব্রুয়ারি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সভাপতিত্বে স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল বৈঠকের সিদ্ধান্তসমূহ তুলে ধরতে গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এই সংবাদ সম্মেলন হয়। ভার্চুয়াল এই বৈঠকে সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশারররফ হোসেন, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সেলিমা রহমান ও ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু যুক্ত ছিলেন।
জাতীয় স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল সভায় বিস্তারিত আলোচনা শেষে সর্বসম্মতিক্রমে যেসব প্রস্তাব ও সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে, তার অন্যতম হলো-
ক) সম্প্রতি নড়াইলের এক আদালতে দারুণ অসুস্থ অবস্থায় নিজ গৃহে কারারুদ্ধ সাবেক প্রধানমন্ত্রী, বিএনপি চেয়ারপারসন ও গণতন্ত্রের মাতা দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির মত অমানবিক ও অস্বাভাবিক ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে সভায় বলা হয় যে, তিনি যখন চিকিৎসার জন্যও ঘরের বাইরে যেতে অক্ষম তখন গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে সুদুর নড়াইলে আদালতে হাজির হওয়ার নিষ্ঠুর আদেশ জারির সংবাদে সঙ্গতভাবেই দেশবাসী বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ। সভা অনতিবিলম্বে হয়রানিমূলক ও অমানবিক এই গ্রেফতারি পরোয়ানা প্রত্যাহারের জোর দাবি জানায়। একই সাথে সভা ঐ হাস্যকর হয়রানিমূলক মামলায় দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য বাবু গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের বিরুদ্ধেও গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়ে অবিলম্বে তা প্রত্যাহারের দাবি জানায়।
খ) সভায় রাষ্ট্রের সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে দলীয়করণের মাধ্যমে কুক্ষিগত ও কলুষিতকারী ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা উপ-কমিটিতে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা এটর্নি জেনারেলকে সদস্য নিয়োগ করায় বিস্ময় ও ক্ষোভ প্রকাশ করে বলা হয় যে, একটি সাংবিধানিক পদের অধিকারীকে দলীয় পদে নিযুক্ত করা দেশের ইতিহাসে একটি নতুন ঘটনা এবং নিঃসন্দেহক্রমে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তার কার্যালয়কে নগ্ন দলীয়করণের অপচেষ্টা ও একটি অত্যন্ত মন্দ দৃষ্টান্ত।
রাজনৈতিক বিবেচনায় কোনো কোনো সাংবিধানিক পদে দলীয় সমর্থক কাউকে নিয়োগ করার দৃষ্টান্ত থাকলেও কোনো সাংবিধানিক পদাধিকারীকে দলীয় পদে নিযুক্ত করার ঘটনা ১৯৭৫-এর বাকশালের কমিটি গঠনের পর আর ঘটেনি। জনগণের অর্থে যাদের বেতন-ভাতা পরিশোধিত হয় তাদের কারো বিশেষ কোনো রাজনৈতিক দলের শক্তি ও সামর্থ্য বৃদ্ধির জন্য ব্যবহৃত হওয়া বা করা শুধু অন্যায় নয় অনৈতিকও বটে। বিএনপি দৃঢ়ভাবে মনে করে যে, দেশের বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি ও রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তার পদের নিরপেক্ষতা যাতে প্রশ্নবিদ্ধ না হয় তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এটর্নি জেনারেলের উচিত হয় দলীয় পদ কিম্বা এটর্নি জেনারেলের পদ থেকে পদত্যাগ করা। যারা তাকে নিয়োগ দিয়েছে তাদেরও উচিত অনৈতিক এই বিষয়টির গুরুত্ব ও জনমনে এর অনিবার্য বিরূপ প্রতিক্রিয়া বিবেচনা করে দলের উপ-কমিটি থেকে অবিলম্বে এটর্নি জেনারেলকে বাদ দেয়া।
গ) সভায় গত ১৮ ফেব্রুয়ারি বরিশাল মহানগরে অনুষ্ঠিত জনসভায় যোগদানের জন্য ঢাকা মহানগর দক্ষিণের জনতার মেয়র ইঞ্জি: ইশরাক হোসেনের গাড়ি বহরকে মাওয়া ঘাটে অন্যায়ভাবে আটকে দেয়া, লঞ্চে পার হয়ে বরিশাল যাওয়ার পথে বাধা দেয়া, বরিশালে জনসভায় যোগদানকারী বিভিন্ন জেলা-অঞ্চল থেকে আগতদের নানা স্থানে অন্যায়ভাবে বাধা দেয়ার ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগে সরকার ও সরকারি দলের সংশ্লিষ্টদের অগণতান্ত্রিক সন্ত্রাসী কার্যক্রমের তদন্ত ও বিচার করার এবং এসব অগণতান্ত্রিক কার্যক্রম থেকে ভবিষ্যতে বিরত থাকার জোর দাবি জানানো হয়।
ঘ) সভায় সম্প্রতি জনস্বার্থে দায়িত্ব পালনরত সিলেট মহানগরের নির্বাচিত মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী ও তার সহকর্মীদের ওপর প্রকাশ্য দিবালোকে সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের হামলা, শটগান ব্যবহার এবং বেআইনি কার্যকলাপের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে অবিলম্বে অপরাধীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার জোর দাবি জানানো হয়।