ক্ষমতার অপব্যবহারে আ.লীগের মন্ত্রী, এমপি, আয়া-বুয়ারা বাগিয়েছেন ১২৭ প্লট
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৮:৪২ পিএম, ১৮ সেপ্টেম্বর,
বুধবার,২০২৪ | আপডেট: ০২:০০ এএম, ২৩ নভেম্বর,শনিবার,২০২৪
স্বৈরাচার সরকার শেখ হাসিনার বেয়ারা, আপ্যায়নকারী, রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের অফিস সহায়ক ও প্যান্ট্রিম্যান রাজউকের প্লট পেয়েছেন। জানা গেছে, এক বোর্ড সভায় একসঙ্গে ১২৭ জনকে ৩ থেকে সাড়ে সাত কাঠার রাজউকের প্লট দেয়া হয়েছে। এই তালিকায় আছেন আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও সংরক্ষিত মহিলা সংসদ সদস্য। তালিকায় জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্যও আছেন। আরও আছেন বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) চেয়ারম্যান, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলী ও বাংলা একাডেমির মহাপরিচালককেও প্লট দেয়া হয়েছে। চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদফতরের (ডিএফপি) ক্যামেরাম্যান ও তথ্য অধিদফতরের ক্যামেরাম্যানও পেয়েছেন প্লট। কিন্তু কোনো মাপকাঠিতে তারা প্লট পেলেন তার ব্যাখ্যা নেই রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কাছে।
তিন কাঠার প্লট বরাদ্দ দেয়া হলেও প্রভাব খাটিয়ে প্লটের আকার পরিবর্তন করে তাদের মধ্যে অনেকেই ৫ কাঠা, সাড়ে সাত কাঠা করে নিয়েছেন। পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে ১৩/এ ধারায় এসব প্লট বরাদ্দ দেয় রাজউক। ২০১৮ সালে রাজউক চেয়ারম্যানের নির্দেশনায় প্লট আইডি নম্বর বরাদ্দ দেয়া হয়। ওই সময় সংস্থাটির চেয়ারম্যান ছিলেন আবদুর রহমান।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সংরক্ষিত এই ধারাটির চরমভাবে অপব্যবহার করা হয়েছে। এতে উল্লেখ করা হয়, চেয়ারম্যানের নির্দেশক্রমে নথি উপস্থাপন করা হলো। কর্তৃপক্ষের ০৫/২০১৮তম, ০৭/২০১৮তম, ০৯/২০১৮তম ও ১১/২০১৮তম সাধারণ সভার সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে প্রাথমিক নির্বাচিতপত্র জারি করা হয়। পরবর্তী পর্যায়ে প্রাথমিক নির্বাচিতপত্র প্রাপ্ত বরাদ্দ গ্রহীতাদের বরাবর সাময়িক বরাদ্দপত্র জারি করা হয়। সাময়িক বরাদ্দপত্রের আলোকে প্রথম কিস্তির অর্থ পরিশোধ, হলফনামা ও অন্যান্য কাগজপত্রাদি দাখিল করেন তারা। প্লট আইডি নম্বর বরাদ্দ প্রদানের জন্য চেয়ারম্যান নির্দেশনা প্রদান করেন। চেয়ারম্যানের নির্দেশনায় প্রস্তুত করা প্লটের আইডি নম্বর দেয়া হয়।
তিন কাঠার প্লট পেয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বেয়ারা আবু জেহাদ আল মামুন, প্যান্ট্রিম্যান মো. হজরত আলী, সংযুক্ত কমার্শিয়াল অফিসার মো. হেমায়েত কবির ও আবদুল আউয়াল, সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের অফিস সহায়ক আবদুল মান্নান শেখ, প্যান্ট্রিম্যান মো. ইউনুস আলী। প্লট পেয়েছেন ডিএফপির ক্যামেরাম্যান মো. ইউসুফ হোসেন, তথ্য অধিদফতরের ফটোগ্রাফার এ বি এম আকতারুজ্জামান। তিন কাঠার প্লট পেয়েছেন বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা। সাড়ে ৭ কাঠা করে প্লট পেয়েছেন বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) চেয়ারম্যান খালেদ মাহমুদ ও স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলী মো. আবুল কালাম আজাদ।
একাদশ সংসদের প্লট পাওয়া সাবেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, সংরক্ষিত মহিলা সংসদ সদস্যরা হলেন, অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী এমএ মান্নান, জনপ্রশাসনমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন, চট্টগ্রাম-৬ আসনের প্রফেসর ড. আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দিন নদভী, সাবেক মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম চৌধুরী, বগুড়া-৬ আসনের মো. নুরুল ইসলাম ওমর, রংপুর-২ আসনের আবুল কালাম মো. আহসানুল হক চৌধুরী, ফেনী-৩ আসনের রহিম উল্যাহ, চট্টগ্রাম-১৪ আসনের মো. নজরুল ইসলাম চৌধুরী, নীলফামারী-৪ আসনের মো. শওকত চৌধুরী, সিলেট-৫ আসনের সেলিম উদ্দিন, কক্সবাজার-৩ আসনের সাইমুম সরওয়ার কমল, লক্ষীপুর-১ (রামগঞ্জ) আসনের লায়ন এমএ আউয়াল, ভোলা-২ আসনের আলী আজম মুকুল, কুমিল্লা-৮ আসনের প্রফেসর মো. নুরুল ইসলাম মিলন, বগুড়া-৭ আসনের অ্যাডভোকেট মুহাম্মদ আলতাফ আলী, লক্ষীপুর-২ আসনের মোহাম্মদ নোমান, সাতক্ষীরা-৪ আসনের আলোচিত সংসদ সদস্য এসএম জগলুল হায়দার, ঝিনাইদহ-৩ আসনের মো. নবী নেওয়াজ, জামালপুর-৪ আসনের মোহাম্মদ মামুনুর রশিদ, সিলেট-২ আসনের ইয়াহইয়া চৌধুরী এহিয়া, চট্টগ্রাম-৪ আসনের দিদারুল আলম (দিদার), ঢাকা-১৭ আসনের এস এম আবুল কালাম আজাদ, কক্সবাজার-২ আসনের আশেক উল্লাহ রফিক, চট্টগ্রাম-১৬ আসনের মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী, নীলফামারী-১ আসনের মো. আফতাব উদ্দিন সরকার, নীলফামারী-৩ আসনের অধ্যাপক গোলাম মোস্তফা, নোয়াখালী-১ আসনের এইচ এম ইব্রাহিম, নড়াইল-২ আসনের শেখ হাফিজুর রহমান, দিনাজপুর-৬ আসনের মো. শিবলী সাদিক, যশোর-৫ আসনের স্বপন ভট্টাচার্য, কক্সবাজার-১ আসনের মোহাম্মদ ইলিয়াছ, কুমিল্লা-২ আসনের মো. আমির হোসেন, রাজশাহী-৩ আসনের মো. আয়েন উদ্দিন, গাইবান্ধা-৩ আসনের ডা. মো. ইউনুস আলী সরকার, হবিগঞ্জ-১ আসনের মোহাম্মদ আবদুল মুনিম চৌধুরী, নোয়াখালী-৬ আসনের আয়শা ফেরদাউস, টাঙ্গাইল-৫ (সদর) আসনের মো. ছানোয়ার হোসেন, ময়মনসিংহ-৩ আসনের বীর মুক্তিযোদ্ধা নাজিম উদ্দিন আহমেদ, মৌলভীবাজার-৩ আসনের সৈয়দা সায়রা মহসীন, সিরাজগঞ্জ-২ আসনের অধ্যাপক ডা. মো. হাবিবে মিল্লাত, কুষ্টিয়া-৪ আসনের আবদুর রউফ, সাতক্ষীরা-১ আসনের মুস্তফা লুৎফুল্লাহ, ঢাকা-২০ আসনের এম এ মালেক, মেহেরপুর-২ আসনের মো. মকবুল হোসেন, নরসিংদী-২ আসনের কামরুল আশরাফ খান, ঠাকুরগাঁও-৩ আসনের মো. ইয়াসিন আলী, কুড়িগ্রাম-৪ আসনের মো. রুহুল আমিন, মুন্সীগঞ্জ-১ আসনের সুকুমার রঞ্জন ঘোষ, নোয়াখালী-৩ (বেগমগঞ্জ) আসনের মো. মামুনুর রশীদ কিরণ, খুলনা-২ আসনের মুহাম্মদ মিজানুর রহমান, নওগাঁ-৩ আসনের মো. ছলিম উদ্দীন তরফদার, পার্বত্য রাঙামাটি আসনের উষাতন তালুকদার, ফেনী-২ আসনের নিজাম উদ্দিন হাজারী, ময়মনসিংহ-৫ আসনের সালাউদ্দিন আহমেদ মুক্তি, কিশোরগঞ্জ-২ আসনের অ্যাডভোকেট মো. সোহরাব উদ্দিন, ময়মনসিংহ-২ আসনের শরীফ আহমেদ, কুষ্টিয়া-১ আসনের আলহাজ মো. রেজাউল হক চৌধুরী, জয়পুরহাট-১ আসনের সামছুল আলম দুদু, সিরাজগঞ্জ আসনের গাজী স ম আমজাদ হোসেন মিলন, সিরাজগঞ্জ-১ আসনের খন্দকার আজিজুল হক আরজু, পাবনা-২ আসনের খন্দকার আজিজুল হক আরজু, জয়পুরহাট-২ আসনের আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন, গাইবান্ধা-৪ আসনের অধ্যক্ষ আবুল কালাম আজাদ, ময়মনসিংহ-৯ আসনের আনোয়ারুল আবেদীন খান তুহিন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১ আসনের মোহা. গোলাম রাব্বানী, চাঁদপুর-৪ আসনের ড. মোহাম্মদ শামছুল হক ভ‚ঁইয়া, ল²ীপুর-৪ আসনের মো. আবদুল্লাহ, নেত্রকোনা-১ আসনের ছবি বিশ^াস, ময়মনসিংহ-১০ আসনের ফাহমী গোলন্দাজ বাবেল, ময়মনসিংহ-১ আসনের জুয়েল আরেং, নাটোর-২ আসনের মো. শফিকুল ইসলাম শিমুল, ঢাকা-১৯ আসনের ডা. মো. এনামুর রহমান, ঢাকা-১৫ আসনের কামাল আহমেদ মজুমদার, পার্বত্য খাগড়াছড়ি আসনের কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা, নেত্রকোনা-৩ আসনের ইফতিকার উদ্দিন তালুকদার পিন্টু, নাটোর-১ আসনের মো. আবুল কালাম। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় হত্যার শিকার হওয়া বাংলাদেশের ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম (আনার) পেয়েছিলেন তিন কাঠার প্লট।
জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্যদের মধ্যে সুনামগঞ্জ-৪ আসনের পীর ফজলুর রহমান, গাইবান্ধা-১ আসনের ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী, বগুড়া-২ আসনের শরিফুল ইসলাম জিন্নাহ, বগুড়া-৩ আসনের মো. নুরুল ইসলাম তালুকদার, বরিশাল-৩ আসনের গোলাম কিবরিয়া টিপু, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা রাজশাহী-২ আসনের সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা, স›দ্বীপ-৩ আসনের মাহফুজুর রহমান মিতা ৩ কাঠার প্লট পেয়েছেন।
এ ছাড়া প্লট পেয়েছেন সংরক্ষিত মহিলা সংসদ সদস্য রিফাত আমিন, কামরুল লায়লা জলি, ওয়াসিকা আয়শা খান, খোরশেদ আরা হক, ফাতেমা জোহরা রানী, মনোয়ারা বেগম, দিলারা বেগম, সেলিনা বেগম, মোছা. সেলিনা জাহান লিটা, অ্যাডভোকেট উম্মে কুলসুম স্মৃতি, বেগম রওশন আরা মান্নান (জাতীয় পার্টি), রোকসানা ইয়াসমিন ছুটি, অ্যাডভোকেট নাভানা আক্তার, সেলিনা আখতার বানু, রহিমা আখতার, মাহজাবিন খালেদ, লুৎফুন নেছা (বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টি), অ্যাডভোকেট হোসনে আরা বেগম, জাহান আরা বেগম সুরমা, কাজী রোজী, সাবিহা নাহার বেগম (সাবিহা মুসা), অ্যাডভোকেট হোসনে আরা লুৎফা ডালিয়া, অ্যাডভোকেট শামছুন নাহার বেগম, সফুরা বেগম, বেগম আখতার আহান, লায়লা আরজুমান বানু, শাহানারা বেগম, মেরিনা রহমান, ফাতেমা তুজ্জহা, আমাতুল কিবরিয়া কেয়া চৌধুরী, হাজেরা খাতুন, ফিরোজা বেগম চিনু এবং কামরুন নাহার চৌধুরী।
এ বিষয়ে রাজউকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে প্লট বরাদ্দের জন্য তালিকা দেয়া হতো। তাদের ১৩/এ ধারায় প্লট বরাদ্দ দেয়া হয়। অনেকেই তিন কাঠার প্লট পেলেও প্রভাব খাটিয়ে সেই প্লটকে পাঁচ কাঠা কিংবা সাড়ে সাত কাঠায় রূপান্তর করেছেন। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর যারা প্লট পেয়েছেন তাদের অনেকেই প্লট বিক্রির চেষ্টা করছেন বলে জানা গেছে। সিদ্ধান্ত না হলেও বিভিন্ন অনিয়মের কারণে বরাদ্দকৃত প্লট বাতিল হতে পারে।
এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ক্ষমতার অপব্যবহার করা হয়েছে। রাজউকের সংশ্লিষ্ট যারা এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তারাও দায় এড়াতে পারেন না। উচ্চ পর্যায়ের চাপের প্রভাবে রাজউকের প্রতিহতের ক্ষমতা ছিল না। এর মাধ্যমে কর্তৃত্ববাদী সরকার বৈষম্য সৃষ্টি করেছে। আর রাজউক অবৈধ নির্দেশ দিলেই তারা কেন তা প্রতিপালন করবেন। ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বিশেষকে সুবিধা দেয়ার জন্য রাজউকসহ অন্য যেসব জায়গায় বৈষম্যমূলক ধারা তৈরি করা হয়েছে উল্লেখ করে তা বাতিলের আহŸান জানান তিনি। ১৩/এ ধারা বৈষম্যমূলকভাবে ক্ষমতাশালীদের অপব্যবহারের মাধ্যমে যুক্ত করা হয়েছে। গণতান্ত্রিক দেশে সবার জন্য সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।