বিএনপির গণসমাবেশ
অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না: তারেক রহমান
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৭:০৪ পিএম, ১৭ সেপ্টেম্বর,মঙ্গলবার,২০২৪ | আপডেট: ০১:৫৫ পিএম, ২০ নভেম্বর,
বুধবার,২০২৪
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সব কার্যক্রম পছন্দ না হলেও তাদের ব্যর্থ হতে দেয়া যাবে না বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
তিনি বলেছেন, ‘মনে রাখতে হবে, এই সরকারের ব্যর্থতা আমাদের সবার ব্যর্থতা। তাই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে কোনোভাবে ব্যর্থ হতে দেয়া যাবে না। তবে নিজেরা যেন নিজেদের ব্যর্থতার কারণ না হন, সে ব্যাপারে তাদের সতর্ক থাকতে হবে।’
মঙ্গলবার রাজধানীর নয়া পল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে অনুষ্ঠিত সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এই মন্তব্য করেন।
বিশ্ব গণতন্ত্র দিবস উপলক্ষ্যে এ সমাবেশের আয়োজন করে বিএনপি। সমাবেশটিতে হাজারো বিএনপি নেতাকর্মী অংশ নেয়, কেন্দ্রস্থল নয়াপল্টন হলেও তা রাজধানীর মতিঝিল, দৈনিক বাংলা হয়ে মৎস্যভবন পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে।
জনাকীর্ণ সমাবেশে তারেক রহমান বলেন, ‘ছাত্র-জনতার গণঅভুত্থানে পালিয়ে যাওয়া মাফিয়া সরকার দেশের অর্থনীতিকে শুধু ধ্বংস করেনি, প্রতিটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে দিয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘ছাত্র-জনতাসহ দেশের আপামর জনতা বন্দুকের নলে বুক পেতে বিশ্ববাসীকে দেখিয়েছে স্বৈরাচারীর নিকট তারা মাথানত করতে জানে না। গত ১৫ বছর আওয়ামী লীগ মাফিয়া শাসনতন্ত্র চালু করে দেশকে পরনির্ভরশীল রাষ্ট্রে পরিণত করেছিল। লুটপাট এবং টাকা পাচারের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিয়েছে। দেশের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে দলীকরণ করে রাষ্ট্র কাঠামোকে ভেঙে দিয়েছে। স্বৈরাচার পালানোর মধ্য দিয়ে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সুবাতাস বইছে। স্বৈরাচার পালালেও স্বৈরাচারের প্রেতাত্মা এখনো গণতন্ত্রকে ব্যাহত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ব্যর্থতা আমাদের ব্যর্থতা, তাই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ব্যর্থ হতে দেয়া যাবে না। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকেও সেদিকে সজাগ থাকতে হবে। জনগণের সরকার গঠনের লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশন, জনপ্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীসহ সকল বিষয়ে সংস্কার কার্যক্রম চালাতে হবে। এবারের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে শুধু গণতন্ত্রই নয় দেশের সার্বভৌমত্বও রক্ষা পেয়েছে। কেউ যদি মনে করে আরো নতুন রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন রয়েছে তাও দোষের কিছু নয়। জনগণের ভালোবাসার মাধ্যমে ধৈর্য সহকারে সকল ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের বীর ছাত্র-জনতা, নারী, শিশু, কৃষক, শ্রমিকসহ সকল শ্রেণী পেশার মানুষ সর্বস্তরের জনগণ বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশের জনগণ বন্দুকের সামনে বুক পেতে দিতে রাজি তবুও স্বৈরশাসন মেনে নিতে রাজি নয়। বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল বিএনপির পক্ষ থেকে বাংলাদেশের গনতন্ত্রকামী বীর জনগণকে জানাই আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবসের শুভেচ্ছা।’
তারেক রহমান বলেন, ‘গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে যারা শহীদি মৃত্যুবরন করেছেন, যারা আহত হয়েছেন, হাত পা চোখ হারিয়েছেন কিংবা চিরতরে পঙ্গুত্ববরণ করেছেন দেশের গণতন্ত্রকামী জনগণ আজীবন তাদের এই আত্মত্যাগ এবং অবদান শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে। হতাহতদের প্রতিটি পরিবারের প্রতি অবশ্যই রাষ্ট্র যথাযথ দায়িত্ব পালন করবে।’
তিনি বলেন, ‘লাখো শহীদের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের রাষ্ট্র-রাজনীতি, শাসন প্রশাসন হওয়ার কথা ছিল গভর্নমেন্ট অফ দ্যা পিপল বাই দ্যা পিপল ফর দ্যা পিপল। অথচ গত ১৫ বছর বাংলাদেশে মাফিয়া শাসন চালু করা হয়েছিল। বিদেশে পলাতক স্বৈরাচার বিনাভোটের সরকারের পরিচয় হয়ে উঠেছিল গভর্নমেন্ট অফ দ্যা মাফিয়া বাই দ্যা মাফিয়া ফর দ্যা মাফিয়া। এই মাফিয়া চক্র দেশকে সর্বক্ষেত্রে ভঙ্গুর করে দিয়েছিল। দেশকে সম্পূর্ণ আমদানি-নির্ভর, ঋণ-নির্ভর এবং পরনির্ভরশীল রাষ্ট্রে পরিণত করেছিল। মাফিয়া চক্র দেশের ব্যাংকগুলো দেউলিয়া করে দিয়েছে। গত দেড় দশকে দেশ থেকে ১৭ লাখ কোটি টাকার বেশি পাচার করে দিয়েছে।’
‘৫ আগস্টের পতিত স্বৈরাচারের বেপরোয়া দুর্নীতি আর লুটপাটের কারণে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ বর্তমানে ১০০ বিলিয়ন ছাড়িয়েছে। বাংলাদেশে আজ যে শিশুটি জন্ম নিয়েছে কোনো কারণ ছাড়াই সেই শিশুটিরও মাথা পিছু ঋণ কমপক্ষে দেড় লাখ টাকা। মাফিয়া চক্র দেশকে শুধু অর্থনৈতিক ভাবেই ভঙ্গুরকরে দেয়নি। দেশের আর্থ-সামাজিক সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক রীতিনীতিকেও ধ্বংস করে দিয়েছে। প্রতিটি সাংবিধানিক এবং বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান অকার্যকর করে ফেলা হয়েছিল। খোদ ফ্যাসিবাদকেই বিচার বিভাগের সূতিকাগারে পরিণত করে ফেলা হয়েছিল। একটি রাষ্ট্র কতটা সভ্য এবং গণতান্ত্রিক সেটি দেশের আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর আচরণে স্পষ্ট হয়ে উঠে। কিন্তু মাফিয়া চক্র দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করতে গিয়ে দেশের আইনশৃঙ্খলাবাহিনীকেও সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত করে দিয়েছে।’
‘অন্যায় অনিয়ম আর অরাজকতার বিরুদ্ধে গণবিস্ফোরণে মাফিয়া চক্রের প্রধান দেশ ছেড়ে পালানোর পর দেশে মাফিয়া শাসন-শোষণের অবসান ঘটেছে। পতিত স্বৈরাচারের পলায়নের মধ্য দিয়ে একটি গণতান্ত্রিক-মানবিক বাংলাদেশ গড়ার পথে প্রধান বাধা দূর হয়েছে। তবে বাধা দূর হলেও মাফিয়া চক্রের রেখে যাওয়া ১৫ বছরের জঞ্জাল দূর হয়নি। এই জঞ্জাল দূর করে জনগণের বাংলাদেশে জনগণের ভোটে জনগণের কাছে জবাবদিহিমূলক একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কাজ করছে। তবে মাফিয়া চক্রের প্রধান হাসিনা দেশ ছেড়ে পালালেও মাফিয়া চক্রের বেনিফিশিয়ারি অপশক্তি প্রশাসনের অভ্যন্তরে থেকে কিংবা রাজনীতির ছদ্মাবরণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়ার অপচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।’
‘বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হাজারো শহীদের রক্তের বিনিময়ে লাখো কোটি জনতার গণ অভ্যুত্থানের ফসল। এই সরকারের কোনো কোনো কার্যক্রম সকলের কাছে হয়তো সাফল্য হিসেবে বিবেচিত নাও হতে পারে কিন্ত এই সরকারের ব্যর্থতা হবে আমাদের সকলের ব্যর্থতা। বাংলাদেশের পক্ষের গণতন্ত্রকামী জনগণের ব্যর্থতা। এটি আমাদের প্রত্যেকের মনে রাখতে হবে। সুতরাং এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে কোনোভাবেই ব্যর্থ হতে দেয়া যাবে না। দেশ-বিদেশ থেকে নানারকমের উস্কানিতেও জনগণ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ব্যর্থ হতে দেবে না। তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যাতে নিজেরাই নিজেদের ব্যর্থতার কারণ না হয়ে দাঁড়ায় সে ব্যপারে তাদেরকেও সতর্ক থাকতে হবে।’
‘বাংলাদেশ কিংবা যেকোনো দেশেই গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত সরকার অবশ্যই জনগণের সরকার। তাই জনগণ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছে, রাখবে। তবে কোনো এক পর্যায়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জবাবদিহিতাও কিন্তু নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমেই নিশ্চিত করা হয়। সুতরাং জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের মাধ্যমে একটি নির্বাচিত সংসদ এবং সরকার প্রতিষ্ঠাই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সকল সংস্কার কার্যক্রমের প্রথম এবং প্রধান টার্গেটও হওয়া জরুরি।’
‘এ জন্যই অগ্রাধিকারভিত্তিতে জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা গঠিত জবাবদিহিমূলক সরকার এবং সংসদ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যকে সামনে রেখেই সংস্কার কার্যক্রম এগিয়ে নেয়া দরকার। কারণ জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন ছাড়া সংস্কার কার্যক্রমের প্রক্রিয়ায় জনগণের সরাসরি সম্পৃক্ততা ছাড়া উন্নয়ন-গণতন্ত্র কিংবা সংস্কার কোনোটিই টেকসই এবং কার্যকর হয়না। একটি অবাধ সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিটি ভোটারের ভোট প্রদানের অধিকার নিশ্চিত করে ভোটারদের কাঙ্ক্ষিত প্রতিনিধি নির্বাচন করার অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা সম্ভব।’
‘সেই লক্ষ্যে বিশেষ করে নির্বাচন কমিশন জনপ্রশাসনের সংস্কার এবং আইনশৃঙ্খলাবাহিনীকে সক্ষম ও উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে অগ্রাধিকারভিত্তিতে পদক্ষেপ নিতে হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ইতোমধ্যেই বেশ কিছু ক্ষেত্রে সংস্কার কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। তবে বিএনপি মনে করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এজেন্ডা সেটিংয়ের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার নির্ধারণ করতে না পারলে গণঅভুত্থানের সাফল্য ব্যাহত করতে ষড়যন্ত্রকারী চক্র নানা সুযোগ গ্রহণ করতে পারে। এর কিছু আলামত ইতোমধ্যেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।’
‘এবারের গণঅভ্যুত্থানের চরিত্র অতীতের যে কোনো গণ-অভ্যুথানের চেয়ে ব্যতিক্রম। কেন ব্যতিক্রম? কারণ পলাতক স্বৈরাচারের অবৈধ শাসনকালে সকল গণতান্ত্রিক অধিকার মানবাধিকার হারিয়ে জনগণ পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে পড়েছিল। দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বও হারাতে বসেছিল।
‘তাই, এবারের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে কেবল মানুষের অধিকারই প্রতিষ্ঠিত হয়নি, দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষা পেয়েছে। দেশ এবং জনগণ এখন গুম খুন অপহরণ আর বিভীষিকাময় আয়নাঘরের আতঙ্কমুক্ত, স্বাধীন। স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষার পর এবার দেশ এবং জনগণের স্বাধীনতা সুরক্ষায় প্রথম কাজ হতে হবে, রাষ্ট্র এবং সমাজে মানুষের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক অধিকার এবং ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা।’
‘দেশে বর্তমানে প্রায় সাড়ে ১২ কোটি ভোটার। এর মধ্যে ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ভোটার তালিকায় প্রায় আড়াই কোটি নতুন ভোটার যুক্ত হয়েছে। ভোটার হওয়ার পর তরুণ প্রজন্মের এই আড়াই কোটি ভোটার একটি জাতীয় নির্বাচনেও ভোট দেয়ার সুযোগ পায়নি। ভোট দিয়ে তারা তাদের কাঙ্ক্ষিত জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করতে পারেনি। কিংবা তাদের নিজেরাও কেউ ভোটে নির্বাচিত হয়ে জনগণের প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পায়নি।’
‘বিএনপি মনে করে, দেশের জনশক্তির অর্ধেক নারী এবং তারুণ্যের এই বৃহৎ অংশকে, রাজনৈতিক অংশীদারিত্বের বাইরে রেখে একটি বৈষম্যহীন মানবিক রাষ্ট্র গঠন সম্ভব নয়। সংবিধান কিংবা প্রবিধানে যাই থাকুক জনগণের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা না গেলে সংস্কার প্রক্রিয়ায় জনগণকে সম্পৃক্ত করা না গেলে শেষ পর্যন্ত কোনো সংস্কার কার্যক্রমেরই কার্যকরী ফল পাওয়া যাবে না।’
‘রাষ্ট্র-রাজনীতি এবং রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি দলীয় রাজনৈতিক কার্যক্রম সংস্কারের লক্ষ্যে ২০২৩ সালেই বাংলাদেশের পক্ষের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে ৩১ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল। তবে ঘোষিত ৩১ দফাই শেষ কথা নয়।’
‘বিএনপি মনে করে, রাষ্ট্র কিংবা রাজনীতি, সকল ক্ষেত্রেই সংস্কার কার্যক্রম একটি ধারাবাহিক এবং চলমান প্রক্রিয়া। সুতরাং রাষ্ট্র এবং রাজনীতি সংস্কারে বিএনপি ঘোষিত ৩১ দফা সংস্কার কর্মসূচির আরো প্রয়োজনীয় পরিবর্তন পরিমার্জনকেও বিএনপি স্বাগত জানায়।’
‘এমনকি কেউ যদি মনে করেন, একটি উন্নত এবং নিরাপদ বাংলাদেশের জন্য আরো নতুন রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন রয়েছে, তাতেও দোষের কিছু নেই। কারণ শেষ পর্যন্ত, জনগণই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে তারা কাকে সমর্থন জানাবে কিংবা কাকে সমর্থন দেবে না। এ কারণেই বিএনপি বারবার জনগণের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার ওপর জোর দিয়েছে। বিএনপি মনে করে, একমাত্র অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমেই রাষ্ট্র-রাজনীতি এবং রাজনৈতিক বন্দোবস্তের সাথে জনগণের প্রতক্ষ্য অংশীদারিত্ব তৈরি হয়।’
‘গণঅভ্যুত্থান কিংবা সংস্কার কার্যক্রম নিয়ে রাজনীতির মাঠে নানারকম কথা হচ্ছে। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে এটি একটি স্বাভাবিক এবং গ্রহণযোগ্য রীতি। প্রত্যেকেই তাদের নিজ নিজ দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করবেন, এটিই স্বাভাবিক। এ নিয়ে বিচলিত হওয়ার কিছু নেই। একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে আমি বিশ্বাস করি, ফৌজদারি অপরাধের বিচার যেমন বিচারিক আদালতে হয় ঠিক তেমনি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড কিংবা রাজনৈতিক আচরণের বিচার হয় জনগণের আদালতে।’
তারেক রহমান বলেন, ‘আমি আগেও বলেছি, ক্ষমতার পরিবর্তন মানে শুধুই রাষ্ট্র ক্ষমতার হাত বদল নয়। ক্ষমতার পরিবর্তন মানে রাষ্ট্র এবং রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন। তাই প্রতিটি রাজনৈতিক নেতা-কর্মীর মনে রাখা প্রয়োজন রাজনীতির গুণগত পরিবর্তনের জন্য রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের আচার-আচরণেও গুণগত পরিবর্তন জরুরি। সুতরাং আমার আহ্বান, কোনো প্রলোভন কিংবা উস্কানিতে বিভ্রান্ত না হয়ে জ্ঞানভিত্তিক রাষ্ট্র এবং সমাজের নেতৃত্ব দানের জন্য নিজেদেরকে প্রস্তুত রাখুন।’
তিনি বলেন, ‘হাজারো শহীদের রক্তস্নাত এই রাজপথে আজ আপনাদের এই স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতির অর্থ, ছাত্র-জনতার কাঙ্ক্ষিত বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার এই যাত্রাপথে বাংলাদেশের পক্ষের শক্তিকে, হয়তো আরো ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। আরো কিছু পথ পাড়ি দিতে হবে। তবে সেই পথ সন্ত্রাস-সংঘর্ষ-প্রতিশোধ কিংবা প্রতিহিংসার নয়। সেই পথ হবে ধৈর্য-সহনশীলতা এবং সমঝোতার।’
তারেক রহমান বলেন, ‘সবশেষে বলতে চাই, সংস্কার কার্যক্রমের পথ ধরে নির্বাচনী রোডম্যাপে উঠবে দেশ। সুতরাং আসুন, আমরা সবাই কাজের মাধ্যমে জনগণের বিশ্বাস ভালোবাসা অর্জন করি। জনগণের সঙ্গে থাকি। জনগণকে সঙ্গে রাখি।’
সমাবেশে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ সবসময় গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করেছে। শুধু ৫২, ৭১ নয়। গণতন্ত্র যেন সুপ্রতিষ্ঠিত হয় সে জন্য আমরা ৩১ দফা দিয়েছি। ছাত্র-জনতার আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা একটা সুযোগ পেয়েছি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য, সেটি যেন হেলায় ফেলে না দেই।’
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘সরকারের মধ্যে ফ্যাসিজমের অনেক প্রেতাত্মা অবস্থান করছে, তারা এখনো আমাদের বিজয়কে ব্যর্থ করতে ষড়যন্ত্র করেছে।’
এসময় বর্তমান সরকারের কাছে আন্দোলনে প্রতিটি আহত, পঙ্গু ও শহীদদের রাষ্ট্রীয়ভাবে ক্ষতিপূরণ দেয়ার দাবি করেন বিএনপি মহাসচিব।
স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেছেন, বেগম খালেদা জিয়া দেশ ছেড়ে পালাননি। কারণ তিনি বলেছিলেন- এদেশ আমার, মাটি আমার। এদেশ থেকে আমি কোথাও যাব না। অন্যদিকে শেখ হাসিনা তার নেতাকর্মীদের ছেড়ে পাশের দেশে পালিয়েছেন। চট করে না কি চলে আসবেন। আমি বলব- আসুন। আপনার অপেক্ষায় আমরা সবাই আছি।
মির্জা আব্বাস আরও বলেন, গত ১৭ বছরে আমাকে ৩৪ বার গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আমাদের কোর্টে তোলা হলে সাংবাদিকরা বলতো ভাই হাত নাড়েন। নেতাকর্মীরা ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানাতেন। বীরের মতো আদালতে গেছি। আমার দল ও নেতাকর্মীরা গণতন্ত্রকে ভালোবাসে। বেগম খালেদা জিয়া ১৯৯৬ সালে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিলেন। কারণ তিনি হাসিনার মতো ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকেননি। আজকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা গ্রেপ্তার হচ্ছেন চোরাকারবারি হিসেবে। আমার জনগণের জন্য রাজনীতি করি। আমাদের মার খেতে হয়নি। হবেও না ইনশাআল্লাহ।
এর আগে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান বলেন, গত ১৬/১৭ বছরে আওয়ামী লীগ যত অত্যাচার নির্যাতন করেছেন তার সবকিছুর বিচার করতে হবে। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের মুক্তিকামী ছাত্রজনতা ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। যা সারা বিশ্বে লিপিবদ্ধ হয়ে থাকবে। বিএনপির নেতৃত্বে দেশের সব রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ থেকে খুনি স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারকে বিদায় দিতে পেরেছে। তারা স্ফূলিঙ্গ তৈরি করেছিল। ফলশ্রুতিতে আগ্নেয়গিরির লাভার মতো দেশের ছাত্র-জনতার ঢল নেমেছিল।
মঈন খান বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারকে তাদের লক্ষ্য পরিষ্কার করতে হবে। তবে দেশ থেকে স্বৈরাচার মূলোৎপাটন করার আগে কিছু অত্যাবশ্যকীয় সংস্কার সরকারকে করতে হবে। এজন্য প্রতিটি রাজনৈতিক দল তাদের সহযোগিতা করার আশ্বাস দিয়েছে।
এসময় তিনি বলেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান একটি কঠিন সময়ে বিএনপির নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তিনি স্বৈরাচার মুক্ত বাংলাদেশ উপহার দিয়েছেন।
সমাবেশে বক্তব্য দেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হাবিব উন নবী খান সোহেল। তিনি বলেন, আমরা শেখ হাসিনাকে বহুবার বলেছি কেয়ারটেকার সরকার দেন। আমাদের দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বহুবার বলেছেন। কিন্তু তিনি আমাদের কথা শোনেননি। তিনি দাদাদের কথা শুনলেন। আমাদের কথা শুনলে এভাবে পালিয়ে যেতে হতো না। এখন বলে তিনি নাকি চট করে ঢুকে যাবেন? আসেন না! বিএনপির নেতাকর্মীরা গত ১৫/১৬ বছরে পুরনো জুতা একটাও ফেলে দেয়নি। সবগুলো উপহার দিতে চাই। আজকে কাকু (ওবায়দুল কাদের) কোথায়? তিনি নাকি পালাবেন না! কিন্তু তাকে তো টোকাইয়া পাই না।
সোহেল আরও বলেন, দলের সব নেতাকর্মীকে ফেলে পালালেন। যেন চাচা আপন প্রাণ বাঁচা। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বলি, যে দলের নেতা সবাইকে ছেড়ে পালিয়েছে তার দল করিয়েন না। যারা তাকে আশ্রয় দিয়েছে তাদের বলি যে, হাসিনা খুনি। তিনি অসংখ্য শিশুসহ মানুষ খুন করেছে। শাপলা চত্বরে গণহত্যা চালিয়েছে। পিলখানায় ৫৭ জন চৌকস সামরিক বাহিনীর অফিসারকে হত্যা করেছে। এই সিরিয়াল কিলার শেখ হাসিনাকে যারা আশ্রয় দিয়েছেন, কান পেতে শোনেন, ঢাকা শান্তিতে না থাকলে দিল্লিও শান্তিতে থাকতে পারবে না। বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষ এক একজন সৈনিক। অতএব হুমকি দিয়ে কাজ হবে না।
যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি বলেন, যে লড়াইয়ে আমরা অবতীর্ণ হয়েছিলাম সেই গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার আদায়ের লড়াই এখনো শেষ হয়নি। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস অত্যন্ত সম্মানিত ব্যক্তি। আপনার কাছে আহ্বান- যারা গত ১৫ বছরে গুম খুন ও লুটপাটে জড়িত ছিল তাদের বিচার করুন।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সভাপতিত্বে সভা পরিচালনা করেন বিএনপির প্রচার সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সদস্য সচিব আমিনুল হক ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সদস্য সচিব তানভীর আহমেদ রবিন।
আরও বক্তব্য দেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন, ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট জয়নাল আবেদিন, ড. আসাদুজ্জামান রিপন, বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মো. আবদুস সালাম, যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন, শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি, আব্দুস সালাম আজাদ, চেয়ারপার্সনের বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, সাংগঠনিক সম্পাদক কাজী সাইয়েদুল আলম বাবুল, মহিলা দলের সভাপতি আফরোজা আব্বাস, স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক রাজীব আহসান, কৃষকদলের সভাপতি হাসান জাফির তুহিন প্রমুখ।
উপস্থিত ছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, গণশিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খান, ঢাকা বিভাগের সহসাংগঠনিক সম্পাদক নজরুল ইসলাম আজাদ, কেন্দ্রীয় নেতা প্রকৌশলী আশরাফ উদ্দিন বকুলসহ বিএনপি ও বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের হাজারো নেতাকর্মীরা।