ডোনাল্ড লুর বক্তব্য নিয়ে সরকার মিথ্যাচার করছে : মির্জা ফখরুল
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৯:৫৬ পিএম, ১৮ জানুয়ারী,
বুধবার,২০২৩ | আপডেট: ০৭:২৯ পিএম, ৮ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪
যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লুর বক্তব্য নিয়ে ‘সরকার মিথ্যাচার করেছে’ বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
আজ বুধবার দুপুরে গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে গতকাল মঙ্গলবার রাতে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল সভার সিদ্ধান্ত জানাতে ডাকা এক সংবাদ সম্মেলনে মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফর নিয়ে সরকারের কয়েকজন মন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি এই মন্তব্য করেন। সভায় সভাপতিত্ব করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। সভায় উপস্থিত ছিলেন, জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, বাবু গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. আব্দুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, বেগম সেলিমা রহমান, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, অর্থাৎ এই সরকার মিডিয়াকে ব্যবহার করে, জোর করে যে একটা কথা বলতে চেয়েছেন জনগণের সামনে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার অবস্থান পরিবর্তন করেছে, তারা এই নিষেধাজ্ঞা (র্যাবের ওপর) তুলে নেবেন এবং বাংলাদেশের সরকার তারা গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচন করতে চায়-এই ধরনের একটা ধারণা তারা (সরকার) জনগণকে দেয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু গতকাল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঢাকা দূতাবাস থেকে যে বিবৃতি দেয়া হয়েছে দ্যাটস ইজ এনাফ টু এক্সপ্লেইন দিস, দূতাবাসের সেই স্টেটমেন্টে সেটা ক্লিয়ার হয়ে গেছে। অতীতেও এই আওয়ামী লীগের গণবিরোধী সরকার তারা সবসময় মিথ্যাচার করে এসেছে। খুব দুঃখের ও লজ্জার বিষয়, এই মিথ্যাচারটা করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী তিনি ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এগুলো করা হয়েছে এবং সাথে সাথেই দূতাবাস তারা সেটার প্রতিবাদও জানিয়েছে।
লুর সফর নিয়ে বিএনপির পর্যবেক্ষণ কি জানতে চাইলে মির্জা ফখরুল বলেন, আমরা বরাবরই যেটা মনে করি যে, বিদেশের শক্তির ওপর নির্ভর করে কখনো গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করা যায় না। জনগণের শক্তির ওপরেই এখানে গণতন্ত্রকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হয়েছে বরাবর। এবারও আপনারা লক্ষ্য করেছেন যে, জনগণ এই সরকারের বিরুদ্ধে জেগে উঠেছে, জনগণ সমস্ত বাধা-বিপত্তি-নির্যাতনকে উপেক্ষা করে শান্তিপূর্ণভাবে তাদের যে প্রতিবাদ যেটা তারা জানাচ্ছে, সেভাবে তারা সংগঠিত হচ্ছে। সুতরাং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বলুন, চীন বা রাশিয়া বলুন বা ভারত বলুন তারা কী বললো না বললো তারজন্যে নিশ্চয়ই নিঃসন্দেহে একটা জিয়ো-পলিটিক্যাল সিচুয়েশন থাকে। তবে আমরা যেটা লক্ষ্য করছি, গণতন্ত্রের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের যে কমিটমেন্ট সেই কমিটমেন্ট তারা খুব অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে প্রকাশ করেছেন। একটা সুষ্ঠু নির্বাচন, একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন, একটি অংশীদারমূলক নির্বাচনের ব্যাপারেও তাদের যে মন্তব্য সেই মন্তব্য তারা অবশ্যই করেছেন এবং কমিটমেন্ট করেছেন। তিনি (ডোনাল্ড লু) একটা ইম্পোর্টেন্ট কথা বলেছেন যে, গণতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত যদি কোথাও হয়-এই কথা আমরা বলব এবং আমরা আমাদের পরামর্শের কথাও জোর দিয়ে বলব। সেই পরামর্শ তারা দিয়ে গেছেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কিভাবে মন্ত্রীরা বলেন, নিষেধাজ্ঞা উঠে যাবে। একথা তিনি (লু) বলেননি। আমরা কিন্তু এই নিষেধাজ্ঞা আরোপে খুব আনন্দিত নই। আমরা বার বার বলেছি, এই নিষেধাজ্ঞার মানে হচ্ছে আমাদের জন্য লজ্জাজনক, বাংলাদেশের জন্য লজ্জাজনক যে, একটা প্রতিষ্ঠানের ওপরে নিষেধাজ্ঞা এসেছে। এই নিষেধাজ্ঞা আসা উচিত সরকারের ওপরে। সরকারের নির্দেশে এই সমস্ত ঘটনাগুলো ঘটেছে, র্যাব অতীতে যেসব করেছে ডিজএপিয়ারেন্স। নিষেধাজ্ঞা তো এখন সরকারের ওপরে দিচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দিলো কি দিলো না দিস ইজ নট এ মেটার। নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে জনগণ এবং সামনে জনগণ সেই নিষেধাজ্ঞাকে বাস্তবায়িত করবে।
নির্বাচন প্রসঙ্গে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আমাদের অবস্থান পরিষ্কার। আমরা তো বলেই দিয়েছি যে, আমরা এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে যাবো না। এটা খুব পরিষ্কার কথা। আমরা বিশ্বাস করি, এই সরকারের অধীনে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী যিনি আছেন তার অধীনে এখানে কখনোই নির্বাচন সুষ্ঠু অবাধ গ্রহণযোগ্য হতে পারবে না। বিএনপির সঙ্গে ডোনাল্ড লুর কোনো সাক্ষাতের কর্মসূচি ছিলো কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, না আমাদের সঙ্গে তার কোনো প্রোগ্রাম ছিলো না। এবার কিন্তু কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তারা কোনো বৈঠক করেনি।
সভায় নিম্নবর্ণিত সিদ্ধান্তসমূহ গৃহীত হয়।
১। সভায় বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে মহাসচিব সভাকে অবহিত করেন।
২। সভায় গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে বিএনপি ও অন্যান্য বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর আন্দোলনকে দমন করার জন্য অনির্বাচিত আওয়ামী লীগ সরকার ও আওয়ামী লীগ আন্দোলনের শুরু থেকেই উস্কানিমূলক বক্তব্য প্রদান করছে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে সন্ত্রাসী হামলা করছে। ইতিমধ্যে পুলিশের গুলি ও আওয়ামী সন্ত্রাসীদের নৃশংস হামলায় ১৫ জন বিরোধী দলের নেতা-কর্মী শহীদ হয়েছেন। অসখ্য নেতা-কর্মী আহত ও প্রায় ৫ হাজার নেতা-কর্মী গ্রেফতার হয়েছেন। আওয়ামী লীগ সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক পন্থায় ত্রাস সৃষ্টি করার লক্ষ্যে বিরোধী দলের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির সময় পাল্টা কর্মসূচি ঘোষণা করে সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চাইছে। তাদের এই ধরনের পাল্টা কর্মসূচি ঘোষণা ও নেতৃবৃন্দের উসকানিমূলক বক্তব্য, বিশেষ করে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ্যেই বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের হাত পা ভেঙ্গে দেয়া, হাত জ্বালিয়ে দেয়ার হুমকি ও নির্দেশ আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীদের আরও অনুপ্রাণিত করছে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড ঘটাতে। আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ, সরকারের মন্ত্রীবৃন্দ মুখে গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি করার কথা বললেও বাস্তবে সন্ত্রাসী পরিবেশ তৈরি করছে। বিএনপির শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে বাধা প্রদান, হামলা, গুলিবর্ষণ, পরিবহন ধর্মঘট সৃষ্টি করা, হোটেল, রেস্তোরাঁ বন্ধ করে বিরোধী দলের ও বিএনপির কর্মসূচিগুলো পন্ড করার হীন নীল নকশা তৈরি করছে। গণবিরোধী সরকার বিরোধী আন্দোলনে জনগণের যে ঢল নামছে তা দেখে ভীত হয়ে আওয়ামী লীগ ও অনির্বাচিত সরকার হত্যা, হুমকি, মামলা ও নির্যাতনের মাধ্যমে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার পুনরুদ্ধারের আন্দোলনকে নস্যাৎ করতে চায়। সভায় আওয়ামী লীগের এই অপতৎপরতার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানো হয়। বিএনপি ও বিরোধী দলের কর্মসূচি পাল্টা কর্মসূচি পালন করা, বাধা প্রদান এবং একই দিনে একই সময় কোনও কর্মসূচি প্রদান না করার আহ্বান জানানো হয়। অন্যথায় উদ্ভূত পরিস্থিতির সকল দায় আওয়ামী লীগ ও সরকারকেই বহন করতে হবে।
৩। সভায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপপ্রয়োগ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়। গত চার বছরে ১ হাজার ২০৯টি মামলা দায়ের হওয়াতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। সভা মনে করে এই চরম নির্বতনমূলক আইনের মাধ্যমে ভিন্নমত পোষণকারী ব্যক্তি, সংবাদ কর্মী, বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার ও আটকের মাধ্যমে জনগণের গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক অধিকারের ওপর চরম আঘাত করা হচ্ছে ও মানবাধিকার লংঘন করা হচ্ছে। নিরপরাধ ব্যক্তিদের ওপর এই আইনের অপপ্রয়োগের ফলে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণ করা হচ্ছে। সভায় অবিলম্বে এই আইনের আওতায় বন্দি ব্যক্তিদের মুক্তি ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবি জানানো হয়।
৪। সভায় মুঠোফোন ও ইন্টারনেট যোগাযোগের ওপর নজরদারি করার জন্য ইসরাইলি এক কোম্পানীর কাছ থেকে প্রযুক্তি ক্রয় করা হয়েছে বলে দেশ বিদেশের গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হওয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। একই সঙ্গে সংসদে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর টেলিফোনে আড়িপাতার বিষয়ে আইন প্রণয়নের ঘোষণায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। সভা মনে করে বর্তমান কর্তৃত্ববাদী, অনির্বাচিত সরকার তাদের অবৈধ উপায়ে দখলকৃত ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার লক্ষ্যে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের নজরদারিতে রাখার জন্য সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তি ক্রয় ও আড়িপাতার আইন প্রণয়ন করতে চলেছে। সভা এই ভয়াবহ নিবর্তনমূলক আইন ও আইনশৃংখলা রক্ষা বাহিনীর অগণতান্ত্রিক আচরণ জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার ও সাংবিধানিক অধিকার কেড়ে নিতে সহায়ক ভূমিকা রাখছে। সভায় অবিলম্বে এই সব প্রযুক্তি ক্রয় করা ও আইন প্রণয়নের অপচেষ্টা থেকে বিরত থাকার জন্য আহ্বান জানানো হয়।
৫। সভায় সম্প্রতি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাচন কর্মকর্তা রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্ব, দলের গঠনতন্ত্র ও কর্মসূচি নিয়ে যে এখতিয়ার বহির্ভূত, শিষ্টাচার বিবর্জিত অপ্রয়োজনীয় মন্তব্য করেছেন তার তীব্র নিন্দা জানানো হয়। সভা মনে করে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা, জনগণের ভোটের অধিকার ফিরে পাওয়া, সুশাসন প্রতিষ্ঠা, রাষ্ট্রের সকল প্রতিষ্ঠানের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা, সরকারের লাগামহীন দুর্নীতি বন্দের দাবি নিয়ে যখন দুর্বার গণআন্দোলন গড়ে উঠছে তখন এই ধরনের মন্তব্য একনায়কতন্ত্র, দুর্নীতি ও ফ্যাসিবাদকে প্রশ্রয় দেবে এবং প্রকাশ্যে জনগণের ন্যায়সংগত দাবির প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা শামিল হবে। সভা মনে করে গণতান্ত্রিক সকল দল, ব্যক্তি, সংগঠনের দায়িত্ব হচ্ছে জনগণের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং একটি উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জনগণের আন্দোলনকে সমর্থন দিয়ে তাকে শক্তিশালী করা, এই সময়ে নেতিবাচক মন্তব্য করা শুধুমাত্র গণতন্ত্র বিরোধী গণশত্রুকে সাহায্য করা হবে যা কখনই গ্রহণযোগ্য হবে না। সচেতন সকল নাগরিককে চলমান গণতান্ত্রিক আন্দেলনে সমর্থন করে ভয়াবহ দানবীয় একনায়কতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসান ঘটানোর আহ্বান জানানো হয়।
৬। সভায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ১০ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে চলমান কর্মসূচি সফল করার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।