পুলিশের তথ্য সংগ্রহ নিয়ে বিএনপির প্রশ্ন রয়েছে : মির্জা ফখরুল
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৫:৪৩ পিএম, ৭ অক্টোবর,শুক্রবার,২০২২ | আপডেট: ০৭:৩১ পিএম, ২০ নভেম্বর,
বুধবার,২০২৪
সারাদেশে পুলিশের বিশেষ শাখার নির্দেশনায় বিরোধী নেতা-কর্মী-সমর্থক-শুভাকাঙ্খীদের ‘তথ্য সংগ্রহে’র বৈধ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
রাঙ্গামাটি পুলিশ সুপারের ‘বেতার বার্তার’ বিষয়টি তুলে ধরে আজ শুক্রবার সকালে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি এই প্রশ্ন তুলেন।
তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশ পুলিশের ঢাকাস্থ স্পেশাল ব্রাঞ্চ হেডকোয়াটোর্সের বরাত দিয়ে রাঙ্গামাটি জেলার পুলিশ সুপার(এসপি-বিএসবি) গত ২৫ সেপ্টেম্বর বেতার বার্তা নং ৩৯০৯ (রাজনৈতিক) মুলে জেলার সকল থানার ওসিদেরকে বিএনপিসহ অন্যান্য বিরোধী রাজনৈতিক দল ও অন্যান্য রাজনৈতিক সংগঠনের রাঙ্গামাটি জেলার কমপক্ষে ৮ জন শীর্ষ ব্যক্তি, প্রতি উপজেলারর শীর্ষ ৫ ব্যক্তি এবং জেলার সকল পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের অধীন কমপক্ষে ৫ ব্যক্তি যারা বর্তমান সরকার বিরোধী চলমান আন্দোলনে ‘জনবল সংগঠক’ বা অর্থায়ন করে কিংবা অন্য কোনোভাবে সহযোগিতা করে এমন ব্যক্তিদের বিস্তারিত তথ্য যেমন ঠিকানা, মোবাইল নম্বর ও এনআইডি নম্বর ইত্যাদি সংগ্রহ করে তার কাছে প্রথমে ইমেইল যোগে এবং পরে হার্ড কপি পাঠাতে নির্দেশ দিয়েছে।
বিএনপি বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পেরেছে যে, ঢাকাস্থ স্পেশাল ব্রাঞ্চের নির্দেশনা অনুযায়ী সারাদেশে সকল জেলার পুলিশ সুপার নিজ নিজ এলাকার সকল থানার ওসিকে বেতার বার্তা অনুযায়ী তথ্য সংগ্রহের নির্দেশনা জারি করেছে।”
‘‘পুলিশ বিরোধী রাজনৈতিক দলসমূহের নেতা-কর্মীদের যে তথ্য সংগ্হ করছে তা আমাদের সংবিধান কিংবা দেশের অন্য কোনো প্রচলিত আইন বা বিধি বিধানের আওতায় তারা করতে পারে না। পুলিশ সুপার তার আওতায় ওসিদের নিকট বেতার বার্তা বা অন্য কোনো ব্যবস্থায় যেসব তথ্য চেয়েছে তা যে কোনো মানদন্ডে অবৈধ, বেআইনি, স্বেচ্ছাচারী এখতিয়ারবর্হিভূত ও অননুমোদিত পদক্ষেপ। পুলিশের এসব নির্দেশনা সর্বতোভাবে একটি ‘ম্যালা ফাইড ডিরেকশন’ যা চলমান গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও গণতন্ত্রের পক্ষের শক্তিকে দমন করার হীন উদ্দেশ্যে জারি করা হয়েছে। বিএনপি এই ধরনের অবৈধ কর্মকান্ডের তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাসমূহকে এই ধরনের অবৈধ বন্ধ করা এবং ভবিষ্যতে নিজেদেরকে এ থেকে বিরত থাকার আহবান জানাচ্ছে।”
এক প্রশ্রের জবাবে বিএনপি মহাসচিব দাবি করেন, ‘বিরোধী নেতা-কর্মী শুধু নয়, সমর্থক ও ডোনারদেরও তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।’
এ বিষয়ে আদালতে যাবেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘ এখনো এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়নি। এখন দেশের মানুষকে আপনাদের মাধ্যমে জানাচ্ছি।”
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘‘বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি বাস্তবায়নে যারা অংশগ্রহণ করে বা অন্যান্যভাবে সাহায্য সহযোগিতা করে থাকে তারা আইনানুগভাবেই তা করে থাকে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের নাম ঠিকানা, মোবাইল নাম্বার, এমনকি এনআইডি নাম্বার আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্দেশ্য কি? এটা স্বাভাবিক।”
‘‘পুলিশ একটি রাষ্ট্রীয় বাহিনী, কোনো দলীয় বাহিনী নয়। সরকারিভাবে এসব তথ্য পুলিশের সংগ্রহ করার কথা নয়। এসব তথ্য নিয়ে পরবর্তিতে এসকল ব্যক্তির বিরুদ্ধে হামলা-মামলা দায়ের কিংবা অন্য কোনো ভাবে হয়রানি করাই এদের উদ্দেশ্য বলে আমরা মনে করি।”
‘যেসকল অতি উতসাহী দলবাজ কর্মকর্তা এখতিয়ার বহির্ভুতভাবে সরকারি পদবীর অপব্যবহার করে অত্যন্ত হীন ও নগ্নভাবে এসকল অবৈধ কর্মকান্ডের সাথে জড়িত দেশের সচেতন নাগরিকরা তাদের অবশ্যই চিহ্নিত করে রাখবে।’ বলেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘‘এটি দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে, বর্তমান সরকার আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে ব্যবহার করে চলমান গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে দমন করার জন্য রাজনৈতিক দমন-পীড়ন, অত্যাচার-নির্যাতনের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর আর্থিক মেরুদন্ডও ভেঙে দেয়ার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো গণআন্দোলন দমনের হীন উদ্দেশ্যে মানুষ হত্যার জন্য শান্তিপূর্ণ আইনসিদ্ধ গণতান্ত্রিক মিছিলে বিনা উস্কানিতে গুলি করে নেতা-কর্মীদের হত্যা করেছে।”
‘‘আমাদের দেশের সংবিধান(অনুচ্ছেদ ২৭.৩২,৩৭,৩৮,৩৯,৪১ ও ৪৪), প্রচলিত আইন ও আন্তর্জাতিক আইনেরও দেশের প্রতিটি মানুষের স্বাধীনভাবে রাজনীতি করা, মত প্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা স্বীকৃত। অসত রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এই ধরনের বেতার বার্তা বা অন্য প্রকারে তথ্য সংগ্রহ আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর এই ধরনের বেতার বার্তা বা অন্য প্রকারে তথ্য সংগ্রহ আইনের দৃষ্টিতে অকার্যকর, বেআইনি ও অসাংবিধানিক।”
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ও ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টে ও বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের ‘অনেক প্রসিদ্ধ মামলায় এ বিষয়ে সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত রয়েছে’ বলে জানান বিএনপি মহাসচিব।
তিনি বলেন, ‘‘পুলিশের বেতার বার্তাটি আমাদের কষ্টার্জিত সংবিধানের মৌলিক কাঠামোকে আঘাত করেছে যা রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক চরিত্র, আইনের শাসন, আইনানুগ সংস্থা ও সমাবেশ নিশ্চয়তা, জনগণের বাক ও মত স্বাধীনতা এবং আইন অনুযায়ী সমানভাবে আচরণ করার অধিকারের পরিপন্থি।”
‘‘শুধু তাই নয়, এটি দেশের রাজনৈতিক কর্মীদের সরকার পন্থি ও সরকার বিরোধী কর্মী হিসাবে বিভাজিত করে চরম বৈষম্য সৃষ্টি করবে। বিরোধী রাজনৈতিক মতবাদের লোকদের আলাদা করে চিহ্নিত করা, দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামোকে ধবংস করা ও সমাজে ভীতি ও ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করাই এই বেতার বার্তার উদ্দেশ্যে বলে আমরা মনে করি।”
রাষ্ট্রের বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক গুম-খুন-বিচারবর্হিভূত হত্যাসহ নানা ঘটনা তুলে ধরে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘‘বিএনপি মনে করে যে, এই সমস্ত নৃশংসতার পিছনে বর্তমান সরকারের ফ্যাসিবাদী শাসনেই মাস্টার মাইন্ড হিসেবে কাজ করছে।”
গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে সকাল সাড়ে ১১টায় এই সংবাদ সম্মেলন হয়।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নাল আবেদীন বলেন, ‘‘এই যে সার্কুলারটা দিয়েছে এটা সংবিধান বর্হিভূত কেনো? তার কারণ হলো যে, সভা-সমাবেশ এবং রাজনীতি করার অধিকার প্রতিটি নাগরিকের আছে।সরকারের বিরুদ্ধে যাতে কোনো রকম আন্দোলন না হয়, জনগণ যাতে রুখে দাঁড়াতে না পারে সেজন্য এই সার্কুলার জারি করা হয়েছে। এই সার্কুলার অত্যন্ত বেআইনি।”
‘‘এই ধরনের সার্কুলার পুলিশের আইনেও নাই, আমাদের সংবিধানেও নাই- কোত্থায়েও আপনি পাবেন না। অতীতে কোনো সরকারই স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত কোন এই ধরনের সার্কুলার পুলিশের মাধ্যমে ইস্যু করেন নাই।
সুপ্রিম কোর্টের সাবেক এটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট এজে মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘‘পুলিশের এই সার্কুলার অর্থাৎ বেতার বার্তায় তিনটা শব্দ দেখলে আপনারা বুঝতে পারবেন ওদের প্রচেষ্টাটা কী? অর্থ যোগান দাতা, জনবল সংগঠক সহযোগী-এর মানে বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীর ডাটাবেজ তৈরি করবে যেন কেউ বিরোধী দল করতে না পারে। এটাই হচ্ছে উদ্দেশ্য। হুইচ ইজ আমাদের ফান্ডামেন্টাল রাইটটা খর্ব করা হচ্ছে।”
‘‘এটা করার কারো অধিকার নেই। এসব করে জনগণকে ভীত সন্ত্রস্ত্র করা হচ্ছে। সংবিধান এটা এলাউ করে না।”
বিএনপির আইন বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, ‘‘এই সার্কুলার সংবিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন, প্রচলিত আইনের পরিপন্থি। মূলত এটা জারি করা হয়েছে অসত উদ্দেশ্য নিয়ে। রাষ্ট্রীয় পুলিশ বাহিনী কখনোই বিএনপি বা অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নাম উল্লেখ করে কোনো ধরনের সার্কুলার তারা দিতে পারে না।”
‘‘সম্পূর্ণ বেআইনি ও আইন বর্হিভুতভাবে তারা একাজ করছেন। এই থেকে প্রমাণিত হয় যে, এই রাষ্ট্রীয় বাহিনীসমূহ কোনো রাষ্ট্রের কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে না। বর্তমান অগণতান্ত্রিক শাসকগোষ্ঠি তথা এক ব্যক্তির নির্দেশে রাবার স্ট্যাম্প হিসেবে রাষ্ট্রয় পুলিশ বাহিনী কাজ করছে।”