জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশের গুম ঘটনার দ্রুত তদন্ত দাবি বিএনপির
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৯:৫৩ পিএম, ৩০ আগস্ট,মঙ্গলবার,২০২২ | আপডেট: ০৩:২৫ পিএম, ১০ অক্টোবর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশের গুম ঘটনার দ্রুত তদন্ত দাবি করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
আজ মঙ্গলবার দুপুরে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে এক মানববন্ধন কর্মসূচিতে তিনি এই দাবি জানান। আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণের যৌথ উদ্যোগে বেলা ১২টা থেকে এক ঘন্টার মানববন্ধন করে বিএনপির নেতা-কর্মীরা। এতে শতাধিক গুম পরিবারের সদস্যরা তাদের প্রিয়জনের ছবি নিয়ে মানববন্ধনে অংশ নেন। গুম হওয়া, বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড, রাজনৈতিক নিপীড়ন বন্ধের দাবি জানিয়ে নেতা-কর্মীরা বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড বহন করে। মানববন্ধন কর্মসূচির অনুষ্ঠানস্থলে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার নিহতদের দৃশ্য নেতা-কর্মীরা অভিনয় করে প্রদর্শন করে যা নেতা-কর্মীদের দৃষ্টি কাড়ে। ফকিরেরপুল থেকে কাকরাইলে নাইটেঙ্গল মোড় পর্যন্ত রাস্তায় একপাশে হাজার হাজার নেতা-কর্মী সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে গুমের বিরুদ্ধে তাদের প্রতিবাদ জানায়।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক কমিশনের প্রধান (হাইকমিশনার মিশেল ব্যাসেলেট) কিছুদিন আগে এখানে এসেছিলেন, তিনি পরিষ্কার ভাষায় বলে গেছেন বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে, গুমের অভিযোগ আছে, তার সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া উচিত। আমরাও আজকে এই গুম দিবসে গুম পরিবারের সাথে একাত্ম হয়ে দাবি করছি, ঘোষণা করছি যে, আপনারা (সরকার) এখানে জাতিসংঘের অধীনে অবিলম্বে স্বাধীন নিরপেক্ষ তদন্ত হতে হবে। অন্যথায় ওই সমস্ত সরকার প্রধান যারা অতীতে গুম করেছে তাদের যেভাবে বিচারের আওতায় আনা হয়েছে আপনাদেরকেও সেভাবে বিচারের আওতায় আনা হবে।
তিনি বলেন, আজকে গুম হওয়া পরিবার যারা এসেছে এখানে তাদের প্রতি আন্তরিক সহমর্মিতা প্রকাশ করছি। একটা কথা পরিষ্কার করে বলতে চাই, তোমরা একা নও, তোমাদের সঙ্গে সারা বাংলাদেশের মানুষ আছে, তোমাদের জন্য সারা বাংলাদেশের মানুষ লড়াই করবে। আজকে আমাদের এই সন্তানদের (গুম হওয়া পরিবার) এদের মুখে হাসি ফুটানোর জন্য, তাদের বাবাকে, তাদের ভাইকে, তাদের ছেলেকে ফিরিয়ে আনার জন্য আমাদেরকে আরো বেশি ত্যাগ স্বীকার করতে হবে, আমাদেরকে দুর্বার গণআন্দোলন গড়ে তুলতে হবে মানুষকে সঙ্গে নিয়ে।
লাঠিয়াল বাহিনীতে কাজ হবে না বলে জানিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, এখনই ভয় পেয়ে গেছে। আমাদের যে আন্দোলন হচ্ছে সারা দেশে, এতেই কিন্তু এখনই ভয় পেয়ে গেছে। আবার সেই লাঠিয়াল বাহিনী নামিয়ে দিয়েছে। কোনো লাঠিয়াল বাহিনীতে কাজ হবে না। মানুষ জেগে উঠেছে। আমরা আহ্বান জানাচ্ছি তরুণ-যুবকদেরকে সবাই এগিয়ে আসুন দেশকে রক্ষা করবার জন্য, আমার এই শিশুর বাবাকে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য, ভাইদেরকে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য। আসুন আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে এমন আন্দোলন গড়ে তুলি, যে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এই ভয়াবহ, এই দুঃশাসন, ফ্যাসিবাদ সরকারের পতন ঘটিয়ে সত্যিকার অর্থে একটা গণতান্ত্রিক সরকার, মানবতার সরকার, জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করব।
সরকার ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে বলে অভিযোগ করে মির্জা ফখরুল বলেন, কিছুক্ষণ আগে গজারিয়াতে আমাদের বিএনপির নেতা-কর্মীরা এই গুম দিবসের অনুষ্ঠান করছিলো। সেখানেও পুলিশ তাদের ওপর আক্রমণ করেছে। সারা দেশে তারা একটা ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করেছে। ভয় দেখিয়ে, গুম করে, খুন করে এরা রাষ্ট্র চালাচ্ছে।
মির্জা ফখরুল বলেন, আপনারা দেখেছেন এদের মিথ্যাচার। এতো মিথ্যাচার করে যে, এতো গোয়েবলসীয় কায়দায় মিথ্যাচার করে যে, ওদের একটি বিশেষ নোবেল পুরস্কার দিতে হবে মিথ্যাচারের জন্য। এখানে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের যিনি প্রধান তিনি কিছুদিন আগে এসেছিলেন। তিনি সকলের সঙ্গে কথা বলেছেন। কথা বলার পরে তিনি মন্ত্রীদের সঙ্গেও কথা বলেছেন। মন্ত্রীদের বলেছেন যে, এখানে মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে, প্রতিটি ইস্যু নিয়ে কথা বলেছেন এবং সেগুলোকে তিনি এডড্রেস করতে বলেছেন। র্যাব যে মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে সে বিষয়ে তিনি কথা বলেছেন। পরে জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনার একটা প্রেস কনফারেন্স করেছেন। সেখানে তিনি বলেছেন যে, বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে, এখানে গুম হচ্ছে, গুমের অভিযোগ আছে। সব শেষে তিনি বলেছেন যে, বাংলাদেশের সেনাবাহিনী তারা জাতিসংঘের শান্তি মিশনের কাজ করে। এই শান্তি মিশনের কাজ করা কোনো কর্মকর্তা মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে জড়িত আছে কিনা তা দেখাও কিন্তু কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব। এই ইংগিত করে এই কথাগুলো সাধারণ কথা নয়।
তিনি বলেন, এই সরকারের যে অহেতুক যে ঔদ্ধত্য যেটা প্রকাশ করার জন্য তারা কি করেছে? অভিযুক্ত একজন পুলিশ অফিসার জাতিকে অপমান করে তিনদিনে একটা ভিসা নিয়ে জাতিসংঘের প্রোগ্রামে গেছে এবং এটা প্রচার করছে কি? জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের প্রধান বাংলাদেশের মানবাধিকার বিষয়ে কোনো কথাই বলেননি। ডাহা মিথ্যা কথা। আপনারা জনগণকে প্রতারণা করছেন। অবশ্যই জাতিসংঘের যে প্রধান এখানে এসেছিলেন তিনি পরিষ্কার ভাষায় বলে গেছেন যে, বাংলাদেশের মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে, গুমের অভিযোগ আছে, তার সুষ্ঠু নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া উচিত।
বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশে কোনো সময় গুম দিবস পালন করতে হবে এই দেশের মানুষের কল্পনার বাইরে ছিলো। এরকম একটি স্বাধীনতাকামী মুক্তিকামী স্বাধীন দেশে এতো গুম পরিবারের সদস্য এখানে উপস্থিত হয়ে জনগণের সম্মুখে বক্তব্য দিতে হবে- এটা অবিশ্বাস্য। এই গুমের পেছনে যারা জড়িত আছে তারা চিহ্নিত হয়েছেন, তারা দেশে চিহ্নিত হয়েছেন, বিদেশে চিহ্নিত হয়েছেন। আপনাদের এই গুমের কারণে বাংলাদেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। র্যাবের ওপর এবং র্যাবের প্রাক্তন ও বর্তমান ৬ জন কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। আপনারা দেশকে বিদেশের সামনে ছোট করেছেন।
তিনি বলেন, আজকে গুম হওয়া পরিবারের কান্না আমরা শুনেছি। এই কান্না কোনো দিন থামবে না যতদিন এই দখলদার সরকারের পতন ঘটাতে আমরা না পারি। আমি একটা কথা বলতে চাই, যারা গুম ঘটনার সাথে জড়িত তারা কেউ রেহাই পাবেন না। আপনাদের বিচার বাংলাদেশের মাটিতে হবে, আপনাদের বিচার বিশ্বের আদালতে হবে।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, দেশের প্রত্যেকটি গুমের সাথে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জড়িত। প্রত্যাকটি গুমের পেছনে আওয়ামী লীগ সরকার দায়ী। এখন তাদের মুখ থেকেই এ কথা বেরিয়ে আসছে। আজকের এই দিবসটি আন্তর্জাতিক গুম দিবস। সারা বিশ্বে এই দিবসটি পালিত হচ্ছে। সারা বিশ্বের গণতন্ত্রকামী মানুষ এই দিবসটি পালন করছে। বিভিন্ন দেশের স্বৈরাচার দানবীয় সরকারের বিরুদ্ধে যারা রাষ্ট্রকে এবং বিরোধী পক্ষকে নির্মূল করার জন্য এই গুমের মত কর্মসূচি নিয়েছে তাদের বিরুদ্ধেই আজকের এই দিবস। গুম এবং বিচারবহির্ভূত হত্যা মানবতার সবচেয়ে ভয়াবহতম অপরাধ। এই অপরাধ করেছেন শেখ হাসিনা। এই অপরাধ করেছেন আওয়ামী লীগ সরকার। আজকে ইলিয়াস আলী কেন হারিয়ে যাবে? চৌধুরী আলম কেন হারিয়ে যাবে? এটা তো পারিবারিক কোনো বিরোধ নয়। সাইফুল ইসলাম হিরু, সুমন, জাকির কেন হারিয়ে যাবে, বিএনপি সরকারের সাবেক একজন মন্ত্রী যিনি বারবার এমপি হয়েছেন তাকে বিদেশে গুম করা হয়েছে। এর সঙ্গে শেখ হাসিনা জড়িত। এটার সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকার জড়িত। না হলে এ পর্যায়ে নেতৃবৃন্দ গুম হবে কেনো।
তিনি বলেন, কয়দিন আগে একজন মন্ত্রী বলেছেন, মাঝ সমুদ্রে অনেকে জাহাজ ডুবিতে মারা গেছে। সলিল সমাধি হয়েছে। এটা কিন্তু সত্যি কথা বলেছেন। গুয়াতেমালা, আর্জেন্টিনা, চিলিতে সামরিক লোকেরা তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে গুম করার জন্য বিমানে করে নিয়ে ওইসব নেতাদের আটলান্টিকের মাঝে ফেলে দিতো। এটার সঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য মিলে যায়। আপনারা আমাদের নেতাদের কোথায় ফেলেছেন,...ভারত মহাসাগরে ফেলেছেন। এইটা এখন খোলাসা করে বলুন। এই যে আয়নাঘরের কথা। এটাও স্বীকার করেছে এই আওয়ামী লীগের একজন প্রধান নেতা। তার নাম হানিফ।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব বলেন, ১/১১ সরকার হলো বিএনপি-জামায়াত সরকার। অথচ শেখ হাসিনা নিজেই বলেছেন, আমাদের আন্দোলনের ফসল ফখরুদ্দিন-মইন উদ্দিন সরকার। এই হানিফ সাহেব বলেছেন, ১/১১ সরকারের সময় আয়নাঘর করা হয়েছে। তার মানে এই আয়নাঘর আপনারা করেছেন। এখানে বিএনপিসহ অসংখ্য মানুষকে যে নিপীড়ন, নির্যাতন করা হয়েছে এটি আওয়ামী লীগ জানে এবং তাদের পরামর্শে করা হয়েছে।
ঢাকা মহানগর উত্তরের সদস্য সচিব আমিনুল হক ও দক্ষিণের সদস্য সচিব রফিকুল আলম মজনুর পরিচালনায় মানববন্ধনে আরো বক্তব্য রাখেন বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান, ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমান উল্লাহ আমান, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক আবদুস সালাম, বিএনপির মানবাধিকার বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আসাদুজ্জামান আসাদ, গুম হওয়া ছাত্রদলের সাইফুর রহমান সজীবের বাবা শফিকুর রহমান, পারভেজ রেজার মেয়ে হৃদি, সেলিম রেজার পিন্টুর বোন নদী, সোহেলের মেয়ে সাফা, সাজেদুল ইসলাম সমুনের বোন সানজিদা ইসলাম তুলি প্রমুখ।
এছাড়াও বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবুল খায়ের ভূইয়া, বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুস সালাম আজাদ, প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী, সাবেক সংসদ সদস্য নাজিম উদ্দিন আলম, বিএনপির স্বনির্ভর বিষয়ক সম্পাদক শিরিন সুলতানা, স্বেচ্ছাসেবক বিষয়ক সম্পাদক মীর সরফত আলী সপু, সহ-প্রচার সম্পাদক শামীমুর রহমান শামীম, আমিরুল ইসলাম খান আলিমসহ স্থানীয় সরকার বিষয়ক সম্পাদক সাম্মী আক্তার, নির্বাহী কমিটির সদস্য আ ক ম মোজ্জামেল হক, বিলকিস ইসলাম, হায়দার আলী লেলিন, তাবিথ আউয়াল, আব্দুস সাত্তার পাটোয়ারী, মুন্সিগঞ্জ জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কামরুজ্জামান রতন, যুবদলের সাবেক সভাপতি সাইফুল আলম নিরব, যুবদলের সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, যুবদলের সাবেক সহ-সভাপতি এসএম জাহাঙ্গীর হোসেন, স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক আবদুল কাদের ভূঁইয়া জুয়েল, সহ-সভাপতি গোলাম সারোয়ার, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম ফিরোজ, সাদরাজ্জামান, সাংগঠনিক সম্পাদক ইয়াসিন আলী, সহ-সাধারণ সম্পাদক সর্দার নুরুজ্জামান, সৈয়দ শহিদুল ইসলাম, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মজিবুর রহমান, জাসাসের সদস্য সচিব জাকির হোসেন রোকন, মহিলা দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হেলেন জেরিন খান, ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক সাইফ মাহমুদ জুয়েলসহ হাজার হাজার বিএনপি ও অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।