লাকসাম কি সন্ত্রাসের জনপদে পরিণত? এই বিভৎস নির্মমতার শেষ কোথায়?
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৪:২২ পিএম, ২৭ আগস্ট,শনিবার,২০২২ | আপডেট: ০১:২৭ পিএম, ১৪ নভেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
২২ আগষ্ট থেকে বিভিন্ন দাবী নিয়ে ধারাবাহিক ভাবে বিএনপির কেন্দ্রঘোষিত বিক্ষোভ কর্মসুচীকে কেন্দ্র করে লাকসামে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে সরকারীদলের সসস্ত্র ক্যাডাররা। যদিও লাকসামের কোথাও দলের এই কর্মসুচী পালনে কোনরকম প্রস্তুতি বা তোড়জোড় নেই।
এখানকার বিএনপির স্থানীয় শীর্ষ নেতারা যেখানে দলের কেন্দ্রঘোষিত ধারাবাহিক বিক্ষোভ কর্মসুচী পালন করতে ব্যস্ত থাকার কথা, সেখানে গত ২২ আগষ্ট থেকে তারা ধারাবাহিক ভাবে ব্যস্ত রয়েছেন শাসকদল কতৃক বিএনপির স্থানীয় নিরীহ নেতাকর্মী এবং তাদের বাড়ীঘরের উপর অতর্কিত ধারাবাহিক হামলা এবং মারধরে গুরুতর আহত নেতাকর্মীদের চিকিৎসা নিয়ে।
স্থানীয় বিএনপি ও নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক লাকসামের সাধারণ জনগণ সুত্রে জানা যায়, গত ২২ আগষ্ট সোমবার থেকে প্রতিদিনই লাকসাম পৌর এলাকার আনাচে কানাচে সরকারীদল সমর্থিত সশস্র ক্যাডারদের হাতে স্থানীয় বিএনপি ও অঙ্গসংগঠন সমুহের নিরীহ নেতাকর্মীদের মারধর, হুমকি ধামকি সহ নানান নির্যাতন নিপীড়ন করা হচ্ছে।
লাকসাম পৌর এলাকায় বিএনপি নেতাকর্মীদের যাকে যেখানে যেখানে পাচ্ছে সেখানেই দেশীয় অস্ত্রসস্ত্র বিশেষ করে জয়েন্টপাইপ, রড, চাইনিজ কুড়াল নিয়ে সরকারদলীয়রা হামলা করছে। অনেকের বাড়ীঘর ভাংচুর করছে। এসব হামলায় বিএনপি সমর্থিত নেতাকর্মীদের পরিবারের নারী সদস্যরা সহ তাদের ছেলে মেয়েরাও রেহাই পাচ্ছে না। বিএনপি নেতাকর্মী কাউকে রাস্তায় পেলে সরকারদলীয়রা হামলার শুরুটা করে প্রথমে তাদের (বিএনপি নেতাকর্মীদের) পকেট হাতিয়ে। শুরুতেই তাদের পকেট থেকে মোবাইল এবং টাকা পয়সা হাতিয়ে নেয়।
পরে জয়েন্ট পাইপ দিয়ে পিটিয়ে রাস্তায় ফেলে চলে যায়। অনেক বিএনপি নেতাকর্মীদের বাড়ীর সামনে হেলমেট পরে মোটর সাইকেল নিয়ে মোহড়া দিচ্ছে সরকারদলীয় ক্যাডাররা। এসব ক্যাডাররা আবার সামজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিশেষ করে ফেসবুকে নিজেদের আইডি থেকে লাকসাম পৌর এলাকার বিভিন্ন স্থানে নিজেদের অবস্থানের ছবি দিয়ে নানান কায়দায় হুমকি ধামকি দিয়ে ষ্টাটাস দিচ্ছে।
পাঠকদের উদ্যেশ্যে এখানে শাসকদল সমর্থিত একজনের এমনই একটি ফেসবুক ষ্টাটাস তুলে ধরা হল, "বাংলাদেশের কথায় কি হয়ছে সেটা আমাদের দেখার বিষয় না,লাকসামের মানুষ কিভাবে শান্তিতে থাকবে সে লক্ষ্যে মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়ের হাতকে শক্তিশালী করার জন্য ভাইস চেয়ারম্যান মহোদয়ের নির্দেশে ছাত্রলীগ,আওয়ামিলীগ, সেচ্ছাসেবকলীগ,যুবলীগ সর্বদা রাজপথে সচ্ছার থাকবে,জামায়াত শিবির, বিএনপি কোনো সরকার বিরোধী কাজ সৃষ্টি করলে তাদের বিরুদ্ধে সব সময় মাঠে থাকবে,ছাত্রলীগ,যুবলীগ ও সেচ্ছাসেবক লীগ। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু,জয় হোক মাননীয় মন্ত্রী মহোদয় এর।"
২২ তারিখ থেকে এ পর্যন্ত লাকসামের আওয়ামী সন্ত্রাসীদের নারকীয় তান্ডবে প্রায় ১৫/২০ জন বিএনপি নেতাকর্মী গুরুতর আহত হয়েছে। অনেকে আবার হামলার শিকার হয়েও পরবর্তীতে আবারও হামলার শিকার হওয়া, বাড়ীঘর ভাংচুর বা তাদের পরিবারের নিরাপত্তার আশঙ্কায় ভয়ে মুখ খুলছেন না।
সরকারদলীয়রা অনেক বিএনপি নেতাকর্মী এবং তাদের বাড়ীঘরে হামলা করে তাদেরকে আবার শাসিয়ে দিচ্ছে "এই ব্যাপারে মুখ খুলবি না, তোদের কোন নেতাদের কাছে যেতে পারবি না, ফেসবুকে এসব নিয়ে তোদের কর্মসুচি বা নেতাদের নিয়ে কোন লেখালেখি করতে পারবি না। করলে পরিনতি আরও ভয়াবহ হবে"
গত ২২ তারিখ পরবর্তী সময় থেকে সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের এমন নারকীয় তান্ডব থেকে রেহাই পাচ্ছে না বিএনপি নেতাকর্মীদের স্বাভাবিকভাবে মৃত স্বজনদের জানাযায় আগত দলীয় নেতাকর্মী বা তাদের আত্বীয় স্বজনরাও। শাসকদলের ধারাবাহিক এমন নারকীয় তান্ডবে লাকসামের দলনিরপেক্ষ আমজনতাও আতঙ্কিত। ভয়ে বিএনপি নেতাকর্মীরা সহ অনেকে সাধারণ মানুষ ঘর থেকেও বের হচ্ছেন না। আবার ঘরে থেকেও অনেকে আতঙ্কে আছেন, কখন আবার ঘরবাড়ীতে এসে হামলা করে তারা।
গত কয়েকদিনে সবকিছু মিলিয়ে বিএনপি নেতাকর্মী সহ লাকসামবাসীর প্রতিটি মুহুর্ত কাটছে আতঙ্কিত অবস্থায় উদ্বেগ আর উৎকন্ঠায়। এসব নারকীয় তান্ডব দেখে অনেক সাধারণ মানুষ প্রকাশ্যে প্রশ্ন তুলছেন "লাকসাম কি সন্ত্রাসের জনপদে পরিনত? এমন বিভৎস নির্মমতার শেষ কোথায়?
সাম্প্রতিক সময়ে সরকারী দলের এসব নারকীয় তান্ডব নিয়ে লাকসাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার বক্তব্য নিয়ে গতকাল "দৈনিক দিনকাল" অনলাইনভার্সনে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে।
সেখানে ওসি লাকসাম বলেছেন "তিনি এসবের কিছু জানেন না, তার কাছে এসব বিষয়ে কেউ লিখিত বা মৌখিক অভিযোগ করেননি। এটুক বলে লাকসাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা দায়সারার চেষ্টা করছেন। যদিও সংবিধান অনুযায়ী দেশের সকল শ্রেনী পেশার মানুষের নিরাপত্তা দেয়ার কথা মাঠপর্যায়ে কর্মরত পুলিশ প্রশাসনেরই।
শুধু গত ২২ আগষ্ট থেকে বিএনপির ধারাবাহিক কর্মমুচীকে কেন্দ্র করেই নয়, গত প্রায় কয়েকবছর লাকসামের বিএনপি নেতাকর্মীদের এমন নির্যাতন নিপীড়ন করে আসছে শাসকদলের স্থানীয় নেতাকর্মীরা। গত কয়েকবছর লাকসামের বিএনপি নেতাকর্মীরা কেউ ঘরোয়া পরিবেশেও কোন সভাসমাবেশ করতে পারেনি। স্বাভাবিক অবস্থায়ও লাকসামের হোটেল রেঁস্তোরায় ২/৪ জন বিএনপি নেতাকর্মীরা একত্রিত হয়ে চাও খেতে পারে না।
বিএনপির কোন কর্মসুচি থাকলে ওইদিন শাসকদলের ক্যাডাররা হেলমেট পড়ে মোটর সাইকেলে মোহড়া দিয়ে বিএনপি নেতাকর্মীদের বাড়ীর সামনে গিয়ে দলটির জাতীয় পর্যায়ের শীর্ষ নেতাদের নিয়ে আজেবাজে শ্লোগান দেয়। আগামী জাতীয় নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে বিএনপি অধ্যুষিত এলাকা হিসাবে খ্যাত লাকসামে শাসকদলের নারকীয় তান্ডব ততই বেড়ে চলছে।
লাকসামের বিএনপিকে দমিয়ে রাখার জন্য লাকসামে শাসকদলের একটি বিশেষ হেলমেট বা মুখোশধারী বাহিনী রয়েছে। একাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচনে এই হেলমেট বা মুখোশধারী বাহিনীর দৌরাত্বে বিএনপি মনোনিত প্রার্থী ঘর থেকেও বের হতে পারেননি। ওই সময়ে স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মীরা প্রায় সকলেই পরিবার পরিজন বাড়ীতে রেখে লাকসামের বাহিরে গিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করেছেন। শাসকদলের এমন পৈশাচিক কর্মকান্ডে লাকসামের বিএনপি নেতাকর্মীরা স্থানীয় পর্যায়ের কোন নির্বাচনেও অংশ নিতে পারেনি গত কয়েকবছর।
এখানে প্রকাশিত মাথায় চাইনিজ কুড়ালের কোপে প্রচন্ড জখম হওয়া ছবির লোকটির নাম শাহিন মোল্লা। তিনি লাকসাম উপজেলাধীন উত্তরদা ইউনিয়ন শ্রমিকদলের সাধারণ সম্পাদক। বিভৎস এই নির্মমতার অভিযোগ সম্পর্কে দলীয় সুত্রে জানা যায়, গতকাল শুক্রবার তিনি জুমার নামাজ শেষে লাকসাম-নোয়াখালী আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশে কৃষ্ণপুর নামক স্থানে মহাসড়ক থেকে পশ্চিম দিকের রাস্তা দিয়ে একটি দাওয়াতে যাওয়ার পথে শাসকদলের স্থানীয় ক্যাডারদল কতৃক হামলার শিকার হন।
শাহিন মোল্লাকে প্রথমে জয়েন্টপাইপ দিয়ে পিটানো হয়। হামলাকারীদের একের পর এক আঘাতে সে একপর্যায়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। এরপর শাহিন মোল্লার মাথায় চাইনিজ কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে তাকে মারাত্বক জখম করে রাস্তার উপর ফেলে যায় সরকারদলীয় স্থানীয় ক্যাডারা। আশঙ্কাজনক অবস্থায় শাহিন মোল্লা এখন কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
শ্রমিকদল নেতা শাহিন মোল্লার উপর এমন নির্মম হামলার বিষয়ে সেলফোনের মাধ্যমে লাকসাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কাছে জানতে চাইলে তিনি গতকালকের মতই বলেন, "তিনি এসব কিছুই জানেন না। এসব বিষয়ে এখনো পর্যন্ত কেউ লিখিত অভিযোগ করেননি। অভিযোগ পেলে আমি ব্যবস্থা নেবো"।