মফস্বলে ঘণ্টায় ঘণ্টায় লোডশেডিং
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১০:৩০ পিএম, ২৫ জুলাই,সোমবার,২০২২ | আপডেট: ০১:২৫ এএম, ১৬ নভেম্বর,শনিবার,২০২৪
দেশব্যাপী এলাকাভিত্তিক এক অথবা দুই ঘণ্টা লোডশেডিংয়ের কথা বলা হলেও মফস্বলে শিডিউল মেনে তা করা হচ্ছে না। এখন মফস্বলে লোডশেডিং হচ্ছে ঘণ্টায় ঘণ্টায়। ফলে নাগরিকরা এক রকম অবহেলিত জীবনযাপন করছেন। শুধু রাজধানীতে শিডিউল মেনে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে। অবশিষ্ট অধিকাংশ জেলা শহরে প্রতি ঘণ্টায় লোডশেডিং দেয়া হচ্ছে, যা নাগরিকদের বিশিয়ে তুলেছে। রাজধানীর পার্শ্ববর্তী জেলা গাজীপুর, মানিকগঞ্জ এবং সিলেট, রংপুরসহ আরও অনেক জেলায় ভয়াবহ লোডশেডিং চলছে। বিশেষ করে পর্যাপ্ত সরবরাহ না থাকায় সিলেটের অবস্থা বেশ ভয়াবহ। সেখানে কোনো কোনো স্থানে ১০ থেকে ১২ ঘণ্টাও বিদ্যুৎ থাকছে না। এবার সিলেটে ১৩ ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিং ধরে নতুন সূচি প্রকাশ করেছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড। এতে দিনের বেশিরভাগ সময় লোডশেডিং থাকবে সিলেটে। এদিকে মাত্রাতিরিক্ত লোডশেডিংয়ে সিলেটের বাসিন্দাদের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ সৃষ্টি হচ্ছে। বিদ্যুতের ওপর নির্ভরশীল ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানও ব্যাপকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। দিনকালের প্রতিনিধিদের প্রেরিত প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে-
বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে সংকট মোকাবিলায় গত ১৯ জুলাই থেকে সারাদেশে এলাকাভিত্তিক ১ থেকে ২ ঘণ্টার শিডিউল করে লোডশেডিংয়ের নির্দেশনা দেয় সরকার। তবে শুরু থেকেই সিলেট বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) আওতাধীন এলাকায় দৈনিক অন্তত ৩ ঘণ্টা এবং পরবর্তীতে দৈনিক ৭ থেকে ৮ ঘণ্টাও লোডশেডিং হচ্ছে। অথচ শিডিউলে ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা করে লোডশেডিংয়ের কথা প্রকাশ করছে পিডিবি।
এরই মধ্যে গত বুধবার পিডিবি ২-এর আওতাধীন এলাকায় গতকাল সোমবারের জন্য ১৩ ঘণ্টা করে লোডশেডিংয়ের একটি সূচি প্রকাশ করে। অবশ্য পরবর্তীতে এ সূচি পরিবর্তিত করে আগের মতো সূচি প্রকাশ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন পিডিবির প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ আবদুল কাদির। তিনি দাবি করেন, দেশের অন্যান্য বিভাগীয় শহরের তুলনায় অন্তত ১০ শতাংশ কম বিদ্যুৎ সরবরাহ পাওয়ায় সিলেটে মাত্রাতিরিক্ত লোডশেডিং করতে হচ্ছে।
নগরীর বালুচর এলাকার বাসিন্দা আনোয়ার চৌধুরী বলেন, ‘প্রতিদিন ১ ঘণ্টা করে লোডশেডিংয়ের কথা থাকলেও ৪-৫ ঘণ্টা বা কখনো আরও বেশি লোডশেডিং হচ্ছে। শিডিউলে যে সময় দেয়া হচ্ছে তার বাইরেও অনেক সময় বিদ্যুৎ থাকছে না। এই অব্যবস্থাপনার মানে কী? এভাবে কতদিন চলবে?’
পিডিবির প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ আবদুল কাদির বলেন, ‘বিভাগীয় শহর হিসেবে আমরা লোড কম পাচ্ছি। আজ সোমবার বরাদ্দ পেয়েছি ৯৩ মেগাওয়াট, যেখানে চাহিদা ১৭৫ মেগাওয়াট। গত রবিবার একই চাহিদার বিপরীতে পেয়েছিলাম ৭৮ মেগাওয়াট। এই লোড দিয়ে সরবরাহ সামলাতে পারছি না, এতে জনঅসন্তোষ সৃষ্টি হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘সিলেট ছাড়া সব বিভাগীয় শহর অন্তত ৬০ শতাংশ বিদ্যুৎ পাচ্ছে। যেহেতু কোনো বিভাগীয় শহরই এর বেশি পাচ্ছে না, তাই সিলেটও অন্তত ৬০ শতাংশ বিদ্যুৎ সরবরাহ দেয়া উচিত। সবার সমান হলে জনঅসন্তোষ থাকবে না। কিন্তু এখন যে বরাদ্দ পাচ্ছি, তা দিয়ে শিডিউল করলেও তা মেনে চলা সম্ভব হচ্ছে না। অতিরিক্ত লোডশেডিং করতে হচ্ছে।’
সিলেট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি তাহমিন আহমেদ বলেন, ‘সিলেট বিদ্যুৎ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার পরও অব্যবস্থাপনার কারণে বিগত কয়েক বছর ধরে অসময়ে দীর্ঘ লোডশেডিং হচ্ছে। এখন সরকারি নির্দেশনা মোতাবেক লোডশেডিংয়েও এই অব্যবস্থাপনা প্রকট হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘অতিরিক্ত ও শিডিউল ভেঙে লোডশেডিংয়ের কারণে সাধারণ মানুষ যেমন ভোগান্তিতে আছেন, তেমনি ব্যবসায়ীরাও কষ্টে আছেন। একদিকে রাত ৮টায় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের নির্দেশনা, তার ওপর অনিয়মিত লোডশেডিংয়ে অনেক যন্ত্রপাতি নষ্ট হচ্ছে, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।’
চেম্বার সভাপতি আরও বলেন, ‘সরকার জ্বালানি সাশ্রয় করতে চাচ্ছে, অথচ বাস্তবে জ্বালানি খরচ আরও বাড়ছে। লোডশেডিংয়ের সময় জেনারেটর ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া আইপিএসের ব্যবহার বাড়ায় বিদ্যুতের ওপরও চাপ বাড়ছে। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে একটা সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সমাধান করতে হবে।’
সুশাসনের জন্য নাগরিক- সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘শিডিউল বিপর্যয়ে ভোগান্তি বাড়ছে। সাধারণ মানুষের ব্যবহার্য ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি নষ্ট হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা সাম্প্রতিক বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এখন লোডশেডিংয়ের কারণে হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘শুধু দেখানোর জন্য শিডিউল প্রস্তুত ও প্রচার করলে হবে না, তা মেনেও চলতে হবে। এছাড়া দেশের অন্যান্য বিভাগীয় শহর যতটুকু বিদ্যুৎ সরবরাহ পাচ্ছে, সিলেটের জন্যও তা দিতে হবে। এক্ষেত্রে সমতা বণ্টন নিশ্চিত করার অনুরোধ সরকারের কাছে।’
রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার একটি গ্রাম প্রামাণিকপাড়া। এখানে গত রবিবার সকাল ১০টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত ১২ ঘন্টায় ৫ ঘণ্টা লোডশেডিং হয়েছে। গ্রামের অন্তত ২০ জন ও ইকরচালী পল্লী বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রের দুজন লাইনম্যানের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সকাল সাড়ে ১০টা থেকে দুপুর ১২টা ৫ মিনিট পর্যন্ত ১ ঘণ্টা ৩৫ মিনিট, বেলা ৩টা ৩০ মিনিট থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত আড়াই ঘণ্টা, রাত ৮টা থেকে ৯টা পর্যন্ত ১ ঘণ্টাসহ ১২ ঘন্টায় ৫ ঘণ্টা ৫ মিনিট লোডশেডিং হয়েছে। চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে মোটামুটি এভাবেই চলছে।
তারাগঞ্জ পল্লী বিদ্যুতের জোনাল অফিসের সহকারী জেনারেল ম্যানেজার মো. সামসুজ্জামান সোমবার মুঠোফোনে বলেন, ‘লোডশেডিং না দিয়ে করব কী? মেইন গ্রিড থেকে ১৬ মেগাওয়াট বিদ্যুতের বিপরীতে ৫ দশমিক ৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বরাদ্দ দিচ্ছে। এই বিদ্যুৎ দিয়ে ছয়টি ফিডার ভাগ করে চালানো হচ্ছে। তাই সারা দেশের মতো তারাগঞ্জেও লোডশেডিং চলছে।’
২০১৭ সালে রংপুরের তারাগঞ্জের প্রতিটি ঘরে শতভাগ বিদ্যুৎ নিশ্চিত করা হয়। কিন্তু চলতি মাসের শুরু থেকে সারা দেশের মতো ব্যাপক লোডশেডিং চলছে তারাগঞ্জেও। প্রতিদিন এক ঘণ্টা লোডশেডিংয়ের শিডিউল থাকলেও সারা দিনে গ্রাহকরা ৯-১০ ঘণ্টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ। দাবদাহে নাকাল মানুষ বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন।
রংপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি ২-এর তারাগঞ্জ জোনাল অফিস সূত্রে জানা গেছে, তারাগঞ্জ জোনাল অফিসের আওতায় মোট গ্রাহক সংখ্যা ৭৯ হাজার ২৫০ জন। এতে বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে ১৯ মেগাওয়াট। কিন্তু ৫ দশমিক ৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
প্রামাণিকপাড়া গ্রামের পাশে গড়ে উঠেছে ওকড়াবাড়ির হাট। সকালে হাটে কথা হয় মুদি দোকানি সাকাদুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘একে তো রাইত আটটার পর দোকান বন্ধ। তার ওপর সারা দিন কারেন্ট নাই। গরমে ব্যবসা করিবার পাওছি না। বিল তো হামরা ঠিকই দেই। কিন্তু কারেন্ট ঠিকমতো পাই না কেনে? ব্যবসা না হইলে চলমো কেমন করি!’
গ্রামের কয়েকজন তরুণের সঙ্গে প্রামাণিকপাড়া মোড়ে গল্প করছিলেন ওই গ্রামের ৮০ বছরের বৃদ্ধ কপিল উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘এলাকার মানুষ হওচে ব্রয়লার মুরগির মতন। কারেন্ট ছাড়া নড়াচড়া কইরার পায় না। ছাওয়া-পোয়াগুলা কারেন্ট ছাড়া লেখাপড়াও করে না। কারেন্ট গেইলে যে যন্ত্রণা হয়, তাক তোমাক বুঝবার পাইম না।’
ওই গ্রামের তরুণ উদ্যোক্তা হাসু সরকার বলেন, ‘এ গ্রামে ১০-১২টি খামার গড়ে উঠেছে। বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে এবার প্রত্যেক মুরগির খামারিকে লোকসান গুনতে হচ্ছে। অনেক খামারি এখনো মুরগি উৎপাদন করার সহস পাচ্ছেন না। অধিকাংশ খামার বন্ধ হয়ে গেছে। এবার বিদ্যুতের যাওয়া-আসা খেলায় আমার লাখ টাকা লোকসান হয়েছে খামারে।’
ইকরচালী উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক রমজান আলী বলেন, ‘এখন শ্রাবণ মাস। বৃষ্টি হওয়ার কথা। উল্টো প্রখর দাবদাহ চলছে। গরমে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের হাঁসফাঁস অবস্থা। বিদ্যুৎ থাকলে অন্তত ফ্যানের বাতাসে একটু স্বস্তিতে পাঠ কার্যক্রম চলতে পারে।’
ভোলার দৌলতখান উপজেলার মদনপুর ইউনিয়নে দীর্ঘ দুই মাস ধরে বিদ্যুৎ নেই। এতে মদনপুর ইউনিয়নের চরাঞ্চলের বিদ্যুতের ৫ শতাধিক গ্রাহক তীব্র গরম ও চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন।
মেঘনা নদীর মধ্য দিয়ে নেয়া সাবমেরিন কেবেলে ত্রুটি দেখা দেয়ায় এই বিদ্যুৎ বিভ্রাট দেখা দিয়েছে। বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীদের অভিযোগ, জুন-জুলাই দুই মাস উপজেলার মদনপুর চরে বিদ্যুৎ নেই। এছাড়া বাতাস বা বৃষ্টি হলে দীর্ঘ সময় ধরে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায় এ চরে। টানা দুই মাস বিদ্যুৎ বন্ধ থাকায় তীব্র গরমে গ্রাহকরা পড়েছেন বিপাকে। এ জন্য অতিষ্ঠ গ্রাহকরা বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষকে দায়ী করছেন।
উপজেলার মদনপুর ইউনিয়নের বিদ্যুৎ গ্রাহক ভুট্টু বলেন, ‘২০২১ সালের শেষের দিকে ঘরে বিদ্যুৎ আনি। হালকা বাতাসেই এখানে বিদ্যুৎ থাকে না। এ বছর তীব্র গরমটা বিদ্যুৎ ছাড়াই কাটছে। বর্তমানে টানা দুই মাস এখানে বিদ্যুৎ নেই। এতে জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে গেছে।’
ভুট্টুর মতো একই অভিযোগ এ ইউনিয়নের শত শত বিদ্যুৎ গ্রাহকের। এ চরে আসা বিদ্যুৎকে ঘিরে এখানকার বাসিন্দারা কেউ কেউ স্থানীয় বাজারে গার্মেন্টসের দোকান, ফটোকপি-কম্পিউটারের দোকান, বৈদ্যুতিক সেচপাম্প বসানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন। বর্তমানে টানা দুই মাস বিদ্যুৎ না থাকায় এসব স্বপ্ন বর্তমানে ভেঙে যাওয়ার পথে।