যেভাবে পেটানো হয় তন্বীকে
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০১:৪৯ এএম, ৩ জুন,শুক্রবার,২০২২ | আপডেট: ১০:২০ পিএম, ১৯ নভেম্বর,মঙ্গলবার,২০২৪
একটা মেয়েকে পেটাতে কতজন মানুষ লাগে। ওরা ৬ থেকে ৮ জন মিলে বাঁশ আর রড দিয়ে আমাকে বেদম পেটাচ্ছিল। বলছিল, ওকে মেরে ফেলো, বাঁচিয়ে রাখলে সমস্যা হবে। একটি বুথের আড়ালে আমি লুকানোর চেষ্টা করি। বলছিলাম আমাকে মারছো কেন? পেটানোর এক পর্যায়ে বাঁশগুলো ভেঙে যায়। তারপরও ওরা থামেনি। হঠাৎ ছাত্রলীগের একটি ছেলে এসে আমার বুকে প্রচন্ড শক্তি দিয়ে লাথি দেয়। তখন মনে হচ্ছিল এই বুঝি আমার দমটা বেরিয়ে যাচ্ছে। নিঃশ্বাস নিতে পারছিলাম না। মাটিতে পড়ে গেলাম। ছেলেটি আমাকে একইভাবে বুকে একাধিক লাথি দেয়। তখন আইনজীবী এক বড় ভাই দেবদূত হয়ে এসে রক্ষা করার চেষ্টা করেন। তখনো ওরা বাঁশ দিয়ে পেছন থেকে আমাকে পিটিয়ে যাচ্ছিল। এরপর আর কিছু মনে নেই। পরবর্তীতে নিজেকে হাসপাতালের বিছানায় আবিষ্কার করি।
গত ২৪ মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ছাত্রলীগ কর্মীদের হামলার শিকার ছাত্রদল নেত্রী তন্বী মল্লিক। হামলায় আহত হয়ে চিকিৎসা শেষে বাসায় ফিরলেও আতঙ্কের মধ্যদিয়ে দিন কাটছে তার। রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বাসায় এই ছাত্রদল নেত্রীর সঙ্গে কথা হয় মানবজমিনের। এমবিএর চূড়ান্ত বর্ষের এই শিক্ষার্থী লোমহর্ষক বর্ণনা দেন সেদিনের হামলার।
তন্বী বলেন, ৬ থেকে ৮ জন ছেলে একসঙ্গে একটি মেয়েকে এভাবে পেটালে তার কি বেঁচে ফেরার কথা! আমার পুরো শরীরটাকে ওরা থেঁতলে দিয়েছে। দুই হাত-পিঠ, পা-উরু, কোথাও বাদ রাখেনি। বিছানায় শরীর এলিয়ে ঘুমাতে পারি না। পাশ ফিরতে পারি না। বাথরুমের কমোডে বসতে পারি না। শরীরের জমাটবাঁধা রক্তগুলো এখন ইনফেকশন হয়ে গেছে। এলার্জির মতো সারাক্ষণ শরীর চুলকায়।
তন্বী বলেন, আমাদের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে নিয়ে কটূক্তির প্রতিবাদে ঘটনার দিন গত ২৪ মে সকাল সাড়ে ৯টায় আমরা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে যাই। একটি শান্তিপূর্ণ সংবাদ সম্মেলন করতে যাচ্ছিলাম। তখনো জানতাম না এত বড় কোনো ঘটনা ঘটবে। যাওয়ার আগেই ছাত্রদলের একটি গ্রুপকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা মারধর করেছে। এবং স্লোগান দিচ্ছে। যেহেতু নবম শ্রেণিতে পড়াকালীন সময় থেকে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত তাই তারা অনেকেই আমাকে চেনেন। শহীদ মিনারের সামনে দিয়ে ঢাকা মেডিকেল পার হচ্ছিলাম। তাদেরকে দেখে দ্রুত মুখে মাস্ক পরে ছাতার নিচে মুখ লুকিয়ে যাচ্ছিলাম। এ সময় ওরা আমাকে চিনতে পারে। এবং বলতে থাকে, ধর ধর ধর। পেছন থেকে আমাকে ধাওয়া দিলো তারা। দৌড় দিয়ে ঢাকা মেডিকেলের মধ্যে প্রবেশ করি। সেখানে গিয়ে দেখি ছাত্রদলের সব ভাইয়েরা সেখানে গুরুতর আহত হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। কারও মাথা ফেটেছে, হাত ভাঙা, পায়ে আঘাত।
এ সময় ঢাকা মেডিকেলে যারাই আহত হয়ে চিকিৎসা নিতে আসছেন তাদেরকে গ্রেফতার করতে আসছে পুলিশ। মহানগর থানা পুলিশ, গোয়েন্দা পুলিশে হাসপাতাল ভরে গেছে। আমাদেরকে সেবা-সাহায্য না করে তারা গ্রেফতার শুরু করে। এবং মাথা ফাটা অবস্থায় এক ছাত্রদল নেতাকে পুলিশ গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। তখন আমরা এর প্রতিবাদে একটি শান্তিপূর্ণ মিছিল শুরু করি। এ সময় ছাত্রলীগের ছেলেরা রাম দা, হকিস্টিক, রড, বাঁশ এগুলো নিয়ে আমাদের ধাওয়া করে। আত্মরক্ষার্থে আমাদের ওপর নিক্ষেপ করা ঢিল, বাঁশগুলো কুড়িয়ে হাতে নেই। এবং তাদের ওপর ছুড়ে মারার চেষ্টা করি। ছাত্রলীগের এত বেশি নেতাকর্মী ছিল সেখানে যাদের সঙ্গে তখন আমরা পারবো না- এমনটা ধরে নেই। এবং যে যার মতো পিছু হটার চেষ্টা করি। দোয়েল চত্বর এলাকায় ওরা আমাদের ওপর বৃষ্টির মতো ঢিল ছোড়ে। আমাদেরকে ধাওয়া দিলে আমরা ঘটনাস্থল থেকে সরে যাই। ধাওয়া দিয়ে পেছন থেকে একটি ইট মারে। ইটটি এসে আমার ডান পায়ের পাতায় লেগে প্রচন্ড রক্তপাত শুরু হয়। এরপর পিঠের ঠিক মাঝ খানটায় একটি ইট এসে লাগে। তখন আমি হঠাৎ স্থির হয়ে যাই। এরপর পেছন থেকে প্রথমে ৬ থেকে ৮ জন ছাত্রলীগের নেতাকর্মী এসে আমার দুই হাতে এলোমেলোভাবে পেটায়। এরপর পালাক্রমে রড দিয়ে পিঠ, কোমর, দুই হাত পিটিয়ে থেঁতলে দেয়। এরপর সংখ্যায় তারা আরও বাড়তে থাকে। পেটানোর এক পর্যায়ে বাঁশগুলো ভেঙে যায়। আমি মাটিতে শুয়ে পড়ি। দিগি¦দিক হয়ে শুধু বলছিলাম, মারে কেন, মারে কেন? ওদের কয়েকজনের মাথায় হেলমেট থাকায় মুখ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল না। এ সময় বলছিল, ওকে পিটিয়ে মেরে ফেলো, আরও মার, ওকে বাঁচিয়ে রাখা যাবে না। খুব খারাপ ভাষায় গালি দিচ্ছিল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই একটি ছেলে এসে আমার বুকের মাঝখানটায় শরীরের সকল শক্তি দিয়ে লাথি দেয়। নিঃশ্বাস নিতে পারছিলাম না। খুব কষ্ট হচ্ছিল।
পরবর্তীতে জানতে পেরেছি ওই ছাত্রলীগ নেতার নাম তমাল। লেদার টেকনোলজি ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী সে। প্রথমে ৭-৮টি ছেলে আমাকে পেটায় এরপর তাদের সঙ্গে আরও অনেকেই যুক্ত হয়। এমনভাবে তারা পিটিয়েছে আমাকে, পরম কোনো শত্রুও এটা করে না। তখনো ওরা পেছন থেকে আমাকে মারছিল। দুটি বেসরকারি চ্যানেলের ক্যামেরাম্যানের ক্যামেরায় মারধরের পুরো বিষয়টি রেকর্ড হওয়ায় এবং আমাদের ইউনিটের এক বড় ভাই থাকায় আমি বেঁচে যাই। না হলে হয়তো আমাকে ওরা ঘটনাস্থলেই পিটিয়ে মেরে ফেলতো। এ সময় আইনজীবী পূর্ব পরিচিত এক ভাই এসে আমাকে রক্ষা করে। প্রথমে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করা হয়, সেখানে পুলিশ ঘেরাও করে ফেলে। আমাকে গ্রেফতারের চেষ্টা করলে তৎক্ষণাৎ একটি এম্বুলেন্সে অন্য হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে চিকিৎসা শেষে বর্তমানে বাসায় আছি।
তন্বী বলেন, আমি বাথরুমে পর্যন্ত বসতে পারি না। এখনো তারা আমাকে বিভিন্নভাবে হত্যার হুমকি দিচ্ছে। আমাকে পেলেই মেরে ফেলা হবে। বর্তমানে আমি জীবন শঙ্কায় রয়েছি। যেকোনো সময় আমাকে মেরে ফেলা হতে পারে। জীবনের নিরাপত্তা এবং নির্যাতনের ঘটনায় শিগগিরই মামলা করবো। আর তাছাড়া বিচার চাইবো কার কাছে? যেখানে সরকারের নির্দেশেই তাদের লেলিয়ে দেয়া সংগঠন এভাবে নির্যাতন করতে পারে। তারাতো কোনো মায়ের সন্তান না। কোনো মায়ের সন্তান এমনভাবে একটি মেয়েকে মারতে পারে না। রাজনীতি করছি এবং করবো। কিন্তু কোনো মেয়েকে যেন এভাবে আর না পেটানো হয়। কারণ এটা রাজনীতি হতে পারে না। তাদের কাছে আমার বিচার দেয়ার কিছু নেই।
উল্লেখ্য, তন্বী মল্লিক ছাত্রদলের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার যুগ্ম সম্পাদক।