হিংসাত্মক রাজনীতির দম্ভ : ভেঙে ফেলা হচ্ছে খুলনার নান্দনিক স্থাপনা 'জিয়া হল'
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৭:১২ পিএম, ৫ ফেব্রুয়ারী,শনিবার,২০২২ | আপডেট: ০৮:০২ এএম, ২৪ নভেম্বর,রবিবার,২০২৪
গালিব ইমতেয়াজ নাহিদ
হযরত পীর খাজা খানজাহান আলী (র:) এর স্মৃতি বিজড়িত ভৈরব-রূপসা বিধৌত খুলনার ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি গৌরব মন্ডিত। শিল্পনগরী এবং প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন খ্যাত মসজিদের শহর হিসেবেও ব্যাপক সমাদৃত খুলনা। বিভিন্ন রাজনৈতিক টানাপোড়নের মধ্যেও সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে বিকশিত করার লক্ষ্যে ১৯৭৮ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান খুলনার জনগণের মানসিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশের কথা মাথায় রেখে খুলনার শিববাড়ি মোড়ে ''পাবলিক হল'' স্থাপনের লক্ষ্যে ১.৭২১৭ একর জমি অধিগ্রহণ করেন এবং ১৯৭৯ সালে পরিকল্পনার অংশ হিসেবে কাজ শুরু করেন। বিপদগামী সেনা সদস্যদের হাতে জিয়াউর রহমান নিহত হলে মুখ থুবড়ে পড়ে প্রকল্পটির ভবিষ্যত। পরবর্তীতে ১৯৮৯ সালে তৎকালীন মেয়র আমিনুল হকের উদ্যোগে এবং মেয়র শেখ তৈয়বুর রহমানের মাধ্যমে ১৩ বছরে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে ১৯৯২ সালের ২৭শে সেপ্টেম্বর জিয়াউর রহমানের কীর্তির প্রতি সন্মান রেখে খুলনার সুশীল সমাজের অনুরোধে 'জিয়া হল' নামকরণে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ভবনটি উদ্বোধন করেন। নব্বই দশকের নান্দনিক স্থাপনার মধ্যে অন্যতম নিদর্শন হিসেবে সর্বমহলে 'জিয়া হল' সমাদৃত ও সুপরিচিত।
আধুনিকতার সকল বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন মেধাবী স্থাপত্যবিদদের পরামর্শ ও তত্ত্বাবধায়নে দ্বিতল গ্যালারি বিশিষ্ট মিলনায়তনে আসন সংখ্যা ছিলো ১০৬৫টি, যা একটা বিভাগীয় শহরের জন্য প্রতুল। কর্পোরেট মিটিং অথবা স্বল্প পরিসরে সভা-সেমিনারের জন্য ছিলো ১৯০ আসন বিশিষ্ঠ শীততাপ নিয়ন্ত্রিত সেমিনার কক্ষ যা তৎকালীন সময়ে আধুনিক চিন্তার বহিঃপ্রকাশ, ছিল ২৫০০ বর্গফুটের দুটি লাউঞ্জ, তিনটি মহরত কক্ষ, একটি বিশ্রাম কক্ষ, একটা গ্রীন রুম, মঞ্চ সংলগ্ন ২টা মহিলা কর্ণার, একটা নামাজের ঘর, একটা মেকাপ কক্ষ এবং দাপ্তরিক কার্য সম্পাদনের জন্য একটা অফিস কক্ষ।
পরিবেশগত মান উন্নয়নের কথা মাথায় রেখে সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যের স্মারক জিয়া হলের মূল কাঠামোর চারিদিকে রোপিত ছিলো বিভিন্ন প্রজাতির বনজ ও ফলজ গাছ, যা নগরবাসীকে বিশুদ্ধ শ্বাসের ব্যবস্থা করতো। ছিলো গাড়ি পার্কিং এর সুব্যবস্থা। সব মিলিয়ে জিয়া হল একসময় খুলনাবাসীর কাছে সাংস্কৃতিক বিকাশ ও বিনোদনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠে, হয়ে ওঠে সব বয়সের মানুষের আড্ডাস্থল, বিনোদন ও ভ্রমণ কেন্দ্র। বিবাহ, মেলা, নাটক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, প্রদর্শনী, সিম্পোজিয়াম, পূর্নমিলনী, চলচিত্র প্রদর্শনী, সামাজিক অনুষ্ঠান ইত্যাদি উৎসবে মুখরিত থাকতো বছরের বেশিরভাগ সময়। রাজনৈতিক দলগুলোর সভা-সমাবেশ ও সন্মেলনগুলো অনুষ্ঠিত হতো জিয়া হলে।
প্রথমে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী শাসনামলে দেশজুড়ে জিয়াউর রহমানের নাম এবং অবদানকে নিশ্চিহ্ন করার অংশ হিসেবে জিয়া হলের নাম পরিবর্তনের চেষ্টা করা হয়ে থাকে কিন্তু সে চেষ্টা ব্যর্থ হলেও অব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ধীরে ধীরে নগরবাসীকে জিয়া হল ব্যবহারে বিমুখ করে তুলতে সফল হয়।পরবর্তীতে তৎকালীন মেয়রের উদ্যোগে পুনরায় হল চালু হলে ২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের স্থানীয় সরকার উপদেষ্ঠা আনোয়ারুল ইকবাল ২ কোটি টাকা বরাদ্দ দেন সংস্কারের প্রয়োজনে, কিন্তু পরবর্তীতে আওয়ামী সমর্থিত মেয়র খালেক তালুকদার সংস্কারের কাজ বন্ধ করে দেন এবং উন্নয়নের দোহাই দিয়ে বহুতল বানিজ্যিক ভবন 'সিটি সেন্টার'' মেগাপ্রকল্প হাতে নেন। যার বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে জিয়া হলকে পরিত্যক্ত দেখিয়ে মূল ঐতিহাসিক অবকাঠামোকে ভেঙে ফেলা হচ্ছে।
বিট্রিশ ও পাকিস্তান শাসনামলের স্থাপনাগুলো বিভিন্ন মেয়াদে দেশজুড়ে সংস্কার হয়ে থাকে মূল অবকাঠামো ও নির্মানশৈলী ঠিক রেখে কিন্তু ব্যতিক্রম জিয়া হলের ক্ষেত্রে। বিট্রিশ ও পাকিস্তান শাসনামলের স্থাপনা সমূহের নুন্যতম বয়স ৬০-৭০বছর ক্ষেত্র বিশেষে তারও অধিক। অথচ মাত্র তিন যুগ আগের দৃষ্টি নন্দন স্থাপনাটা শুধুমাত্র নামকরণ পরিবর্তনের লক্ষ্যে পুরো অবকাঠামোয় পরিবর্তন করা হচ্ছে যা কিনা নিছক হিংসাত্মক রাজনীতিরই অংশ।
মহান মুক্তিযুদ্ধে এবং নব্বই দশকের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে রাজনীতিবিদদের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক কর্মীদের ভূমিকা ছিলো উল্লেখযোগ্য, অতীততের স্বৈরশাসকেরাও সাংস্কৃতিক বিকাশের সুযোগ দিয়ে থাকতো বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, কিন্তু বর্তমানেরা সমাজের মানুষের সংস্কৃতিক বিকাশকে বাধাগ্রস্থ করার সকল বন্দোবস্ত অত্যন্ত সুকৌশলে করে যাচ্ছেন উন্নয়নের বুলি আউড়িয়ে। স্থাপত্যবিদদের মতে খুলনার লবনাক্ত আবহাওয়া সত্বেও একটা অবকাঠামোর উপযোগিতা শেষ হতে নুন্যতম ৫০বছর লাগে সেখানে মাত্র তিন যুগের স্থাপনাকে ব্যবহারের অনুপযোগী ঘোষণা করা উদ্দেশ্য প্রনোদিত।
এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে বিশিষ্ট প্রকৌশলী (বুয়েট) ও রাজনীতিবীদ জাকির হোসেন সরকার বলেন ''যেকোন স্থাপনা নুন্যতম ৫০বছরের উপযোগিতা নিয়ে সাধারণত তৈরী করা হয়ে থাকে, মূল কাঠামো ঠিক রেখেও সংস্কার করা যেতে পারে। যার উদাহরণ পাকিস্তান শাসনামলে তৈরী শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডি ৩২নম্বরের বাসভবন। অব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ধীরে ধীরে অনুপযোগী দেখানো হয়েছে স্থাপনাটিকে। শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারনেই স্থাপনাটি ভেঙে ফেলা হচ্ছে।''
খুলনার স্থানীয় বাসিন্দাদের কেউ কেউ মনে করেন, 'খুলনার আশেপাশের জেলার নিবাসীদের হাতে বিভিন্ন মেয়াদে নগরের নেতৃত্ব থাকার কারণে আত্মিক অনুভূতির প্রাধান্যের চেয়েও বানিজ্যিকিকরনকে তারা বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকেন, যার কারণে বিভিন্ন সময়ে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও বিকশিত সমাজ গঠনে তাদের দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে অথবা সামাজিক বন্ধন তৈরীতে বদ্ধপরিকর অবস্থান পরিলক্ষিত হয়ে উঠেনি।' জাতীয়তাবাদী আদর্শের জনক বীর উত্তম জিয়াউর রহমানের নাম ও কীর্তি মুছে ফেলার উদ্দেশ্যে আওয়ামী শাসকদের অপচেষ্টার অংশ হিসেবে সংস্কারের ধোঁয়া তুলে সাংস্কৃতিক বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করা তাদের নীল নকশার একটা অংশ এটা নিশ্চিত ভাবে ফুটে উঠেছে এ ঘটনার মাধ্যমে।
এ বিষয়ে জাতীয়তাবাদী দলের খুলনা মহানগরের অভিভাবক শফিকুল আলম মনা বলেন, ''জিয়া হল খুলনাবাসীর প্রথম এবং একমাত্র মিলনায়তন যেখানে অনেক মানুষ একই সঙ্গে একত্রিত হতে পারতো, তাদের সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করতে পারতো, দল মত নির্বিশেষে সভা-সমাবেশ ও মতপ্রকাশ করতে পারতো। শুধুমাত্র জিয়াউর রহমানের নামে নামকরণ হওয়ার কারণে তিলে তিলে এই মিলনায়তনকে ধ্বংস করে দেওয়া হলো। জাতীয়তাবাদী পরিবারের নেতৃত্বে খুলনাবাসী আগামীতে জিয়া হল পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবে, ইনশাআল্লাহ।''
খুলনার প্রানকেন্দ্রে বহুতল(২২তলা) বানিজ্যিক ভবন স্থাপন হলে আশেপাশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো শ্রী হীন হয়ে পড়বে এবং পরিকল্পিত নগরায়নের স্বাভাবিক ধারা ব্যহত হবে। জিয়া হলের আনুমানিক ৫০০মিটারের অদূরে নিউমার্কেট(কেডিএ) ও বিভিন্ন বেসরকারি বিপনিবিতান, ব্যাংক-বিমা, হোটেল সহ বানিজ্যিক ভবন রয়েছে, সেহেতু এখানে ২২তলা বানিজ্যিক ভবন কতটা বানিজ্যিক সফলতা বয়ে আনবে সেটাও পুনঃবিবেচনা নেওয়ার যৌক্তিক দিক লক্ষনীয়।
শিল্প সংস্কৃতির অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হলে সুস্থ জাতি গঠনও বাধাগ্রস্ত হবে এবং সামাজিক সম্প্রতির অভাব পরিলক্ষিত হবে। সাথে সাথে তরুণ প্রজন্মের স্বাভাবিক বিকাশ ব্যহত হওয়ার সাথে সাথে অসুস্থ মানসিক বিকাশ উৎসাহিত হচ্ছে। ফলে বয়োবৃদ্ধ ও যুবকেরা অবসাদগ্রস্থ হচ্ছে, তরুন-তরুনীরা ঘরকুনে হয়ে যাচ্ছে, মোবাইল ও মাদকে আসক্তি বাড়ছে এবং অসুস্থ সাংস্কৃতিক চর্চায় নিমজ্জিত হচ্ছে। যার ফলাফল, সমাজে অপরাধ প্রবনতা সহ হানাহানি বাড়ছে। ফলে শুধু জিয়া হল পুনঃপ্রতিষ্ঠাই নয়, নগরবাসীর সাংস্কৃতিক বিকাশে এমন আরো নান্দনিক স্থাপনা প্রতিষ্ঠা করা সময়ের দাবিতে পরিনত হয়েছে।
লেখক : গালিব ইমতেয়াজ নাহিদ, সহ সাংগঠনিক সম্পাদক (খুলনা বিভাগ), বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দল, কেন্দ্রীয় সংসদ।