আমরা যা কিছু করি দুর্বৃত্তদের হাত থেকে দেশকে রক্ষার জন্য করি : মির্জা ফখরুল
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০২:০২ এএম, ২৬ জানুয়ারী,
বুধবার,২০২২ | আপডেট: ০৬:০৬ পিএম, ১৫ নভেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
নির্বাচন কমিশন গঠনে তাড়াহুড়া করে আইন করার উদ্যোগকে আরেকটা পাতানো নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় টিকে থাকার নীলনকশা হিসেবে দেখছে বিএনপি। একই সঙ্গে দলটি মনে করে এই সংসদের কোনও নৈতিক এখতিয়ার নেই এই ধরনের কোনও আইন প্রণয়নের। তাই নিজেদের লোক বসানোর জন্য এই আইন করছে। আর একটি পাতানো নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে অবৈধভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকার নীল নকশা মাত্র। বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কোনও নির্বাচন কমিশনেই অবাধ নিরপেক্ষ সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে সফল হবে না যদি না নির্বাচনকালীন সময়ে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
আজ মঙ্গলবার বিকালে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এসব কথা বলেন। গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এই সংবাদ সম্মেলন হয়। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সভাপতিত্বে সোমবার দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকের সিদ্ধান্তসমূহ জানাতে এই সংবাদ সম্মেলন ডাকা হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। সভায় উপস্থিত ছিলেন, জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, মির্জা আব্বাস, বাবু গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. আব্দুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, বেগম সেলিমা রহমান। গত ১০ জানুয়ারি সস্ত্রীক করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর উত্তরার বাসায় আইসোলেশনে থাকার পর করোনামুক্ত হয়ে এই প্রথম গণমাধ্যমের মুখোমুখি হলেন বিএনপি মহাসচিব।
মির্জা ফখরুল বলেন, আমি স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, আমরা যা কিছু করি দেশকে রক্ষার জন্য করি। তার মানে এই না যে, আমরা লবিস্ট নিয়োগ করেছি দেশকে রক্ষার জন্য করেছি। দ্যাট হেজ টু বি ক্লিয়ার্ড। আবারো বলছি, আমরা যা কিছু করি, দেশকে রক্ষার জন্য করি, দুর্বৃত্তদের হাত থেকে দেশকে রক্ষার জন্য করি। আমরা লবিস্ট নিয়োগ করেছি- এটা একেবারে সঠিক না।
তিনি বলেন, ইতিমধ্যে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন পরিষ্কার করে বলেছেন যে, বিএনপির পক্ষ থেকে বাংলাদেশ থেকে কোনো লবিস্ট নিয়োগ করা হয়নি। এটা পরিষ্কার যে, বিএনপি কোনো লবিস্ট নিয়োগ করেনি। আশা করি, এ নিয়ে আপনাদের কোনো কনফিউশন থাকবে না। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য কি মিথ্যা প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, আপনার কি মনে হয়? সব মিথ্যা।
সভায় গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহ
১। সভায় বিগত ১৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জাতীয় স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল সভায় গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহ পঠিত ও অনুমোদিত হয়।
২। সভায় ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সর্বশেষ শারীরিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সদস্যবৃন্দকে অবহিত করেন।
৩। সভায় সংসদে নির্বাচন কমিশন বিল-২০২২ উত্থাপন বিষয়ে আলোচনা হয়। ইতিপূর্বে বিএনপি সুনির্দিষ্টভাবে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে দলের অবস্থান অত্যন্ত স্পষ্টভাবে জনগণের সামনে প্রকাশ করেছে। বিএনপি মনে করে যেহেতু এই সংসদ জনগণের ভোটে বৈধভাবে নির্বাচিত নয় সেহেতু এই সংসদের কোনও নৈতিক এখতিয়ার নেই এই ধরনের কোনও আইন প্রণয়নের। গোপনীয়তার সঙ্গে তাড়াহুড়ো করে এই আইন প্রণয়নের প্রচেষ্টা আওয়ামী লীগের জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করে আর একটি পাতানো নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে অবৈধভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকার নীল নকশা মাত্র। তাছাড়া বিএনপি মনে করে বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কোনও নির্বাচন কমিশনেই অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে সফল হবে না যদি না নির্বাচনকালীন সময়ে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের একতরফা সাজানো ভোটারবিহীন ও মধ্যরাতের ভোট ডাকাতির নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সেই সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিএনপি মনে করে বর্তমান আওয়ামী লীগের অবৈধ সরকারের পদত্যাগ, নিরপেক্ষ নির্দলীয় সরকারের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর, সকল রাজনৈতিক দলের মতামতের ভিত্তিতে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত নির্বাচন কমিশনের পরিচালনায় একটি অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক গ্রহণযোগ্য নির্বাচন বাংলাদেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার একমাত্র পথ, এর কোনো বিকল্প নেই। এই লক্ষ্যে সকল রাজনৈতিক দল, সংগঠন, ব্যক্তি ও জনগণের ঐক্য গড়ে তুলে দুর্বার গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে এই পরিবর্তন আনয়ন করতে হবে। সভায় বিএনপি গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার জন্য সকলের প্রতি আহ্বান জানায়।
৪। সভায় বাংলাদেশে মানবাধিকার লংঘনের দায়ে ১২টি শীর্ষ মানবাধিকার সংগঠন জাতিসংঘ মিশনে র্যাবের প্রতি নিষেধাজ্ঞার দাবি জানিয়ে যে চিঠি দিয়েছে বিএনপি বিষয়টি পর্যালোচনা করে জাতিসংঘ খতিয়ে দেখবে এই মন্তব্যে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে। সভা মনে করে আওয়ামী লীগ সরকার অবৈধভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য হত্যা, খুন, গুম, বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডের জন্য র্যাবসহ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যবহার করে বাংলাদেশকে ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে এবং এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব বাংলাদেশের নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা, অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করে। এই পরিস্থিতি সৃষ্টির সকল দায় দায়িত্ব সরকারকেই বহন করতে হবে।
৫। করোনা টিকাদানের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত ৭০ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশ কমিয়ে আনায় স্বাস্থ্য বিভাগের সিদ্ধান্তে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। সভা মনে করে সরকার শুরু থেকেই করোনা টিকা সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বিতরণের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে এবং জনগণের স্বাস্থ্য বিপন্ন করেছে। সভায় করোনা পরিস্থিতি এবং টিকা প্রদানের বিষয়ে সঠিক চিত্র জনগণের সামনে প্রকাশ করার আহ্বান জানানো হয়।
৬। সভায় সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) ভিসির পদত্যাগের দাবিতে শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে প্রথমে ছাত্রলীগের হামলা ও পরে পুলিশের হামলা, সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ, লাঠিচার্জ ও গুলি বর্ষণের ফলে অসংখ্য শিক্ষার্থী আহত হওয়ার ন্যক্কারজনক ঘটনার তীব্র নিন্দা জানানো হয়। পরবর্তীতে ন্যায়সঙ্গত দাবিতে শিক্ষার্থীদের আমরণ অনশন ও সকল প্রকার আন্দোলনের প্রতি নৈতিক সমর্থন জানানো হয়। সভা মনে করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও সরকারের স্বৈরাচারী মনোভাবের কারণেই পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে এবং প্রায় ১০ দিনেও এই সমস্যার সমাধান হয়নি।
সভায় অবিলম্বে ভাইস চ্যান্সেলরসহ দায়ী সকল সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার অপসারণ এবং নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে ছাত্রলীগ ও পুলিশের দায়ী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানানো হয়। সভা মনে করে, অযোগ্য, চাটুকার ও দলীয় শিক্ষকদের প্রশাসনিক দায়িত্ব অর্পণের ফলে এই ধরনের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটছে এবং উচ্চ শিক্ষা ব্যবস্থাকে মারাত্মকভাবে অবনতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতি, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অসদাচরণ ও দুর্নীতি দেশের উচ্চ শিক্ষাকে বিপন্ন করছে। অনতিবিলম্বে নিরপেক্ষ, যোগ্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে কমিশন গঠন করে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানানো হয়।
৭। সভায় ঢাকাকে বিশ্বে বায়ু দূষণে শীর্ষে চিহ্নিত করায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। সভা মনে করে, সরকারের অযোগ্যতা, ব্যর্থতায় কার্যকরী কোনও পদক্ষেপ গ্রহণ না করার ফলে এই সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে। জনগণের বিশেষ করে শিশু ও বয়স্ক মানুষের স্বাস্থ্যের চরম অবনতি ঘটতে শুরু করেছে। সভায় এই প্রসঙ্গে বিএনপি সরকারের আমলে গৃহীত ব্যবস্থাগুলোর ফলে পরিবেশের যে উন্নতি ঘটেছিল তা স্মরণ করা হয়। সভায় অবিলম্বে বায়ু দূষণ রোধের জন্য কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়।
৮। সভায় সম্প্রতি সামাজিক গণমাধ্যমে চাঁদপুরের প্রস্তাবিত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয় স্থাপনের ভূমি অধিগ্রহণ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রীর দুর্নীতির যে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে তাতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। বিষয়টি নিয়ে অবিলম্বে সুষ্ঠু নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত অবস্থা জনগণের সামনে তুলে ধরার আহ্বান জানানো হয়।
৯। সভায় সাংবাদিক সাগর-রুনি দম্পত্তি হত্যার তদন্তের চার্জশিট আদালতে পেশ করার তারিখ ৮৫ বার পেছানোয় গভীর উদ্বেগ, নিন্দা প্রকাশ করা হয়। এই মামলাটি রহস্যজনকভাবে বছরের পর বছর তদন্ত রিপোর্ট দাখিল না করায় সরকারের দুরভিসন্ধি ও ব্যর্থতা জনমনে চরম হতাশা সৃষ্টি করেছে বলে মনে করা হয়। প্রকৃতপক্ষে এই ব্যর্থতার সকল দায়ভার আইনশৃংখলা রক্ষা বাহিনীর ওপর বর্তায় বিধায় দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এবং সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তা অপসারণ দাবি করা হয়।
১০। সভায় গত ২৪ জানুয়ারি ২০২২ সিরাজগঞ্জ জেলা বিএনপি কার্যালয়ে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কনিষ্ঠ পুত্র, বিশিষ্ট ক্রীড়া সংগঠক আরাফাত রহমান কোকোর ৭ম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে দোয়া মাহফিলে হকিস্টিকসহ গোয়েন্দা বাহিনী (ডিবি)’র অতর্কিত আক্রমণ এবং ৪ জন যুব ও ছাত্র নেতাকে গ্রেফতারের তীব্র নিন্দা জানানো হয়। বিনা উষ্কানিতে এই ধরনের হামলা ও গ্রেফতার সরকারের একনায়কতান্ত্রিক ও নির্যাতনকারীর চেহারার বহিঃপ্রকাশ বলে মনে করে। অবিলম্বে গ্রেফতারকৃত নেতা-কর্মীদের মুক্তি দিয়ে মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়।