নির্বাচন : গণতন্ত্র মানবাধিকারের লেন্সে বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন দেখবে যুক্তরাষ্ট্র, বলছেন বিশ্লেষক
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০২:১২ এএম, ৮ জানুয়ারী,শনিবার,২০২২ | আপডেট: ১১:৩৭ এএম, ২২ নভেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
২০১৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত বিতর্কিত নির্বাচনে জয়লাভ করে ২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারি ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ তৃতীয় মেয়াদে সরকার গঠন করে। এর আগে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয়েছিল একতরফা নির্বাচন। পরপর দুটি জাতীয় নির্বাচন ত্রুটিপূর্ণ হওয়ায় আগামী জাতীয় নির্বাচন কেমন হবে সেটি এখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।
বাংলাদেশে চলমান স্থানীয় নির্বাচনেও জাতীয় নির্বাচনের প্রভাব দেখা যাচ্ছে। বিরোধীদের ভোট বর্জন চলছে। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার হারও বেশি। আর উপনির্বাচনসহ অনেক ক্ষেত্রে ভোটার উপস্থিতিও কমে গেছে উল্লেখযোগ্য হারে।
এ বাস্তবতায় বাংলাদেশে আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে এ বছরটি হবে ঘটনাবহুল। নির্বাচনের প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে প্রস্তুতি এবং সরকারি ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বছর।
নির্বাচন পর্যবেক্ষণ সংস্থা ফেমার প্রেসিডেন্ট মুনিরা খান মনে করেন আগামী নির্বাচন বাংলাদেশের জন্য নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ।
‘নেক্সট যে ইলেকশন হবে, আমি মনে করি সব ইলেকশন এমনকি এখন যে ইউপি ইলেকশনগুলো হচ্ছে এগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় প্রত্যেকটা নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ। এবং এই নির্বাচনগুলো যাতে সুষ্ঠু, অবাধ নিরপেক্ষ এবং অংশগ্রহণমূলক হয় সেই প্রচেষ্টাই করতে হবে, না হয় গণতন্ত্র ত্রুটিপূর্ণ থেকে যায়।’
‘এখন আমাদের গণতন্ত্র উন্নতির প্রথম সোপান। সেটা যদি আমরা করে ফেলতে পারি আমরা পৃথিবীতে একটা ভালো জাতি হিসেবে পরিচিত হতে পারবো।’
পরপর বিতর্কিত দুটি নির্বাচনের পরেও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় টিকে আছে এবং এর বিরুদ্ধে কোনো প্রকার গণআন্দোলনও সৃষ্টি করতে পারেনি বিরোধীদল। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও নির্বাচনের বিতর্ক পাশ কাটিয়ে সরকার নিজেদের সমর্থন আদায় করতে পেরেছে।
এ প্রেক্ষাপটে আগামী নির্বাচনও একই রকম হবে কি না আর সেটি আন্তর্জাতিকভাবে কতটা গ্রহণযোগ্য হবে সেটি এখন গুরুত্বপূর্ণ। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্নে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কী অবস্থান নেয় সেটিকে তাৎপর্যপূর্ণ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
বাংলাদেশের নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা পেতে বড় নিয়ামক হবে যুক্তরাষ্ট্র তথা পশ্চিমা বিশ্বের সমর্থন। এরই মধ্যে বাংলাদেশকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্র বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। বাইডেন প্রশাসনের চিন্তুা-ভাবনা কী সেটি নিয়ে আগ্রহ তৈরি হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের উইলসন সেন্টারের উপপরিচালক মাইকেল কুগলম্যান বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতিতে গণতন্ত্র এখন অগ্রাধিকার পাচ্ছে।
‘বাইডেন প্রশাসন বলেছে যে গণতন্ত্র হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির শীর্ষ অগ্রাধিকার। বাংলাদেশে র্যাবকে নিষেধাজ্ঞা দেয়ার মধ্য দিয়ে একটা ইঙ্গিত আছে যে ২০২৩ সালের নির্বাচনে কী ঘটবে সেটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গভীর পর্যবেক্ষণ করবে। সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক কীভাবে এগিয়ে নেবে সেক্ষেত্রে এর প্রভাব থাকবে।’
মি. কুগলম্যান বলছেন, ‘আমি মনে করি আগামী নির্বাচন অবাধ সুষ্ঠু হবে। র্যাবকে নিষেধাজ্ঞা দেয়াটা বাইডেন প্রশাসনের একটা শক্তিশালী সংকেত।’
তবে যুক্তরাষ্ট্রের এ অ্যান্ড এম ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষক ড. মেহনাজ মোমেন মনে করেন, এ অঞ্চলে ভূরাজনীতিটাই গুরুত্বপূর্ণ হবে মার্কিন প্রশাসন কী অবস্থান নেবে সেটি নির্ধারণের ক্ষেত্রে।
‘যখন অবস্থান নিতে হবে তখন ওরা দেখবে বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক অবস্থান। কাজেই যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কটা বাংলাদেশের সাথে বাংলাদেশে কী হচ্ছে সেটার থেকে অনেক বেশি চীন বাংলাদেশের সাথে কী সম্পর্কে আছে সেটা দিয়ে প্রভাবিত হবে।’
‘আরেকটা জিনিস বাংলাদেশ এখন ভারতের অনেক সমর্থন পাচ্ছে। অনেক সময় ভারত কী পদক্ষেপ নিচ্ছে সেটার ওপরও নির্ভর করে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে অন্যান্য দেশের ভূমিকা থাকবে।’
যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক পররাষ্ট্রনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক কুগলম্যানের মতে, বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান হবে বাইডেন প্রশাসনের বর্তমান নীতির আলোকেই।
‘আমি মনে করি বাংলাদেশের নির্বাচন ইস্যুটি বাইডেন প্রশাসন কঠোরভাবেই গণতন্ত্র ও মানবাধিকার লেন্সেই দেখছে। যেটা তাদের পররাষ্ট্র নীতির অগ্রাধিকার হিসেবে ঘোষণা করেছে। তবে এক্ষেত্রে অবশ্যই আমি মনে করি গুরুত্বপূর্ণ হলো যুক্তরাষ্ট্র শুধুমাত্র ভারতের দৃষ্টিভঙ্গিতে বাংলাদেশকে দেখবে না।’
এদিকে একাধারে দুটি নির্বাচন ব্যাপক ত্রুটিপূর্ণ হলেও বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনদের আন্তর্জাতিক সমর্থন পেতে ভারতের সমর্থন বড় ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করা হয়। এবার গণতন্ত্রের প্রশ্নে ভারতকে যুক্তরাষ্ট্র প্রভাবিত করতে চাইতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা কি ভারতের অবস্থান বদলাবে? এ প্রশ্নে ভারতের জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরেটাস অধ্যাপক এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক এস ডি মুনী বলেন, ‘ভারত যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে নীতি নির্ধারন করবে না।’
‘ইন্ডিয়ার নিজস্ব অগ্রাধিকারই প্রাধান্য পাবে। আর সম্প্রতি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বক্তব্যে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে বাংলাদেশ হলো ভারতের প্রতিবেশী প্রথম এ নীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। আমি মনে করি বাংলাদেশ ভারত সম্পর্ক প্রতিবেশী সম্পর্কের দিক থেকে সেরা অবস্থায় আছে। এখানে আমেরিকার কারণে প্রভাবিত হওয়ার কোন কারণ নেই।’
ভারতের পররাষ্ট্রনীতি এবং আঞ্চলিক রাজনীতি নিয়ে খোঁজখবর রাখা এসডি মুনী অবশ্য এটাও বলছেন যে, বাংলাদেশের প্রধান দুই দলের নেতৃত্ব আর ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ইস্যুগুলোও আগামী নির্বাচনে ভারতের অবস্থান কী হবে সেটি নির্ধারণে গুরুত্ব পাবে।
‘হাসিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে কি না, তার উত্তরসূরি কে হবে সে প্রশ্ন রয়েছে। একই প্রশ্ন বিরোধীদলের নেতৃত্বের ক্ষেত্রেও, কারণ বিএনপি বাজে অবস্থায় আছে। এছাড়া উগ্রবাদীরা আরও শক্তিশালী হচ্ছে, সোচ্চার হচ্ছে। নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দৃশ্যপট কী হয় এরকম অনেক কিছু খোলাসা হওয়ার ওপরেই অনেক কিছু নির্ভর করবে।’