‘সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগের এমপিরা নির্বাচিত হওয়া দূরে থাক পালানোর দরজাও খুঁজে পাবে না’-আবদুল কাদের মির্জা
জনাব ওবায়দুল কাদের আপনার আপন ছোট ভাইয়ের বক্তব্যটি গুরুত্ব সহকারে অনুধাবন করুন-রিজভী
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০২:৩১ এএম, ৫ জানুয়ারী,মঙ্গলবার,২০২১ | আপডেট: ১১:১৮ পিএম, ১২ নভেম্বর,মঙ্গলবার,২০২৪
‘বৃহত্তর নোয়াখালীতে আওয়ামী লীগের কিছু কিছু চামচা নেতা আছেন, যারা বলেন অমুক নেতা তমুক নেতার নেতৃত্বে বিএনপির দুর্গ ভেঙেছে। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বৃহত্তর নোয়াখালীতে তিন-চারটা আসন ছাড়া বাকি আসনে আমাদের এমপিরা দরজা খুঁজে পাবে না পালানোর জন্য। এটাই হলো সত্য কথা। সত্য কথা বলতে হবে। আমি সাহস করে সত্য কথা বলছি।’ কথাগুলো আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ছোট ভাই আবদুল কাদের মির্জার। তার সাম্প্রতিক এ বক্তব্যের ভিডিও ফেসবুক ও ইউটিউবে ভাইরাল হয়েছে। সেখানে নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষায় দলীয় কিছু নেতাকে ইঙ্গিত করে আবদুল কাদের মির্জাকে বলতে শোনা যায়, ‘নোয়াখালীর মানুষজন বলে, শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তা বেড়েছে। এটা সত্য। কিন্তু আপনাদের জনপ্রিয়তা বাড়েনি। আপনারা প্রতিদিন ভোট কমান। টাকা দিয়ে বড় জনসভা করা, মিছিল করা কোনো ব্যাপার নয়। টাকা দিলে, গাড়ি দিলে আমিও অনেক লোক জড়ো করতে পারব। না হয় রাজনীতি থেকে বিদায় নেব।’
আগামী ১৬ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় দ্বিতীয় ধাপের পৌরসভা নির্বাচনে আবদুল কাদের মির্জা নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বসুরহাট পৌরসভার মেয়র পদে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের প্রার্থী হিসেবে লড়ছেন। এ উপলক্ষে ৩১ ডিসেম্বর সকালে নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের বসুরহাট পৌরভবন চত্বরে ইশতেহার ঘোষণাকালে ওই বক্তব্য দেন তিনি। তিনি নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের প্রস্তাবিত কমিটির সহ-সভাপতি। এ নিয়ে টানা তৃতীয়বার বসুরহাট পৌরসভা নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পেলেন তিনি।
আবদুল কাদের মির্জা তার বক্তৃতায় বলেন, ‘নোয়াখালীর রাজনীতি অতি কষ্টের। এই বৃহত্তর নোয়াখালীতে আমাদের নেতা ওবায়দুল কাদের, মওদুদ সাহেব (বিএনপির মওদুদ আহমদ), আবু নাছের সাহেব (জামায়াতের)- এই তিনজন ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ, তাদের সমমর্যাদার কেউ নেই। কোনো নেতা সৃষ্টি হয়নি। এখন তো ওবায়দুল কাদের, মওদুদ আহমদের নাম বিক্রি করি। তারা তিনজন তো অসুস্থ, তারা মারা গেলে কার নাম বিক্রি করবে, কেউ নাই।’
কারও নাম উল্লেখ না করে আবদুল কাদের বলেন, ‘প্রকাশ্য দিবালোকে পুড়িয়ে মানুষ হত্যা করেন, তারা হচ্ছেন নেতা। টেন্ডারবাজি করে কোটি কোটি টাকা লুটপাট যারা করেন, তারা হচ্ছেন নেতা। পুলিশের, প্রাথমিক শিক্ষকের চাকরি দিয়ে যারা পাঁচ লাখ টাকা নেন, তারা হচ্ছেন নেতা। গরিব পিয়নের চাকরি দিয়ে তিন লাখ টাকা যারা নেন, তারা হচ্ছেন নেতা।’
জেলা আওয়ামী লীগের প্রস্তাবিত কমিটির সমালোচনা করে আবদুল কাদের বলেন, ‘সাবেক সেনাপ্রধান মঈন উ আহমদের ছোট ভাই জাবেদ (মিনহাজ আহমেদ জাবেদ)। তার সঙ্গে যোগাযোগ করে কোনো কোনো নেতা তখন (এক-এগারোর সময়কালে) নিজেদের রক্ষা করেছেন। এখন সেই জাবেদ এবং হাওয়া ভবনের মানিক (আতাউর রহমান ভূঁইয়া ওরফে মানিক) আজ জেলা আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি। অথচ কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সাহাব উদ্দিনের মতো ত্যাগী ও নির্যাতিত ব্যক্তিকে করা হয়েছে উপদেষ্টা। এটা হলো আমাদের কমিটি।’
আবদুল কাদের মির্জা বলেন, দলের প্রয়াত সাবেক তিন নেতা আবদুল মালেক উকিল, শহীদ উদ্দিন এস্কেন্দার ও নুরুল হক সাহেবের নোয়াখালীতে আওয়ামী লীগের অপরাজনীতি চলছে। এই অপরাজনীতি চলতে পারে না। তাই তিনি সবাইকে অপরাজনীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান।
গত বৃহস্পতিবারের ওই বক্তব্যের পর রবিবার সকালে উপজেলা পরিষদের সভাকক্ষে নির্বাচনি আচরণবিধি প্রতিপালন বিষয়ে মতবিনিময় সভায় আবদুল কাদের যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেটিও এখন ভাইরাল।
আজ তিনি বলেন, ‘দুঃখজনক হলেও সত্য, গত উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সহধর্মিণীর (ইশরাতুন্নেসা কাদের) সঙ্গে চরম দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। কয়েকজন নেতা ষড়যন্ত্র করে আমার এখানে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য অস্ত্র পাঠিয়েছেন।’ বক্তব্যের এই পর্যায়ে জেলা প্রশাসক ‘আর কিছু বলবেন কি না’ জানতে চাইতেই আবদুল কাদের ডিসির বিরুদ্ধে বক্তব্যে বাধা দেয়ার অভিযোগ তুলে সভাকক্ষ থেকে বেরিয়ে যান। এরপর যথারীতি সভাটি চলে।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, সভা থেকে বেরিয়ে আবদুল কাদের মির্জা পৌরসভা কার্যালয়ে গিয়ে দলীয় নেতাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ তুলে চিৎকার-চেঁচামেচি করেন। এক পর্যায়ে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে বেলা ১১টার দিকে তিনি শহরের জিরো পয়েন্টে বঙ্গবন্ধু চত্বরে অবস্থান নেন। ততক্ষণে সেখানে হাজির হন কয়েক হাজার দলীয় নেতা-কর্মী ও সমর্থক। সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে টায়ার জ্বালিয়ে হাতে ঝাড়ু নিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন সমর্থকেরা। বিক্ষোভকারীরা ডিসি, এসপির অপসারণ দাবি করে তাদের বিরুদ্ধে নানা অশালীন স্লোগান দেন।
এরপর দুপুরে জিরো পয়েন্টে উপস্থিত গণমাধ্যমকর্মী ও দলীয় নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে আবদুল কাদের বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনগণের ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন, কিন্তু ভোটের অধিকার এখনো প্রতিষ্ঠা হয়নি। দুর্নীতি, টেন্ডারবাজি বন্ধ হয়নি। তাই ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের নিশ্চয়তা না পাওয়া পর্যন্ত তিনি তার অবস্থান কর্মসূচিতে অনড় থাকবেন। তার পাশে কেউ না থাকলে প্রয়োজনে তিনি একা লড়ে যাবেন বলেও উল্লেখ করেন।
ওবায়দুল কাদেরের ছোট ভাইয়ের বক্তব্যের বিষয়ে যা বলল বিএনপি : নোয়াখালীর দুই এমপিসহ জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের পদত্যাগ দাবিতে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের ছোট ভাই যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে দেশের বর্তমান পরিস্থিতির বাস্তব চিত্র ফুটে উঠেছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।
আজ সোমবার রাজধানী নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ মন্তব্য করেন।
রিজভী বলেন, সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় ওবায়দুল কাদেরের আপন ছোট ভাই নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের বসুরহাট পৌরসভা মেয়র আবদুল কাদের মির্জার একটি বক্তব্য ভাইরাল হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার সকালে পৌরসভার বটতলা চত্বরে সংবাদ সম্মেলনে আবদুল কাদের মির্জা বলেছেন, ‘সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগের এমপিরা নির্বাচিত হওয়া দূরে থাক পালানোর দরজাও খুঁজে পাবে না’।
‘আবদুল কাদের মির্জার বক্তব্য বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির বাস্তব চিত্র। আমরা আশা করি, আবদুল কাদের মির্জার সঙ্গে বিএনপির কোনো সম্পৃক্ততা না খুঁজে ওবায়দুল কাদের সাহেব নিজের আপন ছোট ভাইয়ের বক্তব্যটির গুরুত্ব অনুধাবন করবেন।’
নির্বাচন কমিশনকে কোলের মধ্যে বসিয়ে আওয়ামী সরকার নির্বাচনের নামে দেশবাসীর সঙ্গে দীর্ঘ ১২ বছর ধরে যে প্রতারণা করেছে আবদুল কাদের মির্জার বক্তব্যেই তা প্রমাণিত হলো, বলেন রিজভী।
ওবায়দুল কাদেরকে উদ্দেশ্য করে তিনি আরও বলেন, প্রতিদিন প্রেস ব্রিফিংয়ে বিএনপির বিরুদ্ধে মনগড়া বক্তব্য দেয়াকেই নিজেদের একমাত্র রাজনৈতিক কর্মসূচি হিসেবে গ্রহণ করেছেন তিনি। কারণ-অকারণে প্রতিদিন বিএনপির বিরুদ্ধে মিথ্যাচার জনগণের কাছে তাকে একটি হাস্যকর চরিত্রে পরিণত করেছে। এটি তিনি বুঝতে পারছেন বলে মনে হয় না।
রিজভী বলেন, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরুর পর গণভবনের চার দেয়ালে আটকেপড়া শেখ হাসিনা কিংবা র্যাব-পুলিশের পাহারায় টিকে থাকা ওবায়দুল কাদের সাহেবরা বুঝতেই পারছেন না যে, তারা এখন গণদুশমনে পরিণত হয়েছেন। তাই অযথা বিএনপির বিরুদ্ধে বালখিল্যসুলভ বক্তব্য-মন্তব্য করা ছাড়া তাদের হাতে আর কোনো কাজ নেই।