এখন নির্বাচন হচ্ছে ভয় আর আতঙ্কের নাম : জিএম কাদের
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০২:১৪ এএম, ২ জানুয়ারী,রবিবার,২০২২ | আপডেট: ০১:৪৭ পিএম, ২১ নভেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও সংসদের বিরোধীদলীয় উপনেতা জিএম কাদের বলেছেন, দেশের মানুষ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির হাত থেকে মুক্তি চায়। কেননা এ দুটি দল অপকর্ম, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, লুণ্ঠনের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রেখে চলেছে। ক্ষমতার পরিবর্তনে এ অবস্থার পরিবর্তন হয় না। দেশের মানুষ এখন জাতীয় পার্টিকেই বিকল্প শক্তি হিসেবে মনে করছে। তারা জাতীয় পার্টিকে রাষ্ট্র ক্ষমতায় দেখতে চায়।
তিনি আরও বলেন, ইতোমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির চেয়ে জাতীয় পার্টি দেশে বেশি গণতন্ত্র, সুশাসন আর উন্নয়ন দিতে পেরেছে। দেশের মানুষের প্রত্যাশা ভবিষ্যতেও দিতে পারবে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি হচ্ছে অচল পয়সার এপিঠ-ওপিঠ। দেশের মানুষ চায় চকচকে নতুন পয়সা। জাতীয় পার্টির মতো রাজনৈতিক শক্তির দিকে তাকিয়ে আছে দেশের মানুষ।
আজ শনিবার (১ জানুয়ারি) রাজধানীর রমনায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে জাতীয় পার্টির ৩৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় সভাপতির বক্তব্যে জিএম কাদের এসব কথা বলেন।
তিনি আরও বলেন, কোটি কোটি বেকার, কর্মসংস্থান নেই। অভাব অনটনে যুব সমাজ মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ছে। জড়িয়ে পড়ছে অনৈতিক কর্মকাণ্ডে। প্রতিদিন লাফিয়ে লাফিয়ে দ্রব্যমূল্য বেড়েই চলছে। গ্যাস, পানি ও বিদ্যুতের বিল বাড়ছে, কিন্তু মানুষের আয় বাড়ছে না। পরিবার নিয়ে জীবন-যাপনে হাপিত্যেশ উঠেছে সাধারণ মানুষের। বিশ্ববাজারে তেলের দাম বেড়ে গেলে তেলের দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়, কিন্তু বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমলে দেশে তেলের দাম কমানো হয় না। কৃষক যে ফসল ৫ টাকা কেজিতে বিক্রি করে, সেই ফসল রাজধানীতে হাত ঘুরে ৬০ থেকে ৭০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে।
‘বেপরোয়া চাঁদাবাজির কারণে গণপরিবহণের নৈরাজ্য থামছে না। গণপরিবহণ কে নিয়ন্ত্রণ করছে বিষয়টি পরিস্কার নয়। সরকার গণপরিবহণ চালাচ্ছে এটা বিশ্বাস করে না দেশের মানুষ বরং অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় গণপরিবহণ যারা নিয়ন্ত্রণ করে, তারাই সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে তাদের নিজেদের স্বার্থে। সাধারণ ব্যবসায়ীরা জিম্মি হয়ে পড়েছে চাঁদাবাজদের হাতে। চাঁদা না দিয়ে কেউ নিজের জমিতে বাড়িও করতে পারে না। কৃষিপণ্য সরবরাহে ঘাটে ঘাটে চাঁদাবাজি ও মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য। ফুটপাতে বেপরোয়া চাঁদাবাজিতে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা অসহায়, দেখার যেন কেউ নেই। এগুলোর মূল কারণ সরকারের জবাবদিহিতার অভাব, সার্বিকভাবে আইনের শাসনের অনুপস্থিতি।’
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান বলেন, দেশে কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে। বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের উৎসাহিত করতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয় জিডিপি বেড়েছে, জিডিপি বাড়লে মানুষের পেট ভরে না। দেখা যাচ্ছে জিডিপি বাড়লে সাধারণ মানুষের উপকার হয় না, তাই জিডিপি নিয়ে সাধারণ মানুষের কোনো আগ্রহ নেই। জিডিপি বৃদ্ধির বা উচ্চ মাত্রার প্রধান সুফল চাকরি ও ব্যবসার সুযোগ- সেটি তেমন হারে বাড়ছে না। বেকার সমস্যার সমাধানে প্রবৃদ্ধির কোনো ভূমিকা লক্ষ্যনীয় নয়।
সংসদের বিরোধীদলীয় উপনেতা আরও বলেন, নির্বাচনে ভিন্নমতাবলম্বীদের মাঠে দাঁড়াতে দেয় না ক্ষমতাসীনরা। ক্ষমতার জোরে বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় জয়ী হতে চায় তারা। কোথাও কোথাও ক্ষমতাসীনরা প্রশাসনের সহায়তায় কলুষিত করছে নির্বাচনী ব্যবস্থা। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা নির্বাচনে ভোট ডাকাতি ও অব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে- এটা জাতির জন্য লজ্জাজনক।
‘নির্বাচন কমিশন মানুষের আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। এক সময় নির্বাচন ছিল উৎসব মুখর, এখন নির্বাচন হচ্ছে ভয় আর আতঙ্কের নাম। দেশের মানুষ রক্তাক্ত নির্বাচন চায় না। দেশের মানুষ খুনোখুনির নির্বাচন পছন্দ করে না। ক্ষমতা ও কালোটাকার খেলায় দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা কলুষিত হয়েছে। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরেও নির্বাচন কমিশন গঠন আইন না হওয়াও লজ্জাজনক।’
তিনি বলেন, করোনাকালে প্রমাণ হয়েছে আমাদের দেশের স্বাস্থ্যসেবা কতটা নাজুক। আমাদের দাবি- উপজেলা পর্যায়ের প্রতিটি হাসপাতালে সব ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। উপজেলাসহ সব সরকারি হাসপাতালে আইসিইউর ব্যবস্থা থাকতে হবে। ইউনিয়ন পর্যায়ে এমবিবিএস পাশ চিকিৎসক দ্বারা স্বাস্থ্যসেবা দিতে হবে। প্রয়োজনীয় সংখ্যক ডাক্তার, নার্স ও টেকনোলজিস্ট নিয়োগ দিতে হবে। দেশের মানুষ জানতে পেরেছে স্বাক্ষ্য খাতে মারাত্মক লুটপাটের খবর। স্বাস্থ্য খাতে দীর্ঘ দিনের দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে সরকার কী ব্যবস্থা নিয়েছে- তা আমরা জানতে চাই।
জিএম কাদের বলেন, করোনা মহামারির শুরুতেই শুধু ‘নাই’ ‘নাই’ শুনেছে জাতি। আমরা চাই প্রতিটি সরকারি হাসপাতালে সব ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। চিকিৎসা সেবা উন্নত করতে হবে, যাতে দেশের মানুষ চিকিৎসার জন্য আর বিদেশে না যায়।
তিনি বলেন, জাতীয় পার্টি তার জন্ম থেকে অদ্যাবধি ৩৫ বৎসর সময়ের মধ্যে প্রায় ৪ বৎসর জাতীয় পার্টি ক্ষমতায় ছিল। পরবর্তী ৩১ বৎসর দলটি ক্ষমতার বাইরে। ৬ ডিসেম্বর ১৯৯০ সালে দলটি তিন জোটের রুপরেখা মোতাবেক নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে এবং এতে সব রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিত্ব সমান অবস্থানে থেকে নির্বাচন করবে ও জয়ী দল সরকার গঠন করবে এ শর্তে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ায়, সাংবিধানিক পন্থায় নিয়মতান্ত্রিকভাবে। তিন জোট তাদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে। পরবর্তীতে জাতীয় পার্টির জন্য জেলজুলুম, নির্যাতন ও নানারকম প্রতিকূলতা সৃষ্টি করে। তবুও জাতীয় পার্টি ১৯৯১ সালের নির্বাচনে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আসনে জয়ী হয়। খুব অল্প ভোটের ব্যবধানে প্রচুর আসনে দ্বিতীয় অবস্থানে আসতে সক্ষম হয়। পরবর্তী ৩১ বৎসর ক্ষমতায় আসতে না পারলেও ক্ষমতা নিয়ামক শক্তি হিসেবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখে চলছে। এর কারণ কী হতে পারে?
জিএম কাদের বলেন, আত্মপ্রকাশ করার পর ক্ষমতা হস্তান্তর করা পর্যন্ত যে ৪ বৎসর জাতীয় পার্টি সরকার পরিচালনা করেছে, সে চার বৎসর সময়ে বাংলাদেশ গণতন্ত্র চর্চার মাপকাঠিতে ও জনকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ড সম্পাদনে তুলনামূলকভাবে ভালো ছিল বলা যায়।
তিনি বলেন, গণতন্ত্র অর্থ জনগণের শাসন। জনগণের প্রতিনিধির মাধ্যমে জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালিত হবে, সেটাই গণতন্ত্রের চর্চা। শতভাগ গণতন্ত্র কোনো দিনই সম্ভব নয়। যেহেতু দেশের সব মানুষ একসঙ্গে দেশ পরিচালনা করতে পারবে না। আবার সবার প্রত্যাশা এক হবে না। ফলে তা বাস্তবায়নও অসম্ভব। তবে কত বেশি সংখ্যক মানুষ অনুভব করে তাদের প্রতিনিধিরা তাদের ইচ্ছা/অনিচ্ছার প্রতিফলন রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে করছে, ততটুকু ভালো গণতন্ত্রের চর্চা হচ্ছে বলা যায়। সে হিসেবে দেশের সিংহভাগ মানুষের যদি ওই ধরনের উপলব্ধি হয় যে জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী জনপ্রতিনিধি শাসন করছেন- তা হলেই শুধু গ্রহণযোগ্যভাবে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা চালু আছে বলা যায়। এর জন্য অবশ্যই জনগণের কাছে সরকারের সার্বক্ষণিক জবাবদিহিতা থাকা প্রয়োজন।
বিরোধীদলীয় উপনেতা বলেন, আজ স্বাধীনতা অর্জনের ৫০ বছর বা সুবর্ণজয়ন্তীতে এসে বলা যায়, সার্বিকভাবে বিবেচনায় স্বাধীনতার পর থেকে অধ্যাবদি বাংলাদেশে কোন সময় গণতন্ত্রের চর্চা গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে ছিল না। এক কথায় বাংলাদেশে কোনো সময়ই তেমন কোনো গণতন্ত্রের চর্চা হয়নি। এর প্রধান কারণ আমাদের সংবিধান। সংবিধানের মূলনীতি হিসেবে এবং বিভিন্নভাবে গণতন্ত্রের চর্চার বিষয়ে জোড় দিয়ে বলা হয়েছে। কিন্তু সার্বিকভাবে সংবিধানের বিভিন্ন বিধানাবলীতে গণতন্ত্রের চর্চার চেয়ে একনায়কতন্ত্রবাদকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন সংশোধনীর মাধ্যমে অনেক ধরনের পরিবর্তন আনা হলেও গণতন্ত্র চর্চার সুযোগ সৃষ্টির জন্য কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ক্ষমতায় আসীন হয়ে সরকার গণতন্ত্রের চর্চার সুযোগ সংকুচিত করেছে। গণতন্ত্র চর্চার সহায়ক প্রতিষ্ঠানগুলোকে পর্যায়ক্রমে দুর্বল থেকে দুর্বলতর করে প্রায় ধ্বংস করা হয়েছে।
তিনি বলেন, জাতীয় পার্টির দেশ পরিচালনার সময়কালে কিছুটা হলেও গণতন্ত্রের সাধ পেয়েছে দেশের মানুষ। জনগণের অধিকার অপেক্ষাকৃতভাবে নিশ্চিত ছিল। অনেক বেশি সুশাসন উপভোগ করেছে মানুষ। আইনের শাসন ছিল। সবাই আইনের চোখে সমান ছিল ও আইনের আওতায় ছিল। সমাজে সার্বিকভাবে বৈষম্য ছিল কম, ন্যায়বিচার ছিল।
বিকাল ৩টায় রমনায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আলোচনা সভা আয়োজন করা হয়। আলোচনাসভা শেষে ওই একই স্থানে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়া এবং যুগ্ম মহাসচিব গোলাম মোহাম্মদ রাজুর সঞ্চালনায় সভায় আরও বক্তব্য দেন- জাতীয় পার্টির সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ এমপি, জাতীয় পার্টি মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নু এমপি, সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম এমপি, কো-চেয়ারম্যান এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার, কো-চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট কাজী ফিরোজ রশীদ এমপি, কো-চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা এমপি, জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য সাহিদুর রহমান টেপা, শেখ মুহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম, মীর আব্দুস সবুর আসুদ, হাজী সাইফুদ্দিন আহমেদ মিলন, লিয়াকত হোসেন খোকা এমপি, চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা শেরীফা কাদের এমপি, জহিরুল আলম রুবেল, ভাইস-চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম পাঠান, জাতীয় যুব সংহতির আহ্বায়ক এইচএম শাহরিয়ার আসিফ, জাতীয় স্বেচ্ছাসেবক পার্টির সাধারণ সম্পাদক মো. বেলাল হোসেন, জাতীয় শ্রমিক পার্টির সাধারণ সম্পাদক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন, জাতীয় ছাত্র সমাজের সভাপতি ইব্রাহিম খান জুয়েল।
উপস্থিত ছিলেন- প্রেসিডিয়াম সদস্য সুনীল শুভ রায়, নাজমা আক্তার এমপি, আলমগীর সিকদার লোটন, মেজর (অব.) রানা মো. সোহেল এমপি, উপদেষ্টা রওশন আরা মান্নান এমপি, এমএ কুদ্দুস, নুরুল ইসলাম মিলন, ড. নূরুল আজহার শামীম, মনিরুল ইসলাম মিলন, মেহজাবিন মোর্শেদ ইব্রাহিম, নাজনীন সুলতানা, হেনা খান পন্নী, ইসরাফিল খোকন, আমানত হোসেন আমানত, লাকি বেগম, ইন্জিনিয়ার মো. সিরাজুল হক, ডা. রুস্তম আলী ফরাজী এমপি।