খালেদা জিয়ার চিকিৎসার প্রযুক্তি উপমহাদেশেই নেই
লিভার সিরোসিস হয়েছে খালেদা জিয়ার : মেডিকেল বোর্ড
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০২:৫৯ এএম, ২৯ নভেম্বর,সোমবার,২০২১ | আপডেট: ০৭:১০ এএম, ২০ নভেম্বর,
বুধবার,২০২৪
লিভার সিরোসিসের কারণে বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ব্লিডিং হচ্ছে জানিয়ে তাঁর চিকিৎসায় গঠিত মেডিকেল বোর্ডের চিকিৎসকরা যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র বা জার্মানির বিশেষায়িত হাসপাতালে চিকিৎসার সুপারিশ করেছেন। তারা জানিয়েছেন, বিএনপি নেত্রীর যকৃত বা লিভারে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। একবার এই রক্তক্ষরণ সামাল দেয়া গেছে। তবে এখন তাঁর যে অবস্থা, সেটি দ্বিতীয়বার সামাল দেয়া কঠিন হবে। বাংলাদেশে দু-তিনবার রক্তক্ষরণ সামাল দেয়ার কারিগরি সুযোগ নেই দাবি করে যত দ্রুত সম্ভব তাঁকে দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন তারা।
আজ রবিবার সন্ধ্যায় গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের বাসভবন ফিরোজায় বেগম খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসকরা তাঁর সর্বশেষ অবস্থা নিয়ে ব্রিফ করেন। সেখানে তারা এসব কথা বলেন।
সংবাদ সম্মেলনে বেগম খালেদা জিয়ার রোগ নিয়ে প্রাথমিক একটি বর্ণনা দেন ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও বিএনপির গঠন করা মেডিকেল বোর্ডের প্রধান ফখরুল মোহাম্মদ সিদ্দিকী (এফ এম সিদ্দিকী।) ‘খালেদা জিয়ার পেট থেকে চাকা চাকা রক্ত যাচ্ছে’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ইউনাইটেড হাসপাতালে একবার রক্ত দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়া সম্ভব হয়েছে। কিন্তু এ ধরনের রোগীকে বারবার রক্ত দেয়া সম্ভব নয়।’ তিনি বলেন, ‘আশঙ্কা করছি, আবার যদি ব্লিডিং হয় তাহলে এটা কন্ট্রোল করা সম্ভব হবে না। ব্লিডিং হয়ে মৃত্যুঝুঁকি আরও বেড়ে যাবে।’
ইন্টারভ্যানশনাল গ্যাস্ট্রো অ্যানালিস্ট চিকিৎসক আরেফিন সিদ্দিক লিভারে রক্তক্ষরণ ঠেকাতে চিকিৎসা পদ্ধতি তুলে ধরে বলেন, ‘এটা একটা হাইলি টেকনিক্যাল কাজ। বাংলাদেশে এমন কোনো রোগী আমরা দেখিনি, যার দুই থেকে তিনবার এটা করা হয়েছে।’ কোথায় এর চিকিৎসা করা যায় এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এটা আমেরিকা বা ইউরোপবেজড, বিশেষ করে ইউকে, জার্মানি, ইউএসএ-তে কিছু সেন্টার আছে। সেটাও দেশজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে নেই, দু-একটি সেন্টার আছে।’
হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার পাকস্থলীতে আবারও রক্তক্ষরণ হলে তাঁর মৃত্যুঝুঁকি বেড়ে যাবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন মেডিকেল বোর্ডের চিকিৎসকরা।
এ সময় ডা. শামসুল আরেফিন বলেন, ‘আমাদের শরীরে দুটি সার্কুলেশন সিস্টেম আছে। একটা হলো পোর্টাল সার্কুলেশন সিস্টেম, আরেকটা সিস্টেমিক সার্কুলেশন সিস্টেম। লিভারে দুটা সিস্টেমই কার্যকর। লিভারে টোটাল যে ব্লাড যায় তার তিন ভাগের এক ভাগ যায় সিস্টেমিক সার্কুলেশন থেকে আর দুই ভাগ যায় পোর্টাল সার্কুলেশন থেকে। এখানে যেটা হয় তার পোর্টাল প্রেসার বেড়ে গেছে। কারণ তাঁর লিভারের ভেতরের নরমাল চ্যানেলগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যে কারণে পোর্টাল প্রেসার বেড়ে যায়, আর যেসব ব্যান খাদ্যনালিতে থাকে, সেগুলো ফুলে ওঠে ফেটে যায়। সে জন্য সিভিআর ব্লিডিং হয়। এই সিচুয়েশনে আমরা যেটা করেছি সেটা ইন্টারন্যাশনাল প্র্যাকটিস। এটার পরে আবার ব্লিডিং হলে আরও কিছু জিনিস আছে যেগুলো আমরা করি, স্পেশাল কিছু কেমিক্যাল এজেন্ট আছে সেগুলো ইনজেক্ট করি অনেক সময়। আনফরচুনেটলি সেটা আমাদের দ্বারা সম্ভব হয়নি এবং এখন আমাদের দেশে সেই ওষুধগুলো পাওয়া যায় না।’ এ চিকিৎসক আরও বলেন, ‘তৃতীয়ত যেটা আছে সেটা হলো টিপস। লিভারের ভেতরে টোটাল প্রেসার কমানোর জন্য সিস্টেমিক সার্কুলেশন এবং পোর্টাল সার্কুলেশনের মধ্যে একটা কমিউনিকেশন করে দেয়া। এটা একটা হাইলি টেকনিক্যাল কাজ। এটা সচরাচর হয় না। আমাদের দেশে আমি দেখিনি কোনো টিপস করা রোগী এসেছে। রোগীদের দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয়বার ব্লিডিং হলে সার্ভাইভ করা কঠিন হয়ে যায়। সে জন্য এ সেন্টারগুলো মেইনলি আমেরিকা ও ইউরোপে হয়। বিশেষত ইউকে, জার্মানি এবং ইউএসএ। ওইসব দেশে এগুলোর জন্য অ্যাডভানস সেন্টার আছে। তবে সেসব দেশেও ছড়িয়ে ছিটিয়ে নেই। দুই-চারটা সেন্টার আছে। বিশ্বের সব রোগীরা সেসব সেন্টারে যায়।
ডা. এফ এম সিদ্দিকী বলেন, বেগম খালেদা জিয়া বহুদিন ধরে নানা রোগে আক্রান্ত। তিনি গত ১২ নভেম্বর দুর্বল অনুভব করলে তাঁকে পরীক্ষার জন্য এভারকেয়ার হাসপাতালে নেয়া হয়। পরে লিভারের সমস্যার কথা বিবেচনায় নিয়েই হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। রাত ৯টা ২০ মিনিটে খুবই রক্তবমি হয়। বুঝতে পারি যে, তার খাদ্যনালিতে ব্যাপক রক্তক্ষরণ হয়। তাঁকে জীবন রক্ষার উদ্দেশ্যে ফ্লুইড দেয়া শুরু হয়। দ্রুত রক্ত দেয়া হয়। প্লাজমা ও ফ্লুইড দেয়া হয়। এক পর্যায়ে বিষয়টি খুবই দুশ্চিন্তায় ফেলে দেয়। ডা. শাহাবুদ্দিন তালুকদারের নেতৃত্বে দ্রুত এন্ডোসকপির মাধ্যমে খালেদা জিয়ার চিকিৎসা শুরু হয়। তখন লিভারের সিরোসিসের পরীক্ষা হয়। দেখা গেছে যে, ৬টা ব্যান্ডিংয়ের মাধ্যমে কোনোমতে তাৎক্ষণিক রক্তক্ষরণ বন্ধ করা হয়। তিনি বলেন, বেগম খালেদা জিয়া ডায়াবেটিস ও হার্ট ফেইলিউরের রোগী। তাঁর হার্ট ফেইউলিয়র এমন পর্যায়ে থাকে যে, কোনো ডিকম্পেসেশন হলে হার্ট ফেইলিউর হয়। তবুও রাত ৩টা পর্যন্ত চেষ্টা করে আমরা তার পরিপাকতন্ত্রের রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে সক্ষম হই। এরপর নতুন ওষুধ দিয়ে তাকে তিন দিন পর্যবেক্ষণে রাখি। ১৪ নভেম্বর ইন্টারভেনশন করি। ১৭ নভেম্বরের পর আবারো তাঁর রক্তক্ষরণ হয়। আমরা হিমোগ্লোবিন করি। তাঁর হিমোগ্লোবিন করি। কারণ প্রথমবার ১৩ নভেম্বর হিমোগ্লোবিন ৫.৪ এ নেমে গিয়েছিল। ৪ ব্যাগ রক্ত দিয়ে ৯ পর্যন্ত উঠেছিল। আবার সেটা ৭-এ নেমে আসে। এভাবে পরের হিমোগ্লোবিনও কমে যায়। এরপরই আমরা জীবন রক্ষার্থে অবিরত আইভি ইনফিউশন দিতে থাকি। ব্লাড দিতে হয়েছে অব্যাহতভাবে। এভাবে তাঁকে আমরা কিছুটা স্থিতিশীল করতে সক্ষম হই। তবে ৫ দিনের বেশি সেই ইঞ্জেকশনটা দেয়া যায় না। ২১ নভেম্বর আবারো তার শরীর খারাপ হয়।
অধ্যাপক এফ এম সিদ্দিকী বলেন, বেগম খালেদা জিয়ার শরীর ২৩ নভেম্বর থেকে আবার অবনতি হয়। ব্লাড প্রেশার ও হিমোগ্লোবিন কমে যায়। টয়লেটের সাথে কালো স্টুল যায়। পুরো ক্লোন রক্ত জমাট বেঁধে কালো হয়ে গেছে। পুরো ক্লোন রক্তে জমাট হয়েছে। দুইদিন খুবই রক্তক্ষরণ হয়েছে। ২৪ নভেম্বর রাতে তাঁকে আবার জেনারেল ওটিতে নেয়া হয়। যাতে সিরিয়াস কিছু হলে তাৎক্ষণিক কিছু ব্যবস্থা নেয়া যায়।
তিনি আরো বলেন, বেগম খালেদা জিয়ার অবস্থা হচ্ছে- যদি জীবন বাঁচাতে চান তবে রক্ত সঞ্চালনের বাইপাস করতে হবে। যেটাকে টিপস (TIPS) বলা হয়। কিন্তু এই টেকনোলোজিটা বাংলাদেশে তো নেই বরং আশপাশের সিঙ্গাপুর বা ব্যাংককেও নেই। এটা দুই-একটা সেন্টারে হয়ে থাকে যেটা আমেরিকা বা জার্মানিতে আছে। গত ২৪ ঘন্টায় তাঁর রক্তক্ষরণ হয়নি। তবে ঝুঁকিতে আছেন। আমরা সর্বোচ্চটা করে যাচ্ছি। তিনি দৃঢ় মনোবল ধরে রাখেন। যে কারণেই আমরা ধৈর্য সহকারে কাজ করতে পেরেছি। এ কথা তো ঠিক যে ম্যাডামের কিছু হলে আমাদের খারাপ লাগবে। তিনি বলেন, এ ধরনের রোগীর কেইস স্টাডি বলে পুনরায় রক্তক্ষরণ হতে পারে। যা খুবই আশঙ্কাজনক। প্রশ্নোত্তরে এফ এম সিদ্দিকী বলেন, রক্তক্ষরণে বেগম খালেদা জিয়ার মৃত্যুঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে। কারণ রক্তক্ষরণ বন্ধের প্রযুক্তি আমাদের দেশে নেই। তাঁর তিনবার ইতিমধ্যে রক্তক্ষরণ হয়েছে। আবারো রক্তক্ষরণের সম্ভাবনা আছে। কিন্তু এরই মধ্যে তাঁকে অ্যাডভান্স সেন্টারে না পাঠালে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হবে। যত দ্রুত সম্ভব তাঁকে বিদেশে নেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। না হলে শিফট করাও মুশকিল হয়ে যাবে। তিনি বলেন, আজ থেকে ৪ মাস আগে যদি বিদেশে নেয়া হতো তাহলে এই রক্তক্ষরণ হতো না। কারণ তার শরীরে যেসব প্রযুক্তির ব্যবহার করে চিকিৎসা দিতে হবে সেসব প্রযুক্তি আশপাশের কোনো দেশেই নেই। ডা. আরেফিন বলেন, লিভারের ভেতরে প্রেসার কমানোর জন্য যে টেকনোলোজি দরকার সেটা নেই। রক্তক্ষরণ বন্ধের জন্য আমেরিকা, জার্মানিতে অ্যাডভান্স সেন্টার আছে।
সংবাদ সম্মেলনে আরো উপস্থিত ছিলেন ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন, প্রফেসর ডা. একিউ এম মহসিন, প্রফেসর ডা. নূর উদ্দিন, ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. আল মামুন।