দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০২:২৭ এএম, ৬ অক্টোবর,
বুধবার,২০২১ | আপডেট: ০৫:৪৭ এএম, ২২ নভেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দল ও সব অংশীজনের মধ্যে আস্থাহীনতা রয়েছে। দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। তাই সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য একমাত্রা দাবি হওয়া উচিত নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল আন্দোলন করে আসছে। গণতান্ত্রিক জোটও গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠায় বৃহত্তর ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে আসছে। একইসঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকার তথা কোনো দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেছে তারা।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, সার্চ কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠন প্রক্রিয়া ‘জনগণের সাথে ধোঁকাবাজি। নির্বাচন কমিশন সার্চ কমিটির মাধ্যমে গঠনের যে অভিজ্ঞতা আমাদের আছে, সেই অভিজ্ঞতা হচ্ছে যে, এক নম্বর: একেবারেই তাদের (সরকার) নিজস্ব লোকজনকে দিয়ে, প্রাধান্য দিয়ে গঠন করা হয়। আগের অভিজ্ঞতা থেকে যে, এটা সম্পূর্ণভাবে সরকার তার নিজের পছন্দমত লোকজনকে দিয়ে তৈরি করে এবং সেটাকে নির্বাচনে কাজে লাগায়। আমরা গতবার দেখলাম, ২০১৮ সালের নির্বাচনে হুদা (কেএম নুরুল হুদা) সাহেবের যে কমিশন সেই কমিশন পুরোভাবে সরকারের চেয়েও অনেক ক্ষেত্রে আগ বাড়িয়ে তাদের সেই দলীয় ভূমিকা পালন করেছে যেটা কোনো মতেই গ্রহণযোগ্য নয়।
তিনি বলেন, যেকোনো নির্বাচন কমিশন গঠনের সময়ে যদি নির্বাচনকালীন সময়ে একটি নিরপেক্ষ সরকার না থাকে তাহলে সেই নির্বাচনটা কখনোই সুষ্ঠু, অবাধ এবং গ্রহণযোগ্য হয় না। নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে তারা আর ক্ষমতায় আসতে পারবে না। সেজন্য দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচনের বিধান রাখতে চায় তারা। আমাদের দাবি একটাই, আমরা কিছু চাই না। আমরা শুধুমাত্র নির্বাচনকালীন সময়ে একটা নিরপেক্ষ সরকার চাই।
মির্জা ফখরুল বলেন, অতীতের মতো নির্বাচন কোনো মতেই আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। আমরা পরিষ্কার করে বলছি যে, আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন হবে না এবং ২০১৪ অথবা ২০১৮ সালের নির্বাচন নির্বাচন খেলা জনগণ আর গ্রহণ করবে না। ২০১৪ তে কী করেছে? ওই সময়ে ১৫৪ জনকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ঘোষণা করল। কোনো বিরোধী দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি শুধু জাতীয় পার্টি ছাড়া। আর সবাই নির্বাচন বর্জন করেছিল। আর ২০১৮ সালে নির্বাচনের আগের রাতে ভোটের বুথ দখল করে ভোট ডাকাতি করে নিয়ে গেছে। আবার শুনতে পারছি যে, এবার ১৫০টি আসনে ইভিএম ব্যবহার করা হবে। এটা হলে তো হয়েই গেলো, আর নির্বাচন তো দরকার নেই। ইভিএম দিয়েই তো তারা নিয়ে চলে যাবেন। গত ২০১৮ সালের নির্বাচন সম্পর্কে বিশ্বের যে জনমত যারা ইন্টারন্যাশনাল কমিউনিটি বিভিন্ন দেশগুলো তারা প্রত্যেকে বলেছেন যে, এই নির্বাচন হয়নি। এমনকি তাদের পত্র-পত্রিকা বলেন, গার্ডিয়ান বলেন, নিউইয়র্ক টাইমস বলেন, ইকোনোমিস্ট বলেন, তারা সকলে প্রশ্ন তুলেছেন, প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে আছে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান বলেন, এ দেশে কোনো নির্বাচন রাজনৈতিক সরকারের আমলে সুষ্ঠু হয়নি। সুতরাং দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে হবে। এটা জোরেশোরে দাবি হওয়া উচিত।
সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান বলেন, ১৯৯১ সালের পর থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন নিয়ে ছোটখাটো প্রশ্ন উঠলেও জনমত অনুযায়ী নির্বাচনগুলো ভালো হয়েছিল। তবে সবশেষ দুই জাতীয় নির্বাচন নিয়ে নানা অভিযোগ রয়েছে। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করাটা খুবই কঠিন। তিনি মনে করেন চাইলে নিরপেক্ষতা বজায় রাখা সম্ভব, কিন্তু এর পেছনে রাজনৈতিক সদিচ্ছা রয়েছে কি না, সেটিই বড় প্রশ্ন৷
সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নির্বাচনের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আইন হলো আরপিও। বর্তমান নির্বাচন কমিশন অনেকগুলো পরিবর্তনের কথা বলছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন হলো ইভিএম অন্তর্ভুক্ত করা। তিনি বলেন, ‘হলফনামা, আয়-ব্যয়ের হিসাব-নিকাশ, এগুলোয় কর্ণপাত নেই, কিন্তু ইভিএমের ব্যাপারে অতি উৎসাহ দেখা যাচ্ছে। আইনকে অস্ত্রে পরিণত করার প্রচেষ্টা কি না জানি না।
সংবিধান উপেক্ষা করে সার্চ কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ (সিইসি) অন্য কমিশনারদের নিয়োগের কোনো আইনি সুযোগ নেই, বলেছেন দেশের বিশিষ্ট নাগরিকরা। সোমবার ‘নির্বাচন কমিশন নিয়োগ আইন ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা’ শীর্ষক এক ওয়েবিনারে তারা বলেন, এটা দুর্ভাগ্যজনক যে, দেশে এখনও সিইসি ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ সংক্রান্ত নির্দিষ্ট কোনো আইন নেই। যদিও এই আইন প্রণয়নের জন্য সাংবিধানিক বিধান আছে। এই আইনের অনুপস্থিতিতেই রাষ্ট্রপতি ২০১২ ও ২০১৭ সালে সিইসি ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের জন্য সার্চ কমিটি গঠন করেছিলেন। আইনবিদ, নির্বাচন বিশেষজ্ঞ, শিক্ষাবিদ ও অধিকার কর্মীদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত ওই ওয়েবিনারে তারা বলেন, এই ধরনের সার্চ কমিটি নির্বাচন কমিশনার হিসেবে ‘দলের তোষামোদকারীদের’ সুপারিশ করে থাকে। ফলস্বরূপ, গেল ২টি নির্বাচন কমিশন যথাযথভাবে তাদের কার্য সম্পাদনে ব্যর্থ হয়েছে। বেসরকারি সংগঠন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এই আইনের একটা খসড়াও তৈরি করেছে। খসড়ায় একজন অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে ৬ সদস্যের একটা সার্চ কমিটি গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। যার মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি প্রশাসন চালাতে দক্ষ এবং সৎ, ন্যায়নিষ্ঠ, নিরপেক্ষ ও আইনি বিষয়ে জ্ঞান আছে এমন কমিশনারদের নিয়োগ দেবেন।
জ্যেষ্ঠ আইনবিদ ও সংবিধান প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য আমীর-উল-ইসলাম বলেন, আইন প্রণয়নের সঙ্গে সম্পর্কিত সবকিছু সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদ অনুসারে করা উচিত।
সংবিধানের ১১৮ (১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অনধিক চার জন নির্বাচন কমিশনারকে লইয়া বাংলাদেশের একটি নির্বাচন কমিশন থাকিবে এবং উক্ত বিষয়ে প্রণীত কোন আইনের বিধানাবলী-সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগদান করিবেন।’
আমীর-উল-ইসলাম বলেন, ‘এখানে নতুন কিছু করার সুযোগ সীমিত (আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত) অন্য দেশগুলো কী প্রক্রিয়া অনুসরণ করে, সেটা আমরা দেখতে পারি।
অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এম এ মতিন বলেন, অবসরপ্রাপ্ত কিংবা দায়িত্বরত বিচারপতিদের ভেতর থেকে সার্চ কমিটির প্রধানকে বাছাই করা উচিত হবে না। বরং তার অন্য ক্ষেত্র থেকে আসা উচিত। যার নির্বাচন ও প্রশাসন সংক্রান্ত অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান আছে। পাশাপাশি বিতর্কিত হয়ে ওঠার কারণে ‘সার্চ কমিটি’ নামটাই পরিবর্তনের প্রস্তাব দেন তিনি।
আরেক আইনবিদ শাহদীন মালিক বলেন, ‘সিইসি ও ইসি নিয়োগের জন্য সার্চ কমিটির নামে সরকার জনগণের সঙ্গে চালাকি করছে। রাষ্ট্রপতির সার্চ কমিটি গঠনের কোনো ক্ষমতা নেই। কারণ প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতির নিয়োগ ছাড়া অন্য সব বিষয়ে তাকে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেই পরামর্শ করতে হয়।
তিনি আরও বলেন, ‘সরকার এমনভাবে সার্চ কমিটি গঠন করে যা নিজেদের পছন্দ মতো লোক বাছাই করে এমন কোনো সার্চ কমিটির মাধ্যমে যদি নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়, তাহলে তা দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হবে। যেহেতু আগামী ফেব্রুয়ারি মাসেই বর্তমান নির্বাচন কমিশনের ৫ বছরের মেয়াদ শেষ হচ্ছে, তাই অনেকেই মনে করছেন নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগের জন্য সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে যথেষ্ট সময় নেই। তবে শাহদীন মালিক বলেন, সরকার ও সংসদ চাইলে স্বল্প সময়ের মধ্যেই আইনটি পাস করতে পারে।
সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সার্চ কমিটি তৈরি করা হয়েছে অ্যাডহক ভিত্তিতে। তার ভাষ্য, ‘সার্চ কমিটিগুলো দলীয় নিরপেক্ষ লোকদের নিয়ে গঠন করা হয়নি। যারা নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দলের তোষামোদকারীদেরই বাছাই করে। ফলে আমরা দেখেছি, শেষ ২টি কমিশন পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে, নানা অসঙ্গতিতে জড়িয়ে পড়েছে এবং একটা ভঙ্গুর নির্বাচনী ব্যবস্থা তৈরিতে অবদান রেখেছে। এম হাফিজউদ্দিন খানের মতে, দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে।
তিনি বলেন, ‘শেষ দুটি সার্চ কমিটির কর্মকান্ডে মানুষ সন্তুষ্ট নয়। বর্তমান কমিশনের অধীনে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়নি। ভোটাররা ভোট দিতে চায় না। কারণ তারা মনে করে ভোট দিয়ে কোনো লাভ নেই। সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন মনে করেন, সংবিধানের ভিত্তিতেই নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের আইন তৈরি করা উচিত। দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশে এ ধরনের আইন আছে।
তিনি বলেন, ‘আমাদের সময়ে আমরা এই আইনের একটা খসড়া তৈরি করেছিলাম, যা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলো, এটা নিয়ে আর কোনো আলোচনা হয়নি। সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদারের অভিমত, একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সরকার ও শাসন ব্যবস্থায় একটা পরিবর্তন আসা উচিত।
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, সংবিধান এমন কোনো পবিত্র গ্রন্থ নয়, যা পরিবর্তন করা যাবে না। তার বক্তব্য, সংবিধান সব সময় পরিবর্তন করা যেতে পারে। এ ছাড়া জাতীয় নির্বাচন তত্ত্বাবধানের জন্য তিনি একটা জাতীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব রাখেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ নজরুলও নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য আইন প্রণয়নের ব্যাপারে সহমত পোষণ করেন। তিনি বলেন, ‘বর্তমান সরকারের অধীনে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া সম্ভব নয়। আমাদের নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা পরিবর্তন করা দরকার। এটা হতে পারে তত্ত্বাবধায়ক সরকার, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অথবা জাতীয় সরকার।