দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ : কাঠগড়ায় ওবায়দুল কাদের
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০২:৪০ এএম, ৪ অক্টোবর,সোমবার,২০২১ | আপডেট: ০৯:২৪ পিএম, ১৭ নভেম্বর,রবিবার,২০২৪
দলের শীর্ষ নেতাদের নিয়ে কটূক্তি করলে দলের সাংগঠনিক রীতি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হয়। কিন্তু প্রায় দেড় বছর ধরে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের নিয়ে বিষোদগার করলেও আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের ভাই বসুরহাট পৌরসভার মেয়র আবদুল কাদের মির্জার কোনো শাস্তি হয়নি।
সম্প্রতি গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কটূক্তির একটি গোপন ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। এ নিয়ে গাজীপুরসহ সারাদেশের নেতাকর্মীদের মাঝে ভেতরে ভেতরে তোলপাড় চলে। এই দুই ব্যক্তির ‘বিতর্কিত’ ভূমিকা নিয়ে এখন পর্যন্ত প্রশ্নের মুখোমুখি করা হয়নি তাদের। কেনো তাদের প্রশ্নের মুখোমুখি করা হয়নি?
এসব প্রশ্নের জবাব দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের কাছে জানতে চান কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা। পরে এ নিয়ে শনিবার সন্ধ্যায় ধানমন্ডিতে দলের সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে বাকবিতন্ডা চলে। এ সময় উপস্থিত একাধিক নেতা এই তথ্য নিশ্চিত করেন।
সূত্রমতে, এ সময় উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য বেগম মতিয়া চৌধুরী, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক মৃণাল কান্তি দাস, কেন্দ্রীয় সদস্য আনোয়ার হোসেন, আনিসুর রহমান, ইকবাল হোসেন অপু।
এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী দুইজন আওয়ামী লীগ নেতা জানান, আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের আওয়ামী লীগের ধানমন্ডির কার্যালয়ে সন্ধ্যায় যান। সেখানে নিজের কক্ষে কিছুক্ষণ অবস্থান করেন। নিজের কক্ষ থেকে বের হয়ে যাওয়ার সময় একবার কনফারেন্স রুমে ঢু মারেন। এ সময় সেখানে উপস্থিত দুইজন নেতা ওবায়দুল কাদেরকে ডাকেন। ওবায়দুল কাদের নাম শুনে চলে আসতে চান। এক পর্যায়ে নেতৃবৃন্দ রুমের ভিতরে যাওয়ার জোর দাবি করলে তিনি সেখানে যান। এ সময় দলের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক মৃণাল কান্তি দাস রুমের দরজা বন্ধ করে দেন ভেতরের কথা বাইরে না আসে।
তখন একজন কেন্দ্রীয় নেতা গাজীপুরের মেয়র জাহাঙ্গীর আলম ও আবদুল কাদের মির্জার বক্তব্যের ব্যাখ্যা জানতে চান। আফম বাহাউদ্দিন নাছিম ও ইকবাল হোসেন অপু ওবায়দুল কাদেরকে বলেন, জাহাঙ্গীর আপনার লোক। আপনিই মেয়র বানাইছেন। এখন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সে কটূক্তি করে। তার বিষয়ে দলের অবস্থান কী হবে এটা আপনিই বলুন। তখন অন্য দুইজন নেতা ওবায়দুল কাদেরের কাদের মির্জার বিষয়ে জানতে চান। তার মুখ কেন বন্ধ করা যাচ্ছে না তা জানতে চান। এ সময় ওবায়দুল কাদের ক্ষেপে যান। শুরু হয় বাদানুবাদ ও হট্টগোল। দলের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য বেগম মতিয়া চৌধুরী ও মৃণাল কান্তি দাস পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করেন। এ বিষয়ে জানতে চেয়ে কল দিলে উপস্থিত কেউ নাম প্রকাশ করে বক্তব্য দিতে রাজি হননি।
গাজীপুরের মেয়র জাহাঙ্গীরকে শোকজ :
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিতর্কিত বক্তব্যের অভিযোগে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র এবং নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলমকে শোকজ করা হয়েছে। আজ আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
তিনি বলেন, দলীয় সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের স্বাক্ষরিত এ শোকজের চিঠি ইস্যু করা হয়েছে। আগামী ১৫ দিনের মধ্যে তাকে জবাব দিতে বলা হয়েছে। সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কিত বিতর্কিত মন্তব্য করেন গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র জাহাঙ্গীর আলম। ছড়িয়ে পড়া চার মিনিটের ওই ভিডিওতে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ ছাড়াও মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আজমত উল্লাহ খান, যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল, হেফাজতের প্রয়াত নেতা জুনায়েদ বাবুনগরীর সঙ্গে তার সখ্য ও রাষ্ট্রীয় দুটি সংস্থা নিয়ে নানা আপত্তিকর মন্তব্য করছেন মেয়র জাহাঙ্গীর। একটি ঘরোয়া আয়োজনে তিনি এ কটূক্তি করেন বলে জানা যায়।
ভিডিওতে বলতে শোনা যায়, মেয়র মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন, বঙ্গবন্ধুর দেশ স্বাধীন করার উদ্দেশ্য নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। পরে একটি ভিডিও বার্তায় মেয়র দাবি করেন, ফেসবুকে ভিডিও সুপার এডিট করে তাকে রাজনৈতিকভাবে হেয় করা হচ্ছে। তিনি ইতিমধ্যে তার আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি ওই ভিডিওটির বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেবেন।
ফেসবুকে জাহাঙ্গীর আলমের বক্তব্য ছড়িয়ে পড়ার পর তার শাস্তি দাবিতে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে ২৩ সেপ্টেম্বর বিক্ষোভ করেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। মহাসড়কে টায়ার জ্বালিয়ে মেয়র জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্লোগান দেন তারা। একই দিন টঙ্গি স্টেশন এলাকায় রেললাইনে আগুন দেন বিক্ষুব্ধরা। আগুনের কারণে সারাদেশের সঙ্গে দেড় ঘণ্টা রেল চলাচল বন্ধ থাকে। বিষয়টি নিয়ে উত্তপ্ত হয়ে পড়ে গাজীপুরের রাজনৈতিক পরিস্থিতি। একদিকে জাহাঙ্গীর আলমের শাস্তির দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশের ঘোষণা দেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। ২৪ সেপ্টেম্বর, ওই একই দিনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘এসডিজি অগ্রগতিতে জাতিসংঘের সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট সলিউশনস নেটওয়ার্ক’ (এসডিএসএন) পুরস্কার পাওয়ায় তাকে অভিনন্দন জানিয়ে বোর্ড বাজার ইউটিসি চত্বর এলাকায় আনন্দ মিছিলের ঘোষণা দেন সিটি মেয়র জাহাঙ্গীর।
আনন্দ মিছিলের নামে নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করে গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট আজমত উল্ল্যাহ খান বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যে বক্তব্য মেয়রের বলে ভাইরাল হয়েছে, সেখানে সুস্পষ্টভাবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়েছে, যেটা রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল। এ বক্তব্য তারই কণ্ঠে ভাইরাল হয়েছে। বিষয়টি জানার সঙ্গে সঙ্গে গাজীপুরের আওয়ামী পরিবার এবং স্বাধীনতার সপক্ষের প্রত্যেকটি মানুষ প্রতিবাদ জানিয়ে বিক্ষোভ করেছে। অন্যদিকে মেয়র সংবাদ সম্মেলনে বলেন, এটা নাকি তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। তার বক্তব্য এডিট করা হয়েছে।
তিনি বলেন, একের অধিক জায়গার বক্তব্য একত্র করেছে। এডিট করার অর্থ হলো কথাটা তার নিজের। সুতরাং তাকেই প্রমাণ করতে হবে এবং তিনি প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। দলটা ঐ্যক্যবদ্ধ রাখতে আমরা তার বক্তব্যের অপেক্ষা করছিলাম। তার বক্তব্যের বিষয়টি কেন্দ্রীয় কমিটিকে জানানো হয়েছে। পাল্টাপাল্টি এ সমাবেশ নিয়ে উভয়পক্ষের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনাও ঘটে। ২৪ সেপ্টম্বর বিক্ষোভ সমাবেশের সামনে দিয়ে মেয়রপন্থিদের আনন্দ মিছিল যাওয়ার সময় ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। পরে দুইপক্ষের নেতাকর্মীদের ধাওয়া দিয়ে পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
এ সময় সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর মামুন মন্ডলকে সমাবেশস্থল থেকে তার বাড়িতে পৌঁছে দেয় পুলিশ। পরে বিক্ষোভকারীরা দৌড়ে আশপাশের সড়কগুলোতে চলে গেলে মেয়রবিরোধী বিক্ষোভকারীদের সমাবেশ পন্ড হয়ে যায়। এরপর বিক্ষোভকারীরা আর সমাবেশস্থলে ফিরতে পারেননি। এরপর সমাবেশস্থল মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের কর্মী-সমর্থকদের নিয়ন্ত্রণে থাকে। সন্ধ্যা ৬টায় মোনাজাতের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানিয়ে সিটি মেয়র জাহাঙ্গীর আলম তার সমাবেশ শেষ করেন।