ভ্যাট-আইন প্রবর্তনের জন্য স্মরণীয় হয়ে রয়েছেন খালেদা জিয়া ও সাইফুর রহমান
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০১:৫১ এএম, ১৩ সেপ্টেম্বর,সোমবার,২০২১ | আপডেট: ১১:৫৯ পিএম, ২২ নভেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের মাধ্যমে কার্যকর হয়েছিল ১৯৯১ সালে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পর। একটি স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটেছিল তখন ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমে। ঐ সংসদে সরকারি দলের নেতা ছিলেন বেগম খালেদা জিয়া ও বিরোধী দলের নেতা ছিলেন শেখ হাসিনা। এক ডজন জাতীয় বাজেট উপস্থাপনকারী অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান ’৯১-এর সংসদে যখন প্রথম ভ্যাট আইন পাস করার জন্য উপস্থাপন করেন, তখন তৎকালীন বিরোধী দল এর তুমুল বিরোধিতা করেছিল। করেছিল সংসদ বর্জনও। সংসদের ভেতরে-বাইরে তাদের ভ্যাটবিরোধী আন্দোলন মোকাবিলা করে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত বিএনপি এই ভ্যাট আইন প্রথম চালু করেছিল।
অবশেষে আওয়ামী লীগসহ সকল রাজনৈতিক দল এই ভ্যাট আইন মেনে নেয়। এখন জাতীয় সংসদে ভ্যাটের সুফল বর্ণনা করা হচ্ছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড তার রাজস্ব আয়ের অধিকাংশ অর্থই আয় করছে এখন এই ভ্যাট পদ্ধতিতে। তারা ভ্যাটের পক্ষে বেশ কিছু ছড়াও (সাহিত্য) প্রচার করে থাকে। কিন্তু এই ভ্যাট প্রবর্তনকারী বেগম খালেদা জিয়ার ব্যাংক একাউন্ট জব্দ করে রেখেছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীন এই রাজস্ব বোর্ড।
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র অ্যাডভোকেট ব্যারিস্টার শেখ জাকির হোসেন দীর্ঘদিন ধরে কোম্পানি আইনসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য আইন বিষয়ে আইনগত প্র্যাকটিস করেন। তার মতে, দেশি-বিদেশি ব্যবসায়ী যারা ভ্যাট আইনের আওতায় আসেন তাদের প্রতি সমান আইন প্র্যাকটিস করা উচিত। বিদেশিরাও যাতে আইনগত সুযোগ-সুবিধা পায়, তাহলে তারা এদেশের প্রতি বিনিয়োগে আগ্রহী থাকবেন।
কর আইনজীবীদের নেতা অ্যাডভোকেট আব্বাস উদ্দিন বলেন, ভ্যাট আইন চালু হয়েছিল প্রচন্ড বিরোধিতার মধ্যে। সেদিন যারা বিরোধিতা করেছিলেন, তারাও এখন এই আইনের ভক্ত হয়েছেন। এটা ভালো লক্ষণ। এই আইনের জন্য বেগম খালেদা জিয়া ও সাইফুর রহমান স্মরণীয় হয়ে রয়েছেন। অ্যাডভোকেট আবুল কাসেম আইন অনুশীলন সত্ত্বেও ২০-দলীয় জোটের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তিনি ভ্যাট আইনের অনুরক্ত, তবে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের প্রতি এই আইন ঢালাওভাবে প্রচলনের বিষয়ে সতর্কতার পক্ষে।
ভ্যাট-৭১ এবং অন্যান্য। ভ্যাট-৭১ একটি বিখ্যাত মদ।’ ৯১-এ যখন ভ্যাট আইন প্রবর্তন হচ্ছিল তখন কতিপয় আওয়ামী-বুদ্ধিজীবী ভ্যাট-৭১ এর মদ্য বোতল অংকিত ছবি পত্র-পত্রিকায় ছাপান। তারা ভ্যাট আইনের বিরুদ্ধে নানারকম অপপ্রচার চালিয়ে তা বিলম্বিত করেন। কারণ তখন পর্যন্ত প্রতিবেশী ভারতে আধুনিক ট্যাক্স আহরণ পদ্ধতি ভ্যাট চালু হয়নি। পরে হয়েছে।
এখন বাংলাদেশে ভ্যাট আদায়ে প্রতিবছর উৎসবের আয়োজন করা হয়। কিন্তু এই ভ্যাট পদ্ধতির কর আহরণ চালুর বিষয়টি বলা হয় না। অনেক রাজনীতিবিদ এই বিষয়টি মুখেও আনেন না।
অর্থনীতির প্রবাদপুরুষ সাইফুর রহমান একজন প্রখ্যাত চার্টার্ড একাউন্ট্যান্ট। স্বাধীনতা- উত্তরকালে রাষ্ট্রীয় একটি জাতীয় পর্যায়ের কর্মসূচিতে তার এসোসিয়েশনের প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। তৎকালীন উপ-সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানও ঐ সম্মিলনে যোগ দেন। সম্ভবত জিয়াউর রহমান ও সাইফুর রহমানের সঙ্গে প্রথম দেখা-সাক্ষাৎ এ সম্মিলনের মাধ্যমেই। পরবর্তীতে জিয়া সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী হিসেবে যোগ দেন সাইফুর রহমান। বেগম খালেদা জিয়া সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসেবেও ছিলেন এই সাইফুর রহমান। ১২টি জাতীয় বাজেট উপস্থাপনকারী এম সাইফুর রহমান উপমহাদেশে স্মরণীয় হয়ে রয়েছেন।
উল্লেখ্য, ১৯৭৬ সাল থেকে পর্যায়ক্রমে ৩টি জাতীয় বাজেট ঘোষণা করেছিলেন প্রেসিডেন্ট জিয়া।
ভ্যাট নিয়ে : ইদানীং ভ্যাট ফাঁকি দেয়ার একটি প্রবণতা দেখা দিয়েছে। ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আদায় করা হয়। কিন্তু ক্রেতাদের কাছ থেকে আদায় করে সরকারি রাজস্ব খাতে তা জমা দেয়া হয় না। কাস্টমস-ভ্যাট গোয়েন্দারা তা ধরে। শত শত কোটি টাকার ভ্যাট জমা না দেয়ার খবর প্রায়ই পত্রিকায় ছাপা হচ্ছে। একটি বড় অ্যাডভ্যাটাইজিং কোম্পানি কয়েকশ কোটি টাকার ভ্যাট জমা না দিয়ে বসেছিল। ভ্যাট-গোয়েন্দারা তা উন্মোচন করেন। ২৩১ কোটি টাকা ভ্যাট ফাঁকির অভিযোগে কে এস আর এম গ্রুপের নামে মামলা (দৈনিক দিনকাল ০৩-০৮-২১) শীর্ষক খবরে বলা হয় যে, ২০১৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত এই ভ্যাট জমা হয়নি। মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে মামলা থাকা জাহাজ কে এস আর এমের মালিকানাধীন খাজা শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডে জাহাজটি আটক করা হয়। এমন অনেক ভ্যাট-কার্যকর ঘটনা সম্প্রতি উদঘাটন হয়েছে।
এছাড়া বাংলাদেশে বহুজাতিক সংস্থার রমরমা ব্যবসার পাশাপাশি তাদের কাছ থেকে ভ্যাট আদায় শুরু হয়েছে। এতদিন তা হয়নি কেন, এমন প্রশ্নও উঠতে পারে। পাশাপাশি ছোট ছোট ব্যবসায়ীদের ভ্যাট প্রদানে জোরাজুরি করা হচ্ছে। ব্যবসা ভালো নয় বলে তারা সরকারের সহায়তা চায় বলে জানা যায়।
ভ্যাট সবার জন্য সমান-ব্যারিস্টার জাকির : এসব বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সেক্টরে অনেক কথা রয়েছে। ব্যারিস্টার শেখ জাকির হোসেন সুপ্রিম কোর্টে প্র্যাকটিস করেন। তার কাছে জানতে চাওয়া হয় এ বিষয়ে। তিনি বলেন, দেশি বা বিদেশি যারাই ভ্যাট প্রদানযোগ্য ব্যবসা করেন, তাদের ভ্যাট দিতে হয়। কিন্তু জোরাজুরি করা ঠিক নয়। আইনানুযায়ী ভ্যাট আদায় করা উচিত বলে তিনি মন্তব্য করেন। ভ্যাট আদায়ে অন্যায় হলে বিদেশিরা ভুটান-নেপাল-ভিয়েতনামে চলে যাবে।
ব্যারিস্টার শেখ জাকির হোসেন আরো বলেন, ভ্যাট আইন একটি আধুনিক কর আদায় পদ্ধতি। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় এই আইনের অগ্রণী দেশ। কিন্তু এটি প্রয়োগের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত এর সতর্ক প্রয়োগ। বিশেষ করে বিদেশি পুঁজি বিনিয়োগকারীদের ক্ষেত্রে। আইন অনুযায়ী এর প্রয়োগ হওয়া উচিত বলে তিনি মন্তব্য করেন।
ভ্যাটের জন্য খালেদা জিয়া-সাইফুর স্মরণীয়-অ্যাড. আব্বাস : অ্যাডভোকেট আব্বাস উদ্দিন জাতীয়তাবাদী কর আইনজীবী নেতা। তবে পেশাগতভাবে কর বিশেষ করে ভ্যাট বিষয়ে লেখালেখিও করেন। এক্ষেত্রে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমানের প্রশংসা করেন ভ্যাট প্রবর্তনের জন্য। এই আইনের মাধ্যমে তারা দেশের অর্থনীতিতে একটি শক্তিশালী ভিত্তি উপহার দিয়ে গেছেন বলে মন্তব্য করেন তিনি। বর্তমানে জাতীয় অর্থনীতির প্রধান জোগানদারই হচ্ছে ভ্যাটজনিত কর আদায় বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি দরকারÑ অ্যাড. কাসেম : অ্যাডভোকেট আবুল কাসেম বাংলাদেশ ইসলামিক পার্টির সাধারণ সম্পাদক। ২০ দলীয় জোটের সদস্য ইসলামিক পার্টির পক্ষ থেকে বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নেন। তবে একজন কর আইনজীবী হিসেবে ছোট-বড় ব্যবসায়ীদের জন্য বড় সহায়তা দিয়ে থাকেন। তিনি বলেন, ছোট ছোট ব্যবসায়ীরা ভ্যাটের নামে নির্যাতনের শিকার। আয় না হলে তারা কর দেবেন কিভাবে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত এ বিষয়ে সতর্ক দৃষ্টি রাখা। অ্যাড. আবুল কাসেম বলেন, ভ্যাট একটি যুগান্তকারী আইন বটে, এর জন্য বেগম খালেদা জিয়া স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।