জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে সরকারের মিথ্যাচার জনগণ বিশ্বাস করবে না - মির্জা ফখরুল
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০১:৪৯ এএম, ১৯ আগস্ট,বৃহস্পতিবার,২০২১ | আপডেট: ০৯:৩৮ পিএম, ২২ নভেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে সরকারের মিথ্যাচার জনগণ বিশ্বাস করবে না বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
আজ বুধবার বিকালে এক ভার্চুয়াল আলোচনা সভায় তিনি এ মন্তব্য করেন। বিএনপির উদ্যোগে ‘ইতিহাস কথা কয়’ শীর্ষক এই আলোচনা সভা হয়। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
মির্জা ফখরুল বলেন, সত্য কথাটা উঠে আসুক এ জন্য আজকে আমরা ‘ইতিহাস কথা কয়’ বলে এই অনুষ্ঠান করছি। আমাদের মনে রাখতে হবে, আওয়ামী লীগ একটি তাঁবেদার রাজনৈতিক দল। আওয়ামী লীগের সরকার একটা পতুল সরকার। তাদের সঙ্গে জনগণের কোনো সম্পর্ক নেই, জনগণ বিচ্ছিন্ন একটি সরকার। সেই কারণে তারা মিথ্যা দিয়ে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে চায়। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সম্পর্কে মিথ্যা কথা বললে কেউ বিশ্বাস করবে না। কারণ জিয়াউর রহমান সাহেব শুধু স্বাধীনতার ঘোষণাই দেননি তিনি পরবর্তীকালে যখন দায়িত্ব পেয়েছেন তাঁর কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে এই দেশের মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন। তিনি চিরভাস্বর হয়ে আছেন।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, প্রতিহিংসায় এই সরকার মুক্তিযুদ্ধের বিকৃত ইতিহাস প্রতিষ্ঠার বহুমুখী প্রচারণা চালাচ্ছে। আজকে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের হত্যা করা হচ্ছে, গুম করা হচ্ছে, মিথ্যা মামলার শিকারে পরিণত করা হচ্ছে। আর এই যে আক্রমণ, এই আক্রমণের পাল্টা জবাব হিসেবে সত্য জানার অধিকার ও প্রকৃত ইতিহাস চর্চার সংস্কৃতিকে গোটা জাতির তার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থে আমাদের জীবন্ত রাখতে হবে। সেই লক্ষ্যেই বিএনপি সরকারের ইতিহাস বিকৃতির লাগাতার সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ‘ইতিহাস কথা কয়’ এই শিরোনামে বিএনপির সকল গণতান্ত্রিক শক্তিকে সম্পৃক্ত করতে চায়। যতদিন বিকৃতির তৎপরতা চলবে ততদিনই এই লড়াইয়ে চলবে। যখন ইতিহাসের ঘটনাকে তারা দলীয় বয়ানে প্রতিষ্ঠায় লিপ্ত হবে তখনই ইতিহাস বিকৃতির বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ নিয়ে হাজির হবে ‘ইতিহাস কথা কয়’। এই লড়াই চলমান ফ্যাসিবাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক লড়াইয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ। পঁচাত্তরের ঘটনার সাথে জিয়াউর রহমানকে জড়িয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের দেয়া বক্তব্যকে ‘মিথ্যা, ভিত্তিহীন ও রাজনৈতিক দুরভিসন্ধিমূলক অপপ্রচার’ বলে নিন্দা জানান বিএনপি মহাসচিব।
আইনমন্ত্রীর বক্তব্য ’৭৫ সালের ১৫ আগস্টের রায়কেও অবশ্যই প্রশ্নবিদ্ধ করছে। কারণ ১৫ আগস্ট তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের অধিকাংশ সদস্য হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিলেন, যা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি অপরাধমূলক ঘটনা। কিন্তু অপরাধমূলক ঘটনার বিচার উক্ত প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ঘটনার ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে এজাহার দায়ের করে তার ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্বের সাথে তদন্ত করে সুদীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়ায় সাক্ষী-সাক্ষ্য পর্যালোচনা করে বিচার কার্য সম্পন্ন করেছে। ওই বিচার প্রক্রিয়ার পর ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ড সম্পর্কে ‘পাস্ট এন্ড ক্লোজ চাপ্টার’কে পুনরায় বিতর্কের বিষয় হিসেবে তুলে এনে আইনমন্ত্রী জ্ঞানপাপীর পরিচয় দিচ্ছেন। তার এই ধরনের বক্তব্য থেকে প্রশ্ন জাগে, ওই বিচার প্রক্রিয়ায় সম্পূর্ণভাবে জড়িত থেকে আওয়ামী লীগের ভাষায় ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার পর এই ধরনের বক্তব্য কেন দিচ্ছে? এই ধরনের বক্তব্য কি ক্রিমিনাল এক্সিকিউশনের পর্যায়ে পড়ে না?
বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরলে আওয়ামী লীগ ভয় পায়। বাংলাদেশের মৌলিক প্রশ্নে মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে দেশের উন্নয়ন, দেশকে স্বনির্ভর করা, দেশকে সম্মানজনক অবস্থানে নেয়া, মাথা উঁচু দাঁড়াবার জন্য দেশকে প্রস্তুত করা এসব কারা করেছে?
সবগুলোতেই শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, বিএনপি ও বেগম খালেদা জিয়ার সফলতা। সে জন্যই তারা সত্য ইতিহাসকে ধামাচাপা দেয়ার জন্য, জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্য, এই প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করার জন্য ইতিহাসকে বিকৃতি করছে। আওয়ামী লীগ ১৫ আগস্ট আসলে নিজেদের তৈরি কথা জনগণকে বিশ্বাস করাতে চেষ্টা করে। সেখানেই আমাদের প্রতিবাদ, সেখানে আমাদের সত্য কথা বলার প্রয়োজনীয়তা। সত্য যদি প্রকাশিত হয় তাহলে আওয়ামী লীগের রাজনীতির অস্তিত্ব থাকে না, সে জন্য আজকে উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপাতে তারা চেষ্টা করছে। আওয়ামী লীগকে বলব, সময় বেশি নেই, একদিন আপনাদেরকেই ইতিহাস বিকৃতির জন্য জনগণের কাছে জবাব দিতে হবে।’
দলের ভাইস চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত মেজর হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘এই শাসকগোষ্ঠী ১৯৭১ সালের মহান শৌর্য-বীর্জের ইতিহাসকে ভুলিয়ে দেয়ার জন্য চেষ্টা করছে। তারা দেশবাসীকে বুঝাতে চায় যে, একটা ভাষণ দিয়েছে তাদের নেতা এতেই দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। এই যে লাখ লাখ মানুষ জীবন দিলো, একটি আধুনিক সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে জীবনপণ করে বিজয় ছিনিয়ে নিলো এই কৃতিত্ব কাউকে দিতে চায় না তারা। স্বাধীনতার ঘোষণা তো একজন রাজনৈতিক নেতার মুখ থেকেই আমরা আশা করেছিলাম। তিনি বা তারা দিতে পারেননি, দিয়েছেন এক অখ্যাত মেজর জিয়াউর রহমান। এই কারণে তারা ক্ষিপ্ত, আমরা যেটা পারিনি, তুমি পারতে গেলে কেন? এই হীনমন্য থেকে তারা ইতিহাস বিকৃত করছে ১৯৭২ সাল থেকেই। সর্বশেষে তারা শুরু করেছে, জিয়াউর রহমান মুজিব হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত। তারা ভেবেছে, ৫০ বছরের কাছাকাছি গত হয়েছে। সুতরাং এখন এই ধরনের মিথ্যাকে সত্য করার সময় এসে গেছে। মিথ্যা প্রচারণার মাধ্যমে গোয়েবলসীয় কায়দায় জিয়াকে একটা হত্যাকারী, ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে জনগণের সামনে প্রতিপাদ্য করার জন্য তারা এই উদ্যোগ নিয়েছে।’ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের সময়ে সেনাবাহিনীর ৪৬তম ব্রিগেডের কর্মরত ব্রিগেড মেজর হাফিজ উদ্দিন দাবি করে বলেন, ‘ওই ঘটনার দিন ভোরে ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল সাফায়েত জামিলসহ আমি সেনাবাহিনীর উপপ্রধান জিয়াউর রহমানের বাসায় গিয়ে দেখা করি। তাকে কর্নেল সাফায়েত বললেন, স্যার প্রেসিডেন্ট হেডবিন কিল্ড। জেনারেল জিয়াউর রহমানের রিঅ্যাকশন দেখেন- সাচ এ সোলজার।
তিনি বললেন, প্রেসিডেন্ট নেই তো কি হয়েছে। ভাইস প্রেসিডেন্ট আছে। আমরা সৈনিক লেট আস আপহোল্ড দি কনস্টিটিউশন, আমরা সংবিধানকে সমুন্নত রাখবো। গো এন্ড গেট ইউ ট্রুপস রেডি। তিন বছর আগে সাফায়েত জামিল মৃত্যুবরণ করেছেন। তিনি একটি বই লেখেছেন, সেখানে এই ঘটনাটির বিবরণ দেয়া আছে। অবসরপ্রাপ্ত অফিসার হিসেবে কর্নেল সাফায়েত জামিল কোনো রাজনীতিতে জড়াননি, কিন্তু আওয়ামী লীগের প্রতি দুবর্লতা ছিল। তারপরও তিনি ১৫ আগস্ট সকাল সাড়ে ৬টা থেকে ৭টার মধ্যে এই ঘটনাটি লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন। আমি ক্ষুদ্র ব্যক্তি, আমার বইতেও এই বিবরণ আছে। আমরা চাক্ষুস সাক্ষী সেদিন তিনি (জিয়া) কি বলেছেন সেদিন।’
তিনি বলেন, ‘জিয়াউর রহমান একজন সৈনিক ছিলেন, যিনি সংবিধান সমুন্নত রাখার চেষ্টা করেছিলেন। আমাদেরকে বলেছিলেন, গো এন্ড গেট ট্রুপস রেডি। তাদের নেতাকে (শেখ মুজিবুর রহমান) মহান নেতা বলে সম্বোধন করেছিলেন। জীবনে কোনোদিন রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরে কখনো আওয়ামী লীগের নেতা বা তাদের যারা শীর্ষ পর্যায়ে রয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে কোনোদিন কোনো কটূক্তি করেননি। এই ধরনের একজন সাদা মনের মানুষকে আজকে তারা খুনি হিসেবে দেশবাসীর সামনে উপস্থাপন করতে চায়। কি দুর্ভাগ্য তাদের, কী দুর্ভাগ্য আমাদের। আমি বলব, এখনো সময় আছে শিক্ষা নেয়ার। আফগানিস্তানে কি হয়েছে- এটা থেকে শিক্ষা নেয়ার চেষ্টা করেন। অনেককে কিন্তু হেলিকপ্টারের ডানা ধরে ঝুলতে হবে। আফগানিস্তান থেকে আমরা কী শিক্ষা নিতে পারছি যে, জনগণের জয় একদিন না একদিন হবেই। দেশের অধিকাংশ জনগণ যাকে সমর্থন করবে, যে দল বা যে আদর্শকে সমর্থন করবে এটিকে কোনোদিন দাবিয়ে রাখা যায় না। যার জন্যে পৃথিবীর সবচেয়ে সর্বশক্তিমান পরাশক্তিকেও আফগানিস্তান থেকে যেতে হয়েছে।’
কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বলেন, জিয়া সম্পর্কে এই ক্ষমতাসীন দলটি প্রথম থেকেই হীনম্মন্যতায় ভোগে এবং তাঁর অবদানকে কোনোভাবে তারা সহ্য করতে পারে পারে না। প্রায় ৪৯ বছর পর স্মৃতিচারণ করে বুঝতে পারি সেই আমল থেকে রাজনৈতিক সরকার শহীদ জিয়াকে উপযুক্ত মূল্যায়ন না করে অপদস্থ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শহীদ জিয়ার দেশপ্রেম উদাহরণ সৃষ্টি করে এবং বাংলাদেশে পুনর্গঠনে অবদান রাখার স্বার্থে চাকরি অব্যাহত রাখেন। যাদের বয়স কম তাদের মনে করিয়ে দিচ্ছি, ১৯৭২ সালের এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী বা বাংলাদেশ ফোর্সকে তিন খন্ড করে আলাদা আলাদা সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী করা হয়েছিল এবং সেই সেনাবাহিনী প্রধানের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল তৎকালীন কর্নেল কাজী মো. শফিউল্লাহ এবং উপ-সেনাপ্রধান করা হয়েছিল জিয়াউর রহমানকে। কিন্তু জ্যেষ্ঠতায় জিয়াউর রহমান ছিলেন অগ্রাধিকার পাওয়ার হকদার। এখন অনুমান করছি, কেন এই কাজটি করা হয়েছিল। কারণ জিয়াউর রহমানের ক্যারিমাকে তারা ভয় পেতেন, আজও ভয় পাচ্ছেন যার জন্য বর্তমানের সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ তার নামে অপবাদ দিয়ে যাচ্ছেন। আমি বলব, অপপ্রচার থেকে বিরত থাকুন, অযথা দেশে বিভাজন সৃষ্টি করবেন না।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সভাপতিত্বে ও প্রচার সম্পাদক শহিদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানীর সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় আরো বক্তব্য রাখেন বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, সেলিমা রহমান, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু প্রমুখ।