অকার্যকর লকডাউন নিষ্ঠুর রসিকতায় পরিণত হয়েছে - মির্জা ফখরুল
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০১:০৪ এএম, ৯ জুলাই,শুক্রবার,২০২১ | আপডেট: ১১:১৫ এএম, ১৯ নভেম্বর,মঙ্গলবার,২০২৪
অকার্যকর লকডাউন নিষ্ঠুর রসিকতায় পরিণত হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ মন্তব্য করেন। সারাদেশে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সরকারকে এখনই জাতীয় আপতকালীন পরামর্শ কমিটি গঠনসহ পাঁচটি সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানিয়েছে বিএনপি।
মির্জা ফখরুল আরও বলেন, বৈশ্বিক মহামারি করোনা মোকাবিলায় রোডম্যাপহীন বাংলাদেশ। পরিকল্পনাহীন লকডাউনে বিপর্যস্ত ‘দিন আনে দিন খায়’ শ্রেণির কর্মহীন মানুষের দৈনন্দিন জীবন। সরকারকে দরিদ্রদের নগদ এককালীন ১৫ হাজার করে টাকা এবং খাদ্য সহায়তা দিতে হবে। করোনাকালীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে এবং অক্সিজেন সিলিন্ডারসহ প্রয়োজনীয় সব উপকরণ নিশ্চিত করতে হবে।
মির্জা ফখরুল বলেন, বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের ভয়াবহ আঘাতে মৃত মানুষের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ১৫ হাজার। গত কয়েকদিন পরীক্ষার বিপরীতে রোগী শনাক্ত দাঁড়িয়েছে ৩১.৩২ শতাংশের বেশি। সীমান্তবর্তী জেলাসমূহে এই হার প্রায় ৫০-৭০ শতাংশের কাছাকাছি। গত এক দিনে মৃতের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ২০১ ছাড়িয়েছে। সমগ্র বিশ্বের করোনা শনাক্তের তুলনামূলক বিচারে বর্তমানে সর্বোচ্চ মাত্রায় রয়েছে বাংলাদেশ। মহামারি ব্যবস্থাপনায় সরকারের উদাসীনতা ও বিজ্ঞানমনস্ক নীতি প্রণয়নে চরম ব্যর্থতার ফলে দেশের করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থায় উপনীত হয়েছে। একদিকে অক্সিজেনের অভাবে করোনা রোগীর অকাল মৃত্যু, আইসিউ সুবিধার অভাব, হাসপাতালের চিকিৎসার জন্য ন্যূনতম বেড পাচ্ছে না এবং প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক ও ওষুধের অভাবে জনগণের মধ্যে রীতিমত আতংকের সৃষ্টি করেছে, অন্যদিকে নগদ আর্থিক সহায়তা বা খাদ্যের ব্যবস্থা না করে “লকডাউনে” মানুষকে ঘরে বন্দি থাকতে বাধ্য করার মধ্য দিয়ে “বৈশ্বিক করোনা মহামারির” সাথে এদেশের মানুষের ঘাড়ে “অব্যবস্থাপনাজনিত মহামারি” চাপিয়ে দিয়েছে বর্তমান ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার। ‘লকডাউন’ বর্তমানে অকার্যকর নিষ্ঠুর রসিকতায় পরিণত হয়েছে। চলমান লকডাউন যেন বেকার হয়ে পড়া কোটি কোটি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে খাদ্যাভাবে মারার অমানবিক হাতিয়ার।
তিনি বলেন, দরিদ্র মানুষের জন্য খাদ্য সহায়তা নিশ্চিত না করেই দেশব্যাপী ‘কঠোর লকডাউন’ চাপিয়ে দেয়ার সরকারের হঠকারী সিদ্ধান্তে বিশেষ করে দিন আনে দিন খায়- এ শ্রেণির মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়েছে। নগদ অর্থ সহযোগিতা কিংবা খাদ্য সহায়তা ছাড়া অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের কোটি কোটি দরিদ্র মানুষকে ঘরে আটকে রাখা রীতিমতো মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল। বাংলাদেশে গত বছরের ২৬ মার্চ থেকে টানা লকডাউনের নামে সাধারণ ছুটি এবং এ বছরের ৫ এপ্রিল থেকে কার্যকর করা লকডাউনে কোটি কোটি কর্মহীন মানুষ খাদ্য ও চিকিৎসা সেবা বঞ্চিত হয়ে চরম মানবেতর জীবনযাপন করছে। এর মধ্যে গত ১ জুলাই থেকে প্রথমে ৭ দিন এবং পরবর্তীতে আরও ৭ দিন সর্বাত্মক লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। গণপরিবহন বন্ধ। কিন্তু শিল্প কল-কারখানা খোলা। সরকার কঠোর অবস্থানে যাওয়ায় দিনমজুর ও খেটে খাওয়া নিম্ন আয়ের মানুষ মহাসংকটের সম্মুখীন হয়েছে। পরিস্থিতির ভয়াবহতা উঠে আসে গত ৪ জুলাই ২০২১ তারিখে দ্যা ডেইলি স্টার পত্রিকার বাংলা সংস্করণে প্রকাশিত একটি সংবাদ হেডলাইনে ‘যদি কিছু টাকা পাওয়া যায়, আরেকটা দিন খেতে পারব’। সংবাদে ষাটোর্ধ্বো মোঃ নাজিম উদ্দিন, পেশায় পোশাক বিক্রেতার বেঁচে থাকার তীব্র আকুতি তুলে ধরা হয়েছে। লকডাউনের আগে তিনি পাঁচ কেজি আটা কিনেছিলেন। তিন দিনে দুই কেজি শেষ। তিন কেজি আর কতদিন চলবে, সেই দুশ্চিন্তায় বাধ্য হয়েই লকডাউনের মাঝেই কিছু মাস্ক বিক্রয়ে বসেছেন। “যদি কিছু টাকা পাওয়া যায়, তাহলে আরেকটা দিন কিছু খেতে পারবেন”। এই নাজিম উদ্দিন গতকাল সরকারের অপরিকল্পিত লকডাউনের শিকার এদেশের কোটি কোটি দরিদ্র মানুষের প্রতিচ্ছবি।
তিনি আরো বলেন, নাজিম উদ্দিন তবুও বেঁচে থাকার তীব্র আকাক্সক্ষায় লকডাউনের মাঝেও কয়েকটা দিন খাওয়ার আশায় মাস্ক বিক্রি করতে বের হওয়ার মানসিক শক্তি ধরে রাখতে পেরেছেন। কিন্তু ৪ জুলাই, ২০২১ অনলাইন নিউজ পোর্টাল “জাগো নিউজে” প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছে, দিনমজুর দ্বীন ইসলাম অভাবের তাড়নায় আত্মহত্যা করেছে। “করোনায় কাজ না থাকায় সংসারে অভাব, দিনমজুরের আত্মহত্যা” শিরোনামে সংবাদের বিস্তারিত বিবরণে আত্মাহুতি দেয়া নিহত দ্বীন ইসলামের মা জুলেখা বেগমের করুণ আহাজারিতে লকডাউনে অভাবগ্রস্ত কর্মহীন মানুষের শেষ পরিণতির করুণ চিত্র প্রকাশিত হয়েছে।
মা জুলেখা বেগম বলেন, “আমাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায়। লকডাউনে কাজ ছিল না। ওর মাইয়া চাইব একটা রুটি, এই পোলা চাইব ভাত, এটি নিয়ে সংসারে সমস্যা। কাজ নাই, পুলাপাইনের মুখে ভাত দিতে পারে না, তাই অভিমানে মরে গেছে”। এ হচ্ছে সরকারের অপরিকল্পিত, সমন্বয়হীন ও দায়িত্বহীন লকডাউনের ফলে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে খেটে খাওয়া কর্মহীন মানুষের বর্তমান মর্মান্তিক চিত্র।
সরকারের সমালোচনা করে মির্জা ফখরুল বলেন, সরকারের অপরিকল্পিত ও অমানবিক লকডাউনের সিদ্ধান্ত এদেশের কোটি কোটি “দিন আনে দিনে খায়” মানুষের সকলের জীবনই স্থবির করে ফেলেছে। আমরা সকলেই জানি, যে কোনো দেশেই যদি প্রকৃত অর্থে লকডাউন বাস্তবায়ন করতে হয়, তাহলে এর ফলে যারা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, আগে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তাদের খাদ্যের ব্যবস্থা করতে হবে। অন্যথায় পেটের জ¦ালায় মানুষকে ঘরে আবদ্ধ করে রাখা অসম্ভব এবং তাতে লকডাউনের উদ্দেশ্যই ব্যাহত হতে বাধ্য।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে পাঁচ কোটিরও বেশি মানুষ কাজ করে। যারা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত। এর বাইরে আমরা যদি দোকান কর্মচারী কিংবা পরিবহন খাতের লোকজনদের ধরি, তারাও একটা বড় অংশ। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) সাম্প্রতিক এক জরিপের ফলাফল বলছে, কোভিডের আঘাতে দেশে নতুন করে দরিদ্র হয়েছে দুই কোটি ৪৫ লাখ মানুষ। গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের দেশব্যাপী খানা জরিপের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনার প্রভাবে দেশে সার্বিক দারিদ্র্যের হার (আপার পোভার্টি রেট) বেড়ে ৪২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অথচ এদের দৈনন্দিন জীবন প্রবাহকে অব্যাহত রাখতে যে নগদ অর্থ বা খাদ্য সহায়তা কর্মসূচি সরকারের অগ্রাধিকার তালিকায় থাকা উচিত ছিল, বর্তমান গণবিচ্ছিন্ন সরকার তার প্রয়োজনীয়তাই অনুভব করেনি। যার ফলশ্রুতিতে ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া “লকডাউনে” দরিদ্র কর্মজীবী মানুষের জীবিকা নির্বাহের সব পথ “শাটডাউন” হয়ে গেছে। তাই খাদ্য সহায়তা ছাড়া ঘোষিত এই লকডাউন একদিকে যেমন করোনা মহামারিকালে অসহায় মানুষের প্রতি সরকারের অমানবিক আচরণের বহিঃপ্রকাশ, অন্যদিকে আদৌ এ লকডাউন কার্যকর হবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ বিষয়ে আমরা প্রথমেই এসব মানুষের প্রত্যেককে এককালীন ১৫,০০০ টাকা করে দেয়ার আহবান জানিয়েছিলাম। অতীতে যত লকডাউন হয়েছে তাতে দেখা গেছে “দিন আনে দিন খায়” মানুষ সবচেয়ে বেশি কষ্ট করে। তাদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারায় ক্ষুধার তাড়নায় এসব মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছে। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য নগদ অর্থ/ন্যূনতম খাদ্য সহায়তা নিশ্চিত না করেই কঠোর লকডাউন আরোপের সিদ্ধান্ত কোনোক্রমেই যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নয় এবং এটা ফলপ্রসূও হবে না। কারণ লকডাউন কার্যকর করতে গেলে তার পূর্বশর্তগুলো পূরণ করতে হয়। পৃথিবীর প্রায় সকল দেশই লকডাউনে দরিদ্র শ্রেণির জনগোষ্ঠীকে টিকে থাকার জন্যে কয়েক মাস ধরে লাগাতারভাবে সাপোর্ট দিয়ে গেছে। ইংল্যান্ডে লকডাউনের কারণে যারা বেতন পায়নি তাদের জন্য সরকার আইন করে সহায়তা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশেও নাগরিকদের একাউন্টে আগে নগদ অর্থ জমা দিয়ে অর্থাৎ খাদ্য সহায়তা নিশ্চিত করে লকডাউন কার্যকর করা হয়েছে। বাংলাদেশেও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে নগদ অর্থ সহায়তা দিলে দেখা যেত, এই জনগোষ্ঠীর কেউ আর ঘর থেকে বের হবে না। নগদ অর্থ বা খাদ্য না দিয়েই যদি তাদের ঘরে আবদ্ধ থাকতে বলা হয়, তাতে একটা ডেসপারেট সিচুয়েশন তৈরি হতে বাধ্য। মানুষ তথন টিকে থাকার প্রয়োজনে নানা ধরনের পথ খুঁজবে- এটাই স্বাভাবিক।
সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব বলেন, বাংলাদেশের বর্তমান সরকার কার্যকর অর্থেই একটা অমানবিক সরকার, তা এবার কঠোর লকডাউনে দরিদ্র মানুষের জন্য বরাদ্দকৃত সহায়তার অর্থের অংকেই বোঝা গেছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে গত ২৭ জুন লকডাউনে দরিদ্র, দুস্থ, অসচ্ছল ও কর্মহীন জনগোষ্ঠীকে মানবিক সহায়তা দিতে ৬৪ জেলার অনুকূলে মাত্র ২৩ কোটি ছয় লাখ ৭৫ হাজার টাকা ও পরবর্তীতে আরো ১১ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। বলা হয়েছে ৩৩৩ নম্বরে ফোন করলে মানবিক সহায়তা পাওয়ার মতো যোগ্য ব্যক্তিদের এই বরাদ্দ থেকে খাদ্য-সহায়তা দেয়া হবে, যার মধ্যে থাকবে ১০ কেজি চাল, এক কেজি তেল, এক কেজি ডাল, পাঁচ কেজি আলু ও এক কেজি লবণ। মূল্য নির্ধারণ হিসেবে টাকার অংকে যা ১০০০ টাকার মতো দাঁড়াবে। বরাদ্দকৃত মোট অর্থের বিপরীতে সর্বোচ্চ ৩ লাখ ৩০ হাজার মানুষের মাঝে খাদ্য সহায়তা দেয়া সম্ভব। যেখানে করোনাকালে দুই কোটির বেশি মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে। এর সঙ্গে যদি আগের সংখ্যা যুক্ত করা হয়, তাহলে কমপক্ষে পাঁচ-ছয় কোটি হবে। তাহলে কঠোরতম এই লকডাউনে সরকার ঘোষিত বরাদ্দকৃত অর্থ একেক জনের ভাগে চার থেকে পাঁচ টাকার বেশি পড়ার কথা নয়। যা মহামারিকালে জনগণের সাথে স্রেফ তামাশা ছাড়া আর কিছু নয়। তাছাড়া ৩৩৩ নম্বরে ফোন করার কথা উঠলেই তো নারায়ণগঞ্জের হোসিয়ারি কারখানার অল্প বেতনে কাজ করা সেই শ্রমিক ফরিদের বিড়ম্বনার কথা মানুষ ভুলে যায়নি। তিনি ৩৩৩ নম্বরে ফোন করে গোপনে খাদ্য সহায়তা চাইলে সহায়তা তো পানইনি, বরং তাকে জেলে নেয়া হয়, মিথ্যা অপবাদ দেয়া হয়। সেই ভয়ে মানুষ ৩৩৩ নম্বরে ফোন করবে কিনা সে আশংকা তো রয়েছেই। তবে চলমান বিধিনিষেধের মধ্যে খাবার ও ত্রাণ সহায়তার জন্য গত ১১ দিনে ১৯ লাখেরও বেশি কল এসেছে জাতীয় তথ্য সেবার ‘৩৩৩’ নম্বরে। এদের মধ্যে মাত্র ৫৯ হাজার ১৬৪টি পরিবারকে সরকারি সহায়তা দেয়া হয়েছে (দ্যা ডেইলি স্টার ৬ জুলাাই, ২০২১)। অপরদিকে গণমাধ্যমে আসা বিভিন্ন খবর বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, লকডাউনের বিধিনিষেধ ভেঙে গত কয়েক দিনে যারা গ্রেফতার হয়েছেন, তাদের বেশিরভাগই দরিদ্র, খেটে খাওয়া মানুষ (দ্যা ডেইলি স্টার ৬ জুলাই, ২০২১)। করোনা মহামারি একটা সর্বাত্মক যুদ্ধ। আর যুদ্ধ বিজয়ের অন্যতম পূর্বশর্ত হচ্ছে সৈনিকদের অস্ত্রসজ্জিত করে সুনির্দিষ্ট যুদ্ধকৌশল বা রোডম্যাপ প্রণয়ন করা। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় করোনা ভয়াবহতায় সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই তিনি করোনা যুদ্ধে বিজয়ের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ দিয়েছেন। যেমন এক, দায়িত্ব গ্রহণের ১০০ দিনের মধ্যে ১০ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন প্রদান ও দুই, পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তিদের ৭০ শতাংশকে ৪ জুলাইয়ের মধ্যে করোনার অন্তত এক ডোজ টিকা দেয়ার বিষয় নিশ্চিত করা ও মার্কিন স্বাধীনতা দিবসের দিনে করোনা থেকে মুক্তির উৎসব উদযাপন করা। এই লক্ষ্যমাত্রা পুরোপুরি অর্জন করতে না পারলেও অনেকাংশেই এর কাছাকাছি পৌঁছেছে যুক্তরাষ্ট্র। এই সাফল্যের পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ তার প্রশাসনের নেয়া ভ্যাকসিন কর্মসূচি। একই সঙ্গে বাইডেন প্রশাসন করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত দেশের অর্থনীতির পুনরুদ্ধার ও করোনায় সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীর সুরক্ষায় ১ দশমিক ৯ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের ঐতিহাসিক আমেরিকান রেসকিউ প্ল্যান কংগ্রেসের অনুমোদনক্রমে বাস্তবায়নে উদ্যোগী হয়েছেন। মোটকথা জো বাইডেন করোনা যুদ্ধে বিজ্ঞানের সর্বাত্মক সহায়তায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জনগণকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। অন্যদিকে, বাংলাদেশের ভোট ডাকাত সরকার করোনা যুদ্ধে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা তো নেয়ইনি, বরঞ্চ ব্যক্তিগত আচার আচরণ, হিংসা ছড়ানো ও বাগাড়ম্বরের মাধ্যমে জাতিকে ভয়াবহ বিভক্তির দিকে ঠেলে দিয়ে করোনা যুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করার পরিবেশ বিনষ্ট করেছেন। সম্প্রতি জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মিথ্যা ও উদ্দেশ্যমূলক মিথ্যাচার যুদ্ধকালীন সময়ে একজন অদক্ষ সেনাপতির আচরণের সমতুল্য। অথচ বিএনপির পক্ষ থেকে আমরা প্রথম থেকেই জাতীয় ঐক্যের মাধ্যমে একসাথে সুচিন্তিত পরিকল্পনা নিয়ে এ বৈশ্বিক মহামারি মোকাবিলার আহবান জানিয়েছিলাম এবং বিকল্প প্রণোদনা ও বাজেট বরাদ্দের প্রস্তাব করেছিলাম।
বিএনপির এই সিনিয়র নেতা বলেন, বিএনপি বিভিন্ন সময়ে করোনার প্রথম ঢেউ, দ্বিতীয় ঢেউ, এমনকি তৃতীয় ঢেউ আসার আগেই এমনকি প্রাক বাজেট বক্তব্যেও করোনা মোকাবিলায় বিএনপির রোডম্যাপ/সুপারিশ তুলে ধরেছিল। আমরা সুস্পষ্টভাবে বলেছিলাম, লকডাউনে ক্ষতিগ্রস্ত দিন আনে দিন খায় এ শ্রেণির প্রায় ৬ কোটি হতদরিদ্র প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের প্রায় ৫ লক্ষাধিক শ্র্রমিক, করোনার কারণে নতুন করে গরিব হয়ে পড়া আড়াই কোটি মানুষ, যে সকল নিম্নমধ্যবিত্ত দরিদ্রের কাতারে নেমে পড়েছে এবং যারা চক্ষুলজ্জায় হাত পাততে পারে না এমন শ্রেণির মানুষের কাছে নগদ অর্থ সহায়তা (cash transfer) পৌঁছাতে, যাতে তারা অন্তত দু মুঠো খেয়ে বেঁচে থাকতে পারে। কিন্তু সরকার তাতে কর্ণপাত করেনি। নতুন দরিদ্র ও বেকারত্বের দৈত্য থেকে জাতিকে উদ্ধার করতেই হবে। কোভিডের কারণে বেকার হয়ে পড়া কর্মহীন অসহায় দরিদ্র জনমানুষের কাছে খাদ্য সহযোগিতা এবং হাতে cash transfer করতে না পারলে তারা না খেয়ে মারা যাবে। ভোটারবিহীন জনবিচ্ছিন্ন এ সরকারের জনগণের কাছে কোনো দায়বদ্ধতা বা জবাবদিহিতা না থাকায় তারা বেপরোয়া হয়ে পড়েছে। সরকার জনগণের টাকা জনগণকে দিচ্ছে না, অথচ অযৌক্তিকভাবে ১ কোটি টাকার প্রকল্প ২ কোটি টাকায় বাস্তবায়ন করে এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে প্রকল্প সময় বৃদ্ধির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ হরিলুট করে বিদেশে পাচার করে দিচ্ছে। আবার মোবাইল ফোনের মাধ্যমে জনপ্রতি ২৫০০ টাকা প্রদানের ক্ষেত্রে সংঘটিত দুর্নীতি আর হতদরিদ্রের জন্য বরাদ্দকৃত ত্রাণ সামগ্রী চুরির কাহিনী- এসব দেখে মনে হয় করোনা সরকার দলীয় লোকজনের জন্য যেন বরং আশীর্বাদ হয়ে এসেছে! অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক অবস্থানপত্রে ধরা পড়েছে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে প্রদেয় ৫০ লক্ষের তালিকার ১৪ লক্ষ ৩৩ হাজার জনের নামই ভুয়া। মেগা প্রজেক্টের মেগা দুর্নীতির সব কাহিনী তো আপনাদের জানা আছে। এ সকল মেগা প্রজেক্টে প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন পর্যায়ে চরম অস্বচ্ছতা, অদক্ষতা ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ অপচয় ও মহা দুর্নীতির মহা রেকর্ড তৈরি হচ্ছে। এ ব্যাপারে ইতিপূর্বে অনেকবার বলা হয়েছে। ঐ সকল প্রকল্পের অর্থ বর্তমানে মানুষের জীবন বাঁচানোর উদ্দেশ্যে বরাদ্দ দিতে পারে সরকার। তা তারা করবে না।
তিনি আরো বলেন, আসলে বর্তমান সরকার সকল অর্থনৈতিক রীতিনীতি ভঙ্গ করে হীন রাজনৈতিক ও দলীয় ক্রনিদের স্বার্থে একটি অদ্ভুত ধরণের “economic model” এ দেশ পরিচালনা করছে। তারা গরীব জনগণের নিকট হতে নির্বিচারে ট্যাক্স আদায় করছে, রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে শুরু করে ব্যাংকিং সেক্টর, বিদ্যুৎ সেক্টর, Infrastructure সেক্টর- এক কথায় সর্ব সেক্টরে দুর্নীতির স্বর্গরাজ্য বানিয়ে একদলীয় শাসন কায়েম করেছে। জনগণের ভোটের দরকার নাই তাদের। নাই জনগণের কাছে জবাবদিহিতা। তাই বেপরোয়া দুর্নীতি আর অপশাসন করে চলেছে সরকার। যাহোক আপনাদের মাধ্যমে জাতির সামনে পুনরায় উপস্থাপন করতে চাই যে, একটি দেশে লকডাউনের কারণে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত অভাবী মানুষকে ঘরে রাখতে হলে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ঘোষিত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার প্রধান নীতি “Stay at Home” এর প্রধান উপাদান হচ্ছে ঘরে থাকা। আর অভাবী মানুষকে ঘরে রাখতে হলে তাদের ঘরে অবশ্যই খাদ্য পৌঁছে দিতে হবে।
আমরা সুস্পষ্টভাবে বৈশ্বিক মহামারি করোনা নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশকে রক্ষার প্রয়োজনে বিএনপির পক্ষ থেকে নিম্ন উল্লিখিত পাঁচটি সমন্বিত পদক্ষেপ বাস্তবায়নে সরকারকে সর্বাত্মক পরিকল্পনা গ্রহণের দাবি জানাচ্ছি-
১. দরিদ্র মানুষকে ঘরে রাখার জন্য তাদের ঘরে নগদ কমপক্ষে এককালীন ১৫,০০০ টাকা করে এবং খাদ্য পৌঁছে দিতে হবে।
২. মানুষকে বাইরে বের হবার জন্য স্বাস্থ্যবিধি মানা এবং মাস্ক ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
৩. অন্তত ৮০% মানুষকে অতি দ্রুত টিকা প্রদান সম্পন্ন করতে হবে। এ জন্য একটি সমন্বিত ও সুনির্দিষ্ট রোড-ম্যাপ প্রণয়ন করে জাতির সামনে উপস্থাপন করতে হবে এবং তা বাস্তবায়ন করতে হবে। অবিলম্বে দেশে টিকা উৎপাদনের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৪. বর্তমানে সারাদেশে করোনা আক্রান্ত রোগীদের সর্বাত্মক স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য সারাদেশে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন সরবরাহ, আইসিইউ ও করোনা বেড বৃদ্ধিসহ অত্যাবশ্যকীয় চিকিৎসাসামগ্রী ও পর্যাপ্ত চিকিৎসক/স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ করতে হবে।
৫. অনেক বিলম্ব হলেও এখনি দেশের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, সকল রাজনৈতিক দল, এনজিও ও সামাজিক সংগঠনের সমন্বয়ে একটি জাতীয় আপতকালীন পরামর্শক কমিটি গঠন করতে হবে। এই পাঁচটি জিনিস করোনা নিয়ন্ত্রণে প্রধান টার্গেট হিসেবে নির্ধারণ করতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে করোনা মহামারির বিরুদ্ধে যে লড়াই সেটা বস্তুত একটি দীর্ঘস্থায়ী লড়াই।
মির্জা ফখরুল বলেন, এই ভয়াবহ করোনা মহামারির বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলে চলমান লকডাউন কালে দরিদ্র, দুঃস্থ ও কর্মহীন জনগোষ্ঠী অর্থাৎ দিন আনে দিন খায়, অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিক, পরিবহন শ্রমিক, দোকান শ্রমিক, হকার, প্রান্তিক কৃৃষক এবং যে সকল নি¤œবিত্ত ইতোমধ্যে দরিদ্রের কাতারে নেমে পড়েছে তাদের চিহ্নিত করে তাদেরকে ঘরে রাখার প্রয়োজনে প্রত্যেককে অবিলম্বে এককালীন নগদ ১৫ হাজার টাকা প্রদানের দাবি জানাচ্ছি। আমাদের জিডিপি’র ৬-৭% অর্থাৎ বর্তমান ৬ লক্ষ কোটি টাকার বিরাট বাজেটের একটি সামান্য অংশ এ খাতে বরাদ্দ করলেই দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে মানবিক সহায়তা দেয়া সম্ভব। যা দরকার সেটা হ’ল সরকারের স্বদিচ্ছা ও আন্তরিকতা। ঐক্যবদ্ধভাবে এ মহাসংকট মোকাবেলার জন্য আমাদের দলের পক্ষ থেকে পুনরায় উদাত্ত্ব আহবান জানাই।
করোনা টিকা প্রাপ্তির বিষয়ে স্থায়ী কমিটির সদস্য সাবেক স্বাস্থ্য মন্ত্রী ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, আজকে টিকা প্রদানকে গুরুত্ব দিতে হবে। সারা পৃথিবীতে আজকে প্রমাণিত হয়েছে- যেসব দেশ ৭০/৮০ শতাংশ মানুষকে টিকা দিতে পেরেছে তারাই কিন্তু করোনাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে।এর কোনো বিকল্প নাই। আমরা লাখে লাখে টিকার হিসাব দেখলে হবে না। এখানে কোটি কোটি টিকা একেক মাসে আসার হিসাব আমরা দেখতে চাই। তাহলেই বাংলাদেশকে করোনার এই ভয়াল গ্রাস থেকে আমরা পরিত্রাণ করতে পারবো, নিয়ন্ত্রণ করতে পারবো। সেই লক্ষ্যে আমি আবার সরকারের প্রতি আহবান জানাচ্ছি, এই ব্যাপারে রাখ-ঢাক না করে অতি দ্রুত কোটি কোটি টিকা আমদানি করার ব্যবস্থা করেন, জনগনকে রক্ষার ব্যবস্থা করেন, এদেশের মানুষের জীবন-জীবিকাকে রক্ষা করেন। তা নাহলে আপনারা এদেশের ইতিহাসের কাছে দায়বদ্ধ থাকবেন, একদিন এদেশের জনগণ আপনাদের ব্যাপারে সঠিকভাবে আপনার ব্যর্থতা ইতিহাসে লেখে রাখবে।
জাতীয় করোনা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষন কমিটির আহবায়ক স্থায়ী কমিটি ইকবাল হাসান মাহমুদ টুক বলেন, গত বছর দুই কোটি মানুষের কাছে আমরা সাহায্য পৌঁছিয়ে দিতে পেরেছিলাম। এবার এই দ্বিতীয় টেউয়ের আমরা আগের মতোই ব্যবস্থা নিয়েছি। এবার প্রতিটি জেলায় আমাদের দলের অফিসে হেলথ সেন্টার করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেখানে অক্সিজেন, প্রয়োজনীয় ওষুধ- স্বাস্থ্য সামগ্রি থাকবে। অলিরেডি এই কাজ বেশ কয়েকটি জেলায় শুরু হয়ে গেছে। আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে প্রতিটি জেলার অফিসে এই হেলথ সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা হবে। দরিদ্র মানুষকে আর্থিক সাহায্য ও খাবার-দাওয়ার। যেহেতু লকডাউন। কোথাও গেলে আমরা প্রশাসনের থেকে বাধাপ্রাপ্ত হই। সেজন্য আমরা যে যা পারি সীমিত সামর্থের মধ্যে মানুষজনকে সহযোগিতার ব্যবস্থা করেছি। একটা বিরোধী দল হিসেবে এতো কষ্টের মধ্যেও আমরা করোনা রোগীদের পাশে আছি ও কাজ করে যাচ্ছি।
বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান বলেছেন, এই মুহূর্তে ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করুন যাতে করে এই শ্রেণির মানুষের কাছে খাদ্য ও টাকা পৌঁছানো যেতে পারে। এটাই একমাত্র পথ এই লকডাউন কার্যকরের।
ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে আরো বক্তব্য রাখেন বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য ইসমাইল জবিহউল্লাহ।