হাসপাতালে উপচে পড়ছে রোগী : অনেককে ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ০১:৩০ এএম, ৯ এপ্রিল,শুক্রবার,২০২১ | আপডেট: ০২:৫০ এএম, ২২ নভেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
ঢাকার হাসপাতালে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী উপচে পড়ছে। হাসপাতালে আসা রোগীদের বেশির ভাগেরই শ্বাসকষ্ট। ভর্তির পর একজন রোগীকে কমপক্ষে আট-দশ দিন হাসপাতালে থাকতে হচ্ছে। কেউ কেউ আরো বেশি থাকায় বেড খালি হয় কম। প্রতিদিন যা খালি হয়, তার চেয়ে ভর্তির জন্য অনেক বেশি রোগী থাকে। বেড না পেয়ে এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ঘুরছে রোগীরা। শ্বাসকষ্ট থাকায় এসব রোগীর ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে বহুগুণ।
হাসপাতালসংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শ্বাসকষ্টের রোগী বেশি আসায় সরবরাহকৃত অক্সিজেনে পরিস্থিতি সামাল দেয়া সামনে আরো কঠিন হয়ে পড়বে। এ জন্য তারা হাসপাতালেই নিজস্ব অক্সিজেন প্লান্ট স্থাপনের তাগিদ দিচ্ছেন। স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে বলা হয়েছে, অক্সিজেনের সংকট নেই। ১৪ এপ্রিল ঢাকার মহাখালীতে এক হাজার ৫০০ বেডের কোভিড সেন্টার চালু হলে রোগী ভর্তি নিয়ে সংকট কেটে যাবে।
অথচ স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, সংক্রমণ প্রতিরোধ করা না গেলে হাসপাতালে রোগী সামাল দেয়া যাবে না, যতই বেড বা যন্ত্রপাতি বাড়ানো হোক। আর সংক্রমণ ঠেকাতে হলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতেই হবে। সরেজমিনে দেখা গেছে, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করিডরে রোগী ও স্বজনে ঠাসাঠাসি। আউটডোরে যেমন ভিড়, তেমনি ভর্তি রোগীদের। মেডিসিন বিভাগে রোগী উপচে পড়ছে। অনেকেই ছুটছে করোনা পরীক্ষার জন্য, আবার কেউ পরীক্ষার রিপোর্ট দেখাতে এসেছে চিকিৎসকের কাছে। কারো অল্প জ্বর, কাশি, শরীর ব্যথা, আবার কারো হালকা শ্বাসকষ্ট। জরুরি বিভাগে যারা আসছে, তাদের বেশির ভাগেরই শ্বাসকষ্ট।
হাসপাতালে কেরানীগঞ্জ থেকে আসা এক রোগীর স্বজন বলেন, বাসার তিনজন করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে বাবার বয়স ৭২ বছর, আগে থেকেই অ্যাজমা ও ডায়াবেটিস। আক্রান্ত হওয়ার দুই দিন পর্যন্ত কিছুটা ভালো ছিল, কিন্তু এর পর থেকেই শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। অবস্থা খারাপ হওয়ায় এই হাসপাতালে নিয়ে আসি। ডাক্তাররা প্রথমে আইসিইউয়ের কথা বললেও এখানে আইসিইউ খালি না থাকায় শুধু অক্সিজেন দিয়ে রাখা হয়েছে। এ ছাড়া কিছুই করার নাই। প্রাইভেট হাসপাতালে নিয়ে খরচ চালানোর অবস্থা নাই। যা হওয়ার হবে। আইসিইউ না হলেও ভাগ্যজোরে ওই রোগীর কপালে একটি সাধারণ বেড ও অক্সিজেন জুটলেও কিছুক্ষণ পরে আসা মমতাজ বেগম নামের ষাটোর্ধ্ব এক রোগীর আর জায়গা হয়নি এই হাসপাতালে। তীব্র শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়ায় স্বজনরা তাকে এখানে নিয়ে এসেছিল মোহাম্মদপুর থেকে। কিন্তু জরুরি বিভাগ থেকেই তাকে ফিরিয়ে দেয়া হয় কোনো বেড খালি না থাকায়। জরুরি বিভাগে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে দ্রুত অন্য কোনো হাসপাতালের আইসিইউতে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন।
জানতে চাইলে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. খলিলুর রহমান বলেন, আমাদের করোনা ইউনিটে মোট বেডসংখ্যা ২০০ (জেনারেল ১৯০ ও আইসিইউ ১০টি)। কী করব, আমাদের তো কিছু করার নেই। মঙ্গলবার কয়েকটি বেড খালি ছিল, কিন্তু রাতের মধ্যেই তা ভরে গেছে। এখন কোনো বেডই খালি নেই; না আইসিইউ, না জেনারেল বেড। আর যারা এসেছে তাদের রিলিজ দিতে কমপক্ষে আট-দশ দিন লাগছে। প্রতিদিন হয়তো দু-চারটি বেড খালি হচ্ছে, কিন্তু রোগী আসে কয়েক গুণ বেশি। তাদের ফিরিয়ে দেয়া ছাড়া তো উপায় নেই।
পরিচালক আরও বলেন, এখন যারা হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে, তারা সবাই শ্বাসকষ্ট নিয়ে আসে। আমরাও শ্বাসকষ্টের রোগীকেই অগ্রাধিকার দিই ভর্তির ক্ষেত্রে। কারণ তাদের অবস্থা খুব খারাপ থাকে, ফলে তাদের বাঁচানো সবচেয়ে জরুরি হয়ে পড়ে। কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের বাইরে থেকে দৃষ্টিনন্দন ও নিরিবিলি পরিবেশ দেখা গেলেও ভেতরে রোগীতে ঠাসা। ২৭৫ বেডের এই হাসপাতালে গতকাল সকাল পর্যন্ত রোগী ছিল ৪১১ জন। অর্থাৎ ১৩৬ জন অতিরিক্ত রোগী ছিল। এই হাসপাতালে ১০টি আইসিইউ বেডের সবগুলোই রোগীতে ভরা। প্রতিদিন যে কয়টি বেড খালি হয়, মুহূর্তেই তা ভরে যায় অপেক্ষারত রোগীদের মাধ্যমে। তবে বেশির ভাগই এখানে ঠাঁই না পেয়ে ফিরে যায় অন্য হাসপাতালে।
কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জামিল আহম্মেদ বলেন, যতটুকু সম্ভব চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু রোগী যেভাবে বাড়ছে, এটা খুবই উদ্বেগের ব্যাপার। হাসপাতালে ঠাঁই হচ্ছে না।
মুগদা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর বলেন, অবস্থা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। হাসপাতালে কিন্তু ঠাঁই হচ্ছে না। যাদেরই শ্বাসকষ্ট হচ্ছে তারাই হাসপাতালে আসছে। এমন এক অবস্থার দিকে আমরা যাচ্ছি, যেখানে কিন্তু অক্সিজেন সাপোর্ট চালিয়ে যাওয়াও কঠিন হবে। কারণ অনেকেরই প্রতি মিনিটে ৬০-৭০ লিটার করে অক্সিজেন লাগছে। একেকজন রোগীর যদি দিনে সাত-আট ঘণ্টাও একই ফ্লোতে অক্সিজেন লাগে, তাহলে সব রোগী সামাল দেয়া এক পর্যায়ে গিয়ে অসম্ভব হয়ে পড়বে। অবশ্য তিনি পরামর্শ দিয়ে বলেন, সরকারের তরফ থেকে যদি প্রতিটি হাসপাতালে নিজস্ব অক্সিজেন প্লান্ট স্থাপন করা যায়, তবে হয়তো কাজটা সহজ হতে পারে। তা না হলে অন্যদের মাধ্যমে অক্সিজেন রিফিল করে কুলানো যাচ্ছে না। কখনো কোনো হাসপাতালে প্রয়োজনমতো অক্সিজেন রিফিল করা না গেলে বড় বিপদ হয়ে যাবে।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, প্রাইভেট হাসপাতালেও ঠাঁই নেই। ধানমন্ডির আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালে ৯৬টি জেনারেল ও ২২টি আইসিইউ বেডের মধ্যে গতকাল সবগুলোতেই রোগী ছিল। পুরান ঢাকার আজগর আলী, পান্থপথের স্কয়ার হাসপাতাল, ইবনে সিনা, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার এভারকেয়ার, কল্যাণপুরের বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালের সবগুলো বেডই পরিপূর্ণ ছিল রোগীতে। গত কয়েক দিনে সুস্থ হয়ে এসব হাসপাতাল ছেড়ে যাওয়া রোগীর সংখ্যা খুবই কম।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক গতকাল বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের এক অনুষ্ঠানে আবারও বলেন, সংক্রমণ যেভাবে বাড়ছে, হাসপাতালে রোগীর চাপ সামাল দেয়া যাচ্ছে না; হাসপাতাল ও বেড বাড়িয়েও কূল পাওয়া যাবে না। সংক্রমণ রোধ করাই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ জন্য সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিসংখ্যান অনুসারে, গতকাল সকাল পর্যন্ত ঢাকার বড় ১০টি সরকারি হাসপাতালে দুই হাজার ৭৩৬টি জেনারেল বেডের মধ্যে দুই হাজার ৪৪১টিতে রোগী ছিল, আর ১৩১টি আইসিইউ বেডের মধ্যে ১২১টিতেই রোগী ছিল। কিন্তু বাস্তবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতাল ছাড়া আর কোথাও বেড খালি ছিল না। একইভাবে বেসরকারি ১০টি হাসপাতালের ৮১৪টি জেনারেল বেডের মধ্যে ৬৮১টি এবং ১৭৩টি আইসিইউয়ের মধ্যে ১৬৪টিতেই রোগী ছিল। যদিও স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল) মো. ফরিদ উদ্দিন জানান, আপাতত অক্সিজেনের কোনো সংকট নেই। সরকারি-বেসরকারি মিলে দেশে এখন ১৪ হাজার ৫৭৩টি অক্সিজেন সিলিন্ডার, ১০ হাজার ২২টি হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা ও ৮৯৭টি অক্সিজেন কনসেনট্রেটর রয়েছে। আর সব মিলিয়ে হাসপাতালে করোনা রোগী আছে পাঁচ হাজার ২০৮ জন। এর মধ্যে মোট জেনারেল বেডে রোগী চার হাজার ৭৭৫ জন ও আইসিইউতে ৪৩৩ জন। মোট জেনারেল বেড ৯ হাজার ৯১৮টি ও আইসিইউ বেড ৬০২টি।
তিনি বলেন, ঢাকায় এখন যে অবস্থা চলছে, সেটা কেটে যাবে সপ্তাহখানেক পরেই। আগামী ১৪ এপ্রিল মহাখালীতে এক হাজার ৫০০ বেডের কোভিড সেন্টার চালু করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ চলছে। ওই সেন্টারে ২০০টি থাকবে আইসিইউ ও এইচডিইউ বেড।