![Logo](https://dainikdinkal.net/frontend-assests/img/logo.png)
![Logo](https://dainikdinkal.net/frontend-assests/img/logo.png)
ঢাকার রাস্তায় ‘সিটিং সার্ভিস’ নামে চলছে ‘চিটিং’
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০২:৫১ এএম, ৪ মার্চ,বৃহস্পতিবার,২০২১ | আপডেট: ১০:৪৮ এএম, ১০ জানুয়ারী,শুক্রবার,২০২৫
![Text](/assets/images/1614786709.jpg)
আইনগত বৈধতা না থাকলেও ‘সিটিং সার্ভিস’ পরিচালনা করছেন বাস মালিকরা। সিটিং সার্ভিস নাম দিয়ে বাস মালিকরা মূলত অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছেন। কারণ সরকার যে গাড়ির ভাড়া নির্ধারণ করে তা গাড়ির সিট অনুযায়ীই করা হয়। দাঁড়িয়ে যাত্রী পরিবহন আইনগতভাবে অবৈধ। কিন্তু দাঁড়িয়ে যাত্রী পরিবহনের ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত কম ভাড়া এবং বসিয়ে নেয়ার নাম করে সিটিং সার্ভিস বলে বেশি ভাড়া নির্ধারণ করে বাস চলছে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। কিন্তু সব বাসই চলছে একই স্টাইলে, হরদম দাঁড়িয়ে যাত্রী পরিবহন করা হচ্ছে। সিটিং সার্ভিস মালিকদের একটি অপকৌশল বা চিটিং (প্রতারণা) এবং এর মাধ্যমে তারা যাত্রীদের পকেট কাটছেন বলে মনে করেন যাত্রী ও যাত্রী কল্যাণের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। পরিবহন শ্রমিকদের দাবি, যাত্রীর চাপ থাকায় অনেক সময় তাদের কিছু করার থাকে না। না ওঠাতে চাইলেও যাত্রীরা ঠেলে বাসে ওঠেন।
মালিকরা বলছেন, ‘যাত্রীদের সুবিধার জন্য সিটিং সার্ভিস পরিচালনা করা হয়। যাত্রীর চাপ ও পরিবহন শ্রমিকদের কারণে অনেক ক্ষেত্রে সেটা মানা হচ্ছে না। যেখানে মানা হচ্ছে না সেখানে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। লাব্বাইক (সাইনবোর্ড-নবীনগর), ভিক্টর ক্ল্যাসিক (সদরঘাট-গাজীপুর), ঠিকানা (সাইনবোর্ড-চন্দ্রা), দিশারী (কেরানীগঞ্জ-চিড়িয়াখানা), আকাশ (সদরঘাট-আব্দুল্লাহপুর), মিডলাইন (মোহাম্মদপুর-খিলগাঁও), অনাবিল (সাইনবোর্ড-গাজীপুর), মৌমিতা (চাষাড়া-চন্দ্রা) রজনীগন্ধা/সিটি লিংক (সাইনবোর্ড-ঘাটারচর), রাইদা (পোস্তগোলা-গাজীপুর), অছিম (স্টাফ কোয়ার্টার-গাজীপুর), নিউভিশন (মতিঝিল-চিড়িয়াখানা), মনজিল (চট্টগ্রাম রোড-কামার পাড়া), ওয়েলকাম (মতিঝিল-চন্দ্রা), আজমেরী গ্লোরী (সদরঘাট-চন্দ্রা), বিহঙ্গসহ (সদরঘাট-মিরপুর) রাজধানীর বেশ কয়েকটি রুটে চলাচলকারী বিভিন্ন কোম্পানির বাস ওয়েবিলের মাধ্যমে সিটিং সার্ভিস হিসেবে চলাচল করে।
কিন্তু দেখা গেছে, প্রায় সবগুলো কোম্পানির বাস দাঁড়িয়ে যাত্রী পরিবহন করে। ডেমরা এলাকার একটি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন মো. জামাল খান, তার বাড়ি কেরাণীগঞ্জ। তিনি বলেন, ‘সব বাসের এক সেবা, সবাই ঠেসে ঠেসে যাত্রী পরিবহন করে। কিন্তু আমরা সিটিংয়ের নামে অতিরিক্ত ভাড়া দেই। বাস মালিকরা এই ভাড়া নিজেদের খুশিমতো নির্ধারণ করেন। পরিবহন সেক্টরের ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ আছে বলে মনে হয় না।’
গুলিস্তান থেকে যাত্রাবাড়ীর রায়েরবাগ এলাকায় যাবেন মো. মাসুম মিয়া। তিনি গুলিস্তানের একটি মার্কেটের বিক্রয়কর্মী। মাসুম বলেন, ‘এই রুটে সিটিং সার্ভিস হিসেবে তিন-চারটি বাস চলে। গুলিস্তান থেকে রায়েরবাগ যেতে ওইসব বাসে ভাড়া নেয় ২০ টাকা। কিন্তু যেগুলো লোকাল হিসেবে পরিচিত সেগুলোতে ভাড়া নেয় ১৫ টাকা। কিন্তু সিটিং সার্ভিসগুলোও পুরো গাড়িতে দাঁড়িয়ে যাত্রী পরিবহন করে, থামেও যেখানে সেখানে। এরপরও সেগুলোতে যাতায়াতের ক্ষেত্রে ৫ টাকা ভাড়া বেশি দিতে হয়। লাব্বাইক পরিবহন সিটিং সার্ভিস হিসেবে চলাচল করে। কিন্তু এই বাসটি সবসময়ই দাঁড়িয়ে যাত্রী পরিবহন করে। কেন দাঁড়িয়ে যাত্রী পরিবহন করছেন জানতে চাইলে লাব্বাইক পরিবহনের কন্ডাক্টর মো. আব্দুর কাদের বলেন, সকালবেলা যাত্রীর চাপ বেশি থাকে, তখন দু-একজন দাঁড়িয়ে যান। এছাড়া আমাদের ভাড়াও খুব বেশি না, অন্যান্য লোকাল বাসের মতোই প্রায়। আকাশ পরিবহনও সিটিং সার্ভিস হিসেবে ভাড়া নেয়। আকাশ পরিবহনের একটি বাসের চালক মো. শাহাবুদ্দিন আহমেদ বলেন, যাত্রীদের সংখ্যা বেশি হওয়ায় অনেক সময় বাধ্য হয়ে দাঁড়িয়ে যাত্রী পরিবহন করতে হয়। বাসে উঠতে না দিলে দরজা ভাইঙ্গা ফালাইতে চায় যাত্রীরা। সিটিং বাসে দাঁড়িয়ে যাত্রী নেয়ার কারণে অনেক সময় যাত্রীরা বেশি ভাড়া দিতে অস্বীকৃতি জানান। পরিবহন শ্রমিকদের সঙ্গে বসচা হচ্ছে যাত্রীদের, অনেক সময় তা হাতাহাতি পর্যন্ত গড়াচ্ছে।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, চালক ও সহকারীদের দৈনিক ইজারা দেয়ার মাধ্যমে বাস পরিচালনার কারণে মূলত এটা হয়ে থাকে। বাসের ভাড়া নির্ধারণ হয় একরকম আবার আদায় হয় অন্যরকম।
তিনি বলেন, বাসের ভাড়া নির্ধারণ করা আছে কিলোমিটার হিসাবে, আর আদায় করা হচ্ছে ওয়েবিল হিসেবে। সিটিং সার্ভিসের নামে ওয়েবিল ব্যবহার করা হয়। আমরা দেখেছি আমাদের ৬০ শতাংশ গাড়ি অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করে, তারা অতিরিক্ত যাত্রী বহন করে থাকে।
মোজাম্মেল হক বলেন, সিটিং সার্ভিস হিসেবে ভাড়া নেয়ার কোনো আইনগত বৈধতা নেই। কারণ বাসের ভাড়া তো নির্ধারণ করা হয় সিটের ওপর ভিত্তি করে। বাসে দাঁড়িয়ে যাত্রী পরিবহন তো অবৈধ। কিন্তু আমাদের শহরগুলোতে জনসংখ্যার অত্যধিক চাপ থাকার কারণে সিটের অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন করা হয়। কিন্তু এটি বৈধ নয়। ওভারলোড পরিবহন আইনে নিষিদ্ধ।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব আরও বলেন, সিটে বসে গেলে বেশি ভাড়া মানে সিটিং সার্ভিস আবার দাঁড়িয়ে গেলে লোকাল, সেক্ষেত্রে ভাড়া কম এমন একটি বিষয় আমাদের মাথায় ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। সিটিং সার্ভিস হচ্ছে লুটপাটের জন্য মালিকদের একটা অপকৌশল।
অছিম পরিবহনে যাতায়াতের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে রোকনুজ্জামান নামের এক যাত্রী ফেসবুকে লিখেছেন, গাড়িতে বাড়তি লোক দাঁড়িয়ে আছে কমপক্ষে পাঁচজন। চেকার ২০ টাকার বিনিময়ে লিখে দিল সিটিং। তাদের চিটিং বাটপারিতে ঠকলো মালিক, পকেট কাটলো আমাদের... অছিম পরিবহন। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, সিটিং সার্ভিসে দাঁড়িয়ে যাত্রী নেয়ার কোনো অভিযোগ পেলে আমরা নিজেরা ব্যবস্থা নিয়ে থাকি, তাদের সতর্ক করি। এছাড়া এই বিষয়গুলো মনিটরিং করার জন্য বিআরটিএর ম্যাজিস্ট্রেটরা রয়েছেন, তারা শাস্তি দিয়ে থাকেন।
তিনি বলেন, অনেক সময় মানানো যায়, অনেক সময় মানানো যায় না। অফিস টাইমে যখন লোকজন বেশি থাকে তখন উঠে যায়, মানুষ মানতে চায় না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে চালকরাও ওঠায়, তবে মালিকদের পক্ষ থেকে সিটিং সার্ভিসে দাঁড়িয়ে যাত্রী নেয়ার কোনো নির্দেশনা নেই।
খন্দকার এনায়েত আরও বলেন, আইনগতভাবে সিটিং সার্ভিস বলে কিছু নেই, কোনো পারমিটও নেই। কিন্তু যাত্রীদের সুবিধার জন্য সিটিং সার্ভিস ব্যবস্থা চালু হয়েছে। ডেমরা ট্রাফিক জোনের সার্জেন্ট সুমন ইসলাম বলেন, দাঁড়িয়ে যাত্রী পরিবহন অন্যায়, কিন্তু আমাদের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি ও মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা পদক্ষেপ নিয়ে থাকি। সচেতনতাই পারে আমাদের ভালো একটি স্থানে নিয়ে যেতে। বাড্ডা ট্রাফিক জোনের সার্জেন্ট দীপ হাসান বলেন, গাড়িতে অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন আইনের লঙ্ঘন। এক্ষেত্রে সড়ক পরিবহন আইনের ৯২ (১) ধারা অনুযায়ী ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। কিন্তু যাত্রীদের ভোগান্তির কথা চিন্তা করে অনেক সময় এই ধরনের বিষয় দেখেও না দেখার ভান করতে হয় আমাদের।