অসহ্য গরমে চরম ভোগান্তি
যানজটে স্থবির রাজধানী : পাত্তা নেই ট্রাফিক পুলিশের!
মেহেদী হাসান রিয়াদ, দিনকাল
প্রকাশ: ০৬:৩৫ পিএম, ১০ অক্টোবর,বৃহস্পতিবার,২০২৪ | আপডেট: ০৬:২৬ এএম, ২৩ নভেম্বর,শনিবার,২০২৪
দেশের অন্যতম ব্যস্ত শহরগুলোর অন্যতম রাজধানী ঢাকা। সরকারি অফিস আদালত থেকে শুরু করে প্রধান প্রধান সব কাজের জন্যই পাড়ি জমাতে হয় এখানেই। এছাড়া জীবিকার তাদিগেও কাজ করছেন লাখ লাখ মানুষ। আর সেই রাজধানীই এখন যানজটের কারণে স্থবির। যদিও যানজট নিরশনে কাজ করে যাচ্ছে ট্রাফিক পুলিশ। তবে আইন ভাঙ্গার প্রবণতা আর পুলিশকে পাত্তা না দিয়ে চলাচলের ফলে যানজট ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ।
বৃহস্পতিবার (১০ অক্টোবর) সকাল ১১টায় রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থেকে তেজগাঁও কলোনী যেতে দেখা হলো গুগল ম্যাপের নির্দেশনা। ম্যাপে স্বল্প সময়ের পথ হিসেবে যাত্রাবাড়ী থেকে রামপুরা-হাতিরঝিল-সাতরাস্তার সড়কগুলোর নির্দেশনা পাওয়া যায়। তবে প্রচলিত যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভার হয়ে গুলিস্তান-পল্টন-শান্তিনগর-মগবাজার-সাতরাস্তার রেগুলার রাস্তার ম্যাপ নির্ধারণ করতেই দেখা গেল যানজটের ভয়াবহ চিত্র।
যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভারের সায়েদাবাদ থেকে গুলিস্থান পর্যন্ত পুরো সড়কেই দেখাল লাল চিহ্ন। আর গুলিস্থান থেকে তেজগাঁও পর্যন্ত পুরোটাই দেখা গেল বন্ধ। মাঝে মধ্যে কিছুটা রাস্তা খোলা দেখালেও তা সময়ে সময়ে লাল রঙে বদলে যায় অর্থাৎ তীব্র যানজট নির্দেশ করছে।
এ তো গেল ডিজিটাল মাধ্যমের চিত্র, সরেজমিনের চিত্র আরও ভয়াবহ। এক গণমাধ্যমকর্মীর সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। মিরপুর সাড়ে ১১’ এর বাসা থেকে নিজের বাইকে অফিসের উদ্দেশে সকাল সাড়ে ৯টায় বের হন তিনি। মোটামুটি অল্প সময়ে পৌঁছান ইসিবি চত্বর। কিন্তু ইসিবি মোড় থেকে পুরো ফ্লাইওভারের ওপর তীব্র যানজট।
এদিকে সকাল থেকে কার্যত বিমানবন্দরমুখী সড়কে যান চলাচল স্থবির দেখা গেছে। বিশেষ করে মহাখালী বা প্রগতি সরণি থেকে বিমানবন্দর হয়ে উত্তরাগামী রাস্তায় যান চলাচল একদম বন্ধ রয়েছে। এর ফলে বিমানবন্দর হয়ে এ যানজট একদিকে পৌঁছেছে মহাখালী ফ্লাইওভার পর্যন্ত, অন্যদিকে পৌঁছেছে রামপুরা পর্যন্ত। এসব সড়ক ব্যবহারকারী অধিকাংশ অফিস বা কর্মস্থলগামী পরিবহনযাত্রীর বাস থেকে নেমে হেঁটেই রওনা দিতে দেখা গেছে।
এছাড়া রাজধানীর মগবাজার, তেজগাঁও, বিজয় সরণি, ফার্মগেট, শাহবাগ, গ্রীনরোড, মিরপুর রোড, কাকরাইল, পল্টন, মিন্টো রোড, বেইলি রোড, শান্তিনগর, মৌচাক, হাতিরঝিল, রামপুরা, বাড্ডা, প্রগতি সরণি ও র্যাংগস ফ্লাইওভারে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়েছিল বিভিন্ন ধরনের যানবাহন। সকালের দিকে কাকরাইল, মগবাজার ও তেজগাঁও, মহাখালী, উত্তর বাড্ডা, নতুন বাজার এলাকায় যানজট দেখা দিলেও তা দ্রুত সংযোগ সড়ক ও আশপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। একপর্যায়ে প্রায় পুরো ঢাকা স্থবির হয়ে পড়ে। শহরে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতে দীর্ঘ সময় লেগেছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঠায় দাঁড়িয়ে থাকায় যানবাহনের যাত্রী বিশেষ করে বৃদ্ধ, নারী ও শিশুদের পোহাতে হয়েছে সীমাহীন দুর্ভোগ। এ চিত্র গত চার সপ্তাহ ধরেই।
কী কারণে এই যানজট? রাজধানীর রাস্তায় চলাচলরত বাস, মিনিবাস, সিএনজি অটোরিকশা, মোটরসাইকেলের চালক, যাত্রীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, প্রাথমিক ভাবে ঢাকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ন পয়েন্টগুলোতে ট্রাফিক পুলিশ নিস্ক্রিয় থাকায় প্রতিদিন ৪/৫ কিলোমিটার যানজট লেগেই থাকছে। এতে করে ভোগান্তি দিন দিন অসহনীয় পর্যায়ে যাচ্ছে। এছাড়া নিষিদ্ধ ব্যাটারিচালিত রিকশার অবাধে অনুপ্রবেশের কারণে রাস্তার মোড়ে মোড়ে যানজট লেগেই থাকছে।
ঢাকা অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মো. হানিফ খোকন বলেন, ফ্যাসীবাদি হাসিনার পতনের পর বেশ কিছুদিন রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশ ছিল না। সেই সুযোগে ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকা থেকে প্রায় সাড়ে তিন লাখ ব্যাটারিচালিত রিকশা ঢাকায় প্রবেশ করেছে। এসব রিকশা এতটাই বেপরোয়া যে তারা এয়ারপোর্ট রোডেও চলতে দ্বিধা করছে না। হানিফ খোকন বলেন, কয়েকদিন এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতেও এসব রিকশা উঠতে দেখা গেছে। যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভারের টোলপ্লাজায় আগুন দেয়ার ঘটনার পর ফ্লাইওভার দিয়েও ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইক চলাচল করতে দেখা গেছে। এখন ফ্লাইওভার দিয়ে না চললেও নগরীর যে কোন রাস্তায় এসব নিষিদ্ধ যান অবাধে চলাচল করছে। এগুলোই মূলত যানজটের সৃষ্টি করে মানুষের ভোগান্তি বাড়াচ্ছে। তিনি বলেন, দ্রুত এসব নিষিদ্ধ যান চলাচল বন্ধ করতে না পারলে রাজধানীতে এরা ক্যান্সারের মতো ছড়িয়ে পড়ে জনজীবন স্থবির করে দিবে।
এছাড়াও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর থেকে রাজধানীর আটটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে বিভিন্ন সময় নানান দাবি নিয়ে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ, মানববন্ধন ও সমাবেশের মতো কর্মসূচি চলমান আছে। এর ফলে সৃষ্ট যানজটও মানুষের ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এদিকে বহুজাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘নামবিও’র প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড ট্রাফিক ইনডেক্স-২০১৯তে বিশ্বে যানজটের শহর হিসেবে প্রথম স্থান অর্জন করে ছিলো ঢাকা। শুধু তাই নয়, সময় অপচয় ও ট্রাফিক অদক্ষতা সূচকেও শীর্ষে রয়েছে ঢাকা। যানজটের জন্য ঢাকার স্কোর হচ্ছে ২৯৭ দশমিক ৭৬। তবে বর্তমান সময়ে তার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে কয়েক গুন।
সরকারি হিসাবে ৩০৬ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের রাজধানী ঢাকায় বিভিন্ন ধরনের ২১ লাখ ৪৪ হাজার ৭৫৫টি যানবাহন চলাচল করে। এর সাথে সাড়ে তিন লাখ ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ২ লাখের বেশি ইজিবাইক যুক্ত হয়ে এ সংখ্যা দাাঁড়িয়েছে ২৫ লাখেরও বেশি। মেগাসিটিতে শহরের আয়তনের ২৫ শতাংশ রাস্তা থাকতে হয়। কিন্তু ঢাকায় আছে মাত্র ৮ শতাংশ। এ রাস্তার অনেক জায়গা আবার বিভিন্ন অবৈধ দখলদারের হাতে। এসব কারণে এমনিতেই যানজট রাজধানীবাসীর নিত্যসঙ্গী। তার উপর বাড়তি যানবাহনের চাপ পরিস্থিতিকে দিন দিন ভয়াবহ করে তুলছে।
এছাড়াও ঢাকায় যানজটের অন্যতম কারণ ট্রাফিক পুলিশের নিস্ক্রিয়তা। যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তায় এখন আর কোন ট্রাফিক পুলিশকে ডিউটি করতে দেখা যায় না। দুজন ট্রাফিক পুলিশ ডিউটিরত থাকলেও তারা বেশিরভাগ সময় বসে বসে সময় কাটান। শাহবাগ, বাংলামোটর, পান্থপথ, বিজয় সরণী, তেজগাঁও র্যাঙ্কস ভবন মোড়, সাতরাস্তা, মগবাজার, মালিবাগ চৌরাস্তা, শুক্রবাদ মোড়সহ নগরীর ব্যস্ত পয়েন্টগুলোতে ট্রাফিক পুলিশ প্রায় এক মাস ধরেই নিস্ক্রিয়। কোন কোন স্পটে পুলিশের দেখা মিললেও তারা মোবাইল দেখে বা গল্প করেই সময় কাটান।
পুলিশ সদর দফতরের তথ্য মতে, ট্রাফিক বিভাগে কর্মরতদের মধ্যে সবচেয়ে জনবল বেশি ডিএমপিতে। ঢাকায় প্রায় চার হাজার জনবল রয়েছে। ডিএমপির চারটি ট্রাফিক বিভাগে চার উপ-কমিশনার (ডিসি) ছাড়াও রয়েছেন চারজন অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি)। রয়েছেন জোন ভিত্তিক একাধিক সহকারী কমিশনার (এসি), শতাধিক ট্রাফিক ইন্সপেক্টর (টিআই) ও সাত শতাধিক সার্জেন্ট। অথচ সারা ঢাকা শহর ঘুরলে এখন একশ’ ট্রাফিক পুলিশ খুঁজে পাওয়া যাবে না। এ প্রসঙ্গে একজন ট্রাফিক ইন্সপেক্টর বলেন, যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে ট্রাফিক পুলিশকে মামলা দিতে হবে। আর মামলা দিতে গেলেই গাড়ির চালকরা ঝামেলা করে। কেউ একজন ট্রাফিক পুলিশের গায়ে একবার হাত দিলেই চারিদিক থেকে মানুষ এসে পুলিশকে আক্রমণ করবে। মূলত এই ভয়ে ট্রাফিক পুলিশ নিস্ক্রিয় থাকছে। এ ছাড়া পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পুলিশের মধ্যে একটা ট্রমা তো কাজ করছেই। তবে পরিবহন শ্রমিক নেতাদের মতে, ট্রাফিক পুলিশের উপরিআয় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তারা কাজের আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে।
এ প্রসঙ্গ ট্রাফিকের একজন ডিসি বলেন, উপরিআয়ের জন্য নয়, গোটা পুলিশ বাহিনীই তাদের মনোবল হারিয়ে ফেলেছ। আশা করছি খুব শিগগিরই ঠিক হয়ে যাবে।
গবেষণায় দেখা গেছে, যানজটের কারণে রাজধানীতে প্রতিদিন বিভিন্ন খাত থেকে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা আয় নষ্ট হচ্ছে। সব মিলিয়ে যানজটের কারণে দিনে আর্থিক ক্ষতি প্রায় ১০০ কোটি টাকা।
বর্তমান সময়ে ট্রাফিক নিয়নন্ত্রণে পুলিশেন কর্যক্রম নিয়ে অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) খোন্দকার নজমুল হাসানের কথা হলে তিনি বলেন, ‘পুলিশের একার পক্ষে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা সম্ভব না’।
এসময় তিনি বলেন, ‘বেশিরভাগ মানুষই আইন মানতে চান না। অর্থাৎ শতকরা ৮০ ভাগ মানুষ আইন মানেন না। রাস্তা থাকছে অবৈধ পার্কিংয়ের দখলে। তাছাড়া রাজধানীতে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার দৌরাত্ম্য এখন চরমে। মানুষ আইন অমান্য করাটাকেই কৃতিত্ব মনে করেন। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আইন অমান্যের প্রবণতা বেড়েছে। ট্রাফিকের সাধারণ সদস্যদের অনেকেই পাত্তা দিতে চান না।’ এছাড়া কিছুদিন আগেও যারা রাস্তায় দাঁড়িয়ে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার কাজ করেছেন তারাও এখন আইন মানছেন না। উল্টোপথে চলাচল করে, ট্রাফিক সিগন্যাল না মেনে ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করতে চান। আবার অনেকেই পুলিশের সঙ্গে খারাপ আচরণও করেন। এমন ঘটনা এখন প্রায়শই ঘটছে। এরপরও আমাদের পুলিশ সদস্যরা ধৈর্যের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন। কেন জানি আমরা বেশি স্বাধীন হয়ে গেছি। স্বাধীনতা মানে যা ইচ্ছে তাই করা না। স্বাধীনতা মানে অন্যের অধিকার খর্ব করা না। আসলে স্বাধীনতা মানে শালীনতা, অন্যের অধিকার খর্ব না করা এবং স্বাধীনতা মানে আমার নিজের অধিকারের সঙ্গে অন্যের অধিকার সংরক্ষণ করা। তবে আমরা আশা করছি চালক, যাত্রীসহ জনসাধারণ সড়ক পরিবহন আইন সম্পর্কে জানলে ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলে এসব সমস্যা কেটে যাবে। ট্রাফিক আইন লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে সেপ্টেম্বর থেকে ট্রাফিক আইনে মামলা ও জরিমানা করা শুরু হয়েছে। আইন মানার সংস্কৃতি যদি গড়ে না ওঠে, তাহলে পুলিশের একার পক্ষে সম্ভব না। আমাদের আইন মানার সংস্কৃতি তৈরি করতে হবে।
দিনকাল/এমএইচআর