রাজধানীতে বেড়েছে ব্যাটারিচালিত রিকশা, বেড়েছে ভোগান্তিও
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৯:৪০ পিএম, ৪ সেপ্টেম্বর,রবিবার,২০২২ | আপডেট: ০১:০৮ পিএম, ২০ নভেম্বর,
বুধবার,২০২৪
রাজধানীতে বেড়েছে ব্যাটারিচালিত রিকশা। ভিআইপি এলাকাগুলো ছাড়া প্রায় সব স্থানেই এসব রিকশার আধিক্য। এলাকাগুলোর প্রবেশমুখে ভিড় করে থাকে এসব রিকশা। ফলে রাস্তায় বেড়েছে যান চলাচলে বিশৃঙ্খলা ও দুর্ঘটনা। ব্যাটারিচালিত রিকশার বেপরোয়া গতি ও চালকদের অসতর্কতাকেই দায়ী করছেন অন্য যানচালকরা।
তাদের মতে, ব্যাটারিচালিত রিকশায় কম পরিশ্রমে বেশি আয় হয়। পায়েচালিত রিকশা যতটুকু দূরত্বে ৪০ টাকা হাঁকে, সেখানে ব্যাটারিচালিত রিকশা ২০ থেকে ২৫ টাকায় রাজি হয়ে যায় এবং দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছায়। এতে অল্প সময়ের মধ্যে ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকরা আরেকবার যাত্রী নিতে পারেন। এভাবেই দুপক্ষের আয়বৈষম্য হয় বলে জানান সাধারণ রিকশাচালকরা। তবে দ্রুত গন্তব্য পৌঁছানো, অধিক যাত্রী পাওয়ার আশায় চালকদের বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো এবং ওভারটেকিংয়ের প্রবণতা রয়েছে বলেও ব্যাটারিচালিত রিকশার চালকরা স্বীকার করেন।
মিরপুরের ব্যাটারিচালিত রিকশাচালক আবদুর রহমান বলেন, ব্যাটারির রিকশা সারাদিন চালানো লাগে না। আধবেলা চালালেই ১৫-১৬টা ট্রিপে ৫০০ টাকার মতো থাকে। অবৈধ হওয়ার পরও ব্যাটারিচালিত রিকশা চালান কেন—এমন প্রশ্নে রহমান বলেন, এখন গ্যারেজগুলাতে ব্যাটারি রিকশা বেশি। আর এই রিকশা চালাতেও আরাম। অবৈধের বিষয়টা গ্যারেজ মালিক জানে। ব্যাটারিচালিত রিকশা লোহা দিয়ে তৈরি। তাই এ রিকশা টেকসই। দীর্ঘদিন ব্যবহার করা যায়। এছাড়া এই রিকশা পুনরায় বিক্রি করলে ভালো দাম পাওয়া যায়। এসব কারণে রিকশার মালিকরা ব্যাটারিচালিত রিকশার প্রতি আগ্রহী বলে জানান ব্যাটারিচালিত রিকশার প্রস্তুতকারক বাবুল।
তিনি জানান, এসব রিকশা ৬৫ হাজার থেকে এক লাখের মধ্যে পাওয়া যায়। তবে এসব রিকশা কোনও বৈজ্ঞানিক নকশায় বানানো নয়। রিকশার মালিকদের প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন পরিবর্তন আনা হয় বলে জানান বাবুল।
তিনি বলেন, ‘আমরা রিকশার বডি স্থানীয় ওয়ার্কশপ থেকে বানিয়ে আনি। ব্যাটারি আরেক জায়গা থেকে কিনে আনতে হয়। আমি সবগুলা একসঙ্গে সেট করে বিক্রি করি। ব্যাটারিচালিত রিকশা আকারে বড় হওয়ায় এবং সংখ্যা বাড়ায় আয় সংকটে পড়েছেন অন্য যানবাহনের চালকরা। এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন পথচারীরা। তাদের অভিযোগ, এলাকার ভেতরের রাস্তাগুলো এমনিতেই সরু, তার ওপর ব্যাটারিচালিত রিকশাগুলো এখন আকারে বড় করেছে। ফলে এলাকার প্রবেশমুখেই তৈরি হয় জ্যাম। এছাড়া এলাকার ভেতরে এসব রিকশার বেপরোয়া গতি প্রতিনিয়ত সৃষ্টি করছে দুর্ঘটনার আশঙ্কা। বিশেষ করে নারী, শিশু ও বৃদ্ধরা রাস্তা পার হতে গিয়ে অসুবিধায় পড়ছেন।
অটোরিকশা সড়কের ‘চলমান যমদূত’, এমনটা মন্তব্য করে বাইকচালক ফাহাদ বলেন, ব্যাটারিচালিত রিকশার চালকরা তাদের খেয়াল-খুশিমতো চলে। অন্য যানগুলোকে তোয়াক্কাই করে না। তাদের চাইতে আমাদেরই বেশি সতর্ক থাকতে হয়। কোনও লুকিং গ্লাস নাই, যখন-তখন রিকশার মোড় ঘুরিয়ে দেয়। পুরো রাস্তা দখল করে ওভারটেকিং করা তো তাদের কাছে এখন স্বাভাবিক বিষয়। মানবিক কারণে রিকশাচালকদের কিছু না বললেও দিন দিন ব্যাটারিচালিত রিকশা যে হারে বাড়ছে তা ভয়ানক বলে মনে করেন প্রাইভেটকার চালক আজিম হক।
তিনি বলেন, তারা অল্প আয়ের মানুষ। তাদের বিষয়ে কিছু বলাও যায় না। কিন্তু অতিরিক্ত কিছুই ভালো না। ব্যাটারিচালিত রিকশা ঢাকার রাস্তাগুলোর জন্য উপযুক্ত নয়। তারা সড়কে কোনও আইন মানে না। তাদের নিয়ন্ত্রণেও কোনও উদ্যোগ দেখি না। অথচ দিন দিন ব্যাটারিচালিত রিকশার মাত্রারিক্ত বৃদ্ধি পাওয়াটা ভয়ানক। এলাকার ভেতরে চালাতে আরাম, তাই সবাই এই রিকশার দিকে ঝুঁকছে।
না চাইলেও ব্যাটারিচালিত রিকশা ব্যবহার করতে হয় বলে দাবি বেশিরভাগ যাত্রীর। তাদের মতে, এখন রাস্তায় আর পায়েচালিত রিকশা খুঁজেই পাওয়া যায় না। আবার অনেক যাত্রী ভাড়া কম ও দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছানো যায় বলে এই রিকশা ব্যবহার করেন। তবে ঝুঁকির বিষয়টাকেও বড় করে দেখছেন যাত্রীরা। মিরপুর কাজিপাড়ার বাসিন্দা মুয়াজ বলেন, ‘আমাদের এলাকার মূল সড়ক হলো ১৪ ফুট, কোনও ফুটপাত নেই। এর মধ্য দিয়েই সব ধরনের গাড়ি চলে, মানুষও চলে। সেখানে ব্যাটারিচালিত রিকশার যে গতি, একটু অসতর্ক হলেই দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা থাকে। একই অবস্থা রাজধানীর অন্যান্য এলাকার। তবে ব্যাটারিচালিত রিকশার সমস্যার সমাধান হিসেবে সঠিক ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন বলে সুপারিশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
এ বিষয়ে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বলেন, ‘রাজধানীতে এখন অন্তত ২৫ শতাংশ মানুষ হেঁটে চলাচল করে। কিন্তু তাদের জন্য বেশিরভাগ এলাকার সড়কগুলোয় নেই কোনও ফুটপাত। বাধ্য হয়েই যান চলাচলের সড়কেই পথচারীদের হাঁটতে হয়। এটা ঝুঁকিপূর্ণ। তিনি আরও বলেন, হাঁটার কষ্ট এড়াতে অনেকেই রিকশার ওপর নির্ভর হন। কিন্তু তাতে সমস্যার সমাধান তো হয়ই না উল্টো আরও বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। রাস্তাগুলো হয়ে ওঠে পথচারীদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। আর এই ঝুঁকি আরও এক ধাপ বাড়িয়ে দেয় অবৈধ ব্যাটারিচালিত রিকশা। অনিয়ন্ত্রিতভাবে চলাচল করা এসব রিকশা একদিকে যেমন দেশের বিদ্যুৎ নষ্ট করছে, তেমনি এলাকার রাস্তাগুলোকে হেঁটে চলার অনুপযোগী করে তুলেছে।
এই সমস্যার সমাধানে সঠিক পরিকল্পনার প্রতি জোর দিয়ে এ বিশেষজ্ঞ বলেন, রাস্তার অবস্থান ও ক্যাপাসিটি অনুযায়ী কোন রাস্তায় কী পরিমাণ যান ও কী ধরনের যান চলবে, সেই পরিকল্পনা করতে হবে। সেক্ষেত্রে অবশ্যই রাস্তায় হেঁটে চলার উপযোগিতার ওপর বিশেষ মনোযোগী হতে হবে। তাতে যেমন দুর্ঘটনা কমে আসবে, তেমনি এলাকাভিত্তিক সড়কে শৃঙ্খলা ফিরবে।
রিকশার পরিবর্তে এলাকাগুলোতে আধুনিক ইলেকট্রিক মিনিবাস চালুর পরামর্শ দিয়ে মো. হাদিউজ্জামান বলেন, এখন যেমন ১০ জন যাত্রী ১০টি ব্যাটারিচালিত রিকশা ব্যবহার করছে, ইলেকট্রিক মিনিবাস-ব্যবস্থা চালু করলে সড়কে ১০টা রিকশার জায়গায় একটা যান চলবে। এতে রাস্তাগুলোয় বেশ জায়গা পাওয়া যাবে। এছাড়া বিদ্যুৎ ব্যয়ও কম হবে। এলাকাভিত্তিক যানগুলো তখন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাবে; যে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা এসব রিকশার ক্ষেত্রে নেই।