থানা হেফাজতে নিহত সুমনের স্ত্রীর বিলাপ
‘টাকা লাগলে টাকা দেবো, আমার স্বামীকে ফেরত চাই’
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৯:২৯ পিএম, ২১ আগস্ট,রবিবার,২০২২ | আপডেট: ০৬:০২ পিএম, ২৪ নভেম্বর,রবিবার,২০২৪
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে সুমন শেখের (২৭) লাশ। মামলা না করে স্বামীর লাশ নেবেন না স্ত্রী জান্নাত আক্তার। মামলা করতে আসেন পুরান ঢাকার আদালতপাড়ায়। এ সময় আদালত প্রাঙ্গণে শিশুসন্তান রাকিবকে (৬) কোলে নিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। কান্নাজড়িত কণ্ঠে স্বামী হত্যার ন্যায়বিচার দাবি করেন এ নারী। রাজধানীর হাতিরঝিল থানা হেফাজতে সুমন শেখ নামে যুবকের মৃত্যুর ঘটনায় আজ রবিবার দুপুরে পুরান ঢাকার আদালতে মামলা করতে আসেন স্ত্রী জান্নাত। চুরির মামলার আসামি সুমন থানা হাজতের ভেতর আত্মহত্যা করেছেন বলে দাবি পুলিশের। তবে পরিবারের দাবি, সুমনকে থানা হেফাজতে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনায় বিক্ষুব্ধ স্বজন ও এলাকাবাসী গত শনিবার হাতিরঝিল থানার সামনে বিক্ষোভ করেন। এরই মধ্যে হাতিরঝিল থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) হেমায়েত হোসেন ও কনস্টেবল মো. জাকারিয়াকে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করেছে পুলিশ।
এদিকে আদালতে মামলা করতে এসে সুমনের স্ত্রী জান্নাত বলেন, দেশে বিচার আছে। সে চুরি করলে তার বিচার হবে। থানা হেফাজতে তাকে হত্যা করা হলো কেন? ইউনিলিভারের পিওরইট কোম্পানি ও পুলিশ আমার স্বামীকে হত্যা করেছে। আমার কাছে পুলিশ পাঁচ লাখ টাকা দাবি করেছিল। টাকা না দেয়ায় তাকে হত্যা করা হয়েছে। স্বামীকে হারিয়ে শোকবিহ্বল এ নারী আরও বলেন, এখন আমি আমার শিশুসন্তানকে নিয়ে কোথায় যাবো। কোথায় দাঁড়াবো। টাকা লাগলে টাকা দেবো। আমি আমার স্বামীকে ফেরত চাই। এ হত্যাকান্ডের সুষ্ঠু বিচার চাই। শনিবার (২০ আগস্ট) সুমন শেখের স্ত্রী জান্নাতের বড় ভাই মোশাররফ হোসেন জানান, রাতে থানা থেকে বলা হয় সুমনের লাশ নিতে হাতিরঝিল থানা থেকে তাদের পাঠানো হয় শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে। সেখানে রাত ৮টার পর লাশ গোপনে নিয়ে যেতে বলে পুলিশ। কিন্তু তারা লাশ নেননি। লাশ না নিয়ে তারা বাসায় চলে যান। রবিবার সকালে এ ঘটনায় ইউনিলিভারের পিওরইট কোম্পানি ও পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে। মামলা দায়েরের পর পরিবার লাশ বুঝে নেবে।
পরিবারের দাবি, সুমন শেখ রাজধানীর রামপুরায় ইউনিলিভারের পানি বিশুদ্ধকরণ যন্ত্র পিওরইটের বিপণন কার্যালয়ে ছয় বছর ধরে চাকরি করতেন। তার মাসিক বেতন ছিল ১২ হাজার টাকা। শুক্রবার রাতে বাসা থেকে পুলিশ তাকে মারতে মারতে তুলে নিয়ে যায়। আটকের খবর পেয়ে রাতেই সুমনের পরিবার থানায় যান। এ সময় তাদের জানানো হয়, শনিবার সকালে সুমনকে আদালতে পাঠানো হবে। সকালে পরিবারের সদস্যরা থানায় গেলে সুমনের মৃত্যুর কথা জানায় পুলিশ।
শনিবার রাতে পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) আজিমুল হক সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ঘটনার রাতে (শুক্রবার) থানায় থাকা ডিউটি অফিসার উপ-পরিদর্শক (এসআই) হেমায়েত হোসেন ও হাজতের প্রহরী কনস্টেবল মো. জাকারিয়াকে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। ঘটনা তদন্তে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল জোনের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) হাফিজ আল ফারুককে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে পুলিশ।
ডিসি আজিমুল বলেন, গত ১৫ আগস্ট ইউনিলিভারের পিওরইট কোম্পানি থেকে ৫৩ লাখ টাকা চুরি হয়। এ ঘটনায় মামলার পর তিনজনকে গ্রেফতার করে হাতিরঝিল থানা পুলিশ। গ্রেফতার তিনজন হলেন- আল-আমিন, সোহেল রানা ও অনিক হোসেন। তারা এখন কারাগারে। জিজ্ঞাসাবাদে ওই তিনজনের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে ও চুরির ঘটনায় সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে সুমন শেখকে শনাক্ত করা হয়। এরপর শুক্রবার বিকেলে রামপুরা মহানগর এলাকার বাসা থেকে তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এ সময় তার বাসা থেকে নগদ ৩ লাখ ১৩ হাজার ৭০০ টাকা উদ্ধার করা হয়। পরে তাকে নিয়ে অভিযান চালানো হয়। অভিযান শেষে রাত ১১টার দিকে তাকে থানা হেফাজতে রাখা হয়।
ডিসি আরও বলেন, শনিবার সকালে সুমন শেখকে আদালতে পাঠানোর কথা ছিল। কিন্তু শুক্রবার দিনগত রাত ৩টা ৩২ মিনিটে পরনে থাকা ট্রাউজার দিয়ে লোহার গ্রিলের সঙ্গে গলায় ফাঁস দেয় সে। যা সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে। ফুটেজটি নিহতের স্ত্রীসহ স্বজনদেরও দেখানো হয়েছে। তবে পরিবারের পক্ষ থেকে সুমনকে মারধর করে হত্যার যে অভিযোগ করা হচ্ছে, এ নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তেজগাঁও বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার বলেন, এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেনি। সুমন শেখের গ্রামের বাড়ি নবাবগঞ্জ থানার দক্ষিণকান্দি। তিনি রামপুরায় ইউনিলিভারের পানি বিশুদ্ধকরণ যন্ত্র পিওরইটের বিপণন কার্যালয়ে মালামাল ডেলিভারির কাজ করতেন।