এলএনজির ওপর অধিক নির্ভরশীলতা দেশকে সংকটে ফেলবে : সুজন
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১০:২০ পিএম, ১৭ আগস্ট,
বুধবার,২০২২ | আপডেট: ০১:০৬ এএম, ১৪ নভেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
দীর্ঘদিন এলএনজির ওপর অধিকতর নির্ভরশীলতা দেশকে আর্থিক সংকটে ফেলবে। এ সংকট সমাধানে দেশীয় গ্যাস মুখ্য ভূমিকা রাখতে পারবে বলে মনে করেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার।
আজ বুধবার জাতীয় প্রেসক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে সুজন আয়োজিত ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকট : নাগরিক ভাবনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে তিনি এসব কথা জানান।
তিনি বলেছেন, দেশের গ্যাস সম্পদ প্রায় শেষের পথে। নতুন করে গ্যাস মজুতের সম্ভাবনা তেমন নেই। কিছু কিছু ব্যবসায়ী গ্যাস অনুসন্ধান ও আবিষ্কার না করে বিদেশ থেকে এলএনজি আমদানির ওপর জোর দিচ্ছেন। এটা মূলত তাদের নিজস্ব স্বার্থেই। কিন্তু আমরা মনে করি, সরকার নতুন নতুন কূপ খনন করে গ্যাস আবিষ্কারের দিকে নজর দেবে; এটি ভবিষ্যতে দেশের উন্নয়নে বড় নিয়ামক হিসেবে কাজ করবে।
সুজন সম্পাদক বলেন, দেশে বর্তমানে জ্বালানি সংকট তীব্রতর হয়েছে। যথেষ্ট জ্বালানির অভাবে প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। ফলে লোডশেডিংয়ের কবলে পড়ে জনগণের দুর্ভোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। যদিও বর্তমান সংকট দুই মাসের মধ্যে কেটে উঠবে বলে সরকার আশ্বস্ত করেছে। এই সংকট এবারের জন্য কাটিয়ে উঠলেও ভবিষ্যতে জ্বালানি ব্যবস্থাপনা নিয়ে সংশয় ও আশঙ্কা রয়ে যাবে।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে বিশিষ্ট জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. বদরুল ইমাম বলেন, বাংলাদেশের বর্তমান সংকটটি মূলত জ্বালানি সংকট। এদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের যথেষ্ট সক্ষমতা তৈরি করা হয়েছে, কিন্তু বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য যথেষ্ট জ্বালানির অভাব থাকায় প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায় না। ফলে লোডশেডিংয়ের কবলে পড়ে জনগণের দুভোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ সংকটের অপর প্রধান উপাদান জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি। প্রথমত দেশীয় গ্যাসের স্বল্পতা হেতু আমদানিকৃত এলএনজির পর আংশিক নির্ভরশীল হবার ফলে গ্যাসের দাম নির্ধারণে এলএনজি ও দেশীয় গ্যাসের সংমিশ্রণ বিবেচনায় আনা হয় ও তাতে ইতিপূর্বেই মূল্য বৃদ্ধি ঘটে। বিশ্ব বাজারে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে তেলের মুল্য বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে দেশেও তেল মূল্য বৃদ্ধি করা হয়। এর প্রভাবে জনজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তথা পরিবহন ভাড়া, খাদ্যদ্রব্য, সার, ব্যবহার্য পণ্য দ্রব্য ইত্যাদির ব্যয় বৃদ্ধির দুর্ভোগ নেমে আসে। এমতাবস্থায় দেশের নিজস্ব জ্বালানির অনুসন্ধান ও উত্তোলন না করা ও বিদেশি জ্বালানির ওপর ক্রমাগতভাবে নির্ভরশীলতা বাড়ানোকে সমস্যার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, বর্তমান সংকট দু মাসের মধ্যে কেটে উঠবে বলে সরকার আশস্ত করছে। এ সংকট এবারের জন্য কাটিয়ে উঠতে পারলেও ভবিষ্যতে জ¦ালানি ব্যবস্থাপনা নিয়ে সংশয় ও আশঙ্কা রয়ে যাচ্ছে। বিশ্ববাজারে এলএনজি জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি সহসা থেমে যাবে না বলে প্রতীয়মান হয় না, বরং ইউরোপিয়ান দেশসমূহ রাশিয়ার গ্যাস না পাবার ফলে এলএনজি বাজারে নামছে ও ফলে এলএনজি মূল্য বৃদ্ধি অবশ্যম্ভাবী। দীর্ঘমেয়াদে এলএনজির অধিকতর নির্ভরশীলতা বাংলাদেশকে আর্থিক সংকটে ফেলবে। এ সংকট সমাধানের উপায় হিসেবে দেশীয় গ্যাস মুখ্য ভূমিকা রাখতে পারে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক গ্যাস সম্পদ মূল্যায়ন সংস্থাসমূহ একমত পোষণ করেন যে, বাংলাদেশে এখনও অনাবিষ্কৃত গ্যাস পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া যাবে।
প্রবন্ধের শেষভাগে তিনি বলেন, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সংকট মোকাবিলায় দ্বিমুখী তথা স্বল্প মেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি জ্বালানি ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করা আবশ্যক। স্বল্পমেয়াদী ব্যবস্থাপনায় ১) দেশের আবিষ্কৃত অথচ কিন্তু উৎপাদন স্থগিত রাখা গ্যাস (যেমন ছাতক গ্যাসক্ষেত্র) মজুদসমূহকে উৎপাদনে নিয়ে আসা, ২) আবিষ্কৃত কিন্তু উৎপাদনে আনা হয়নি (ভোলা নর্থ, জাকিগঞ্জ ইত্যাদি) তা উৎপাদনের আওতায় নিয়ে আসা, ৩) দেশের পুরোনো পরিত্যক্ত কূপসমূহকে ওয়ার্ক ওভার কার্যক্রমের মাধ্যমে পুনর্মূল্যায়ন করে যেখানে সম্ভব তা থেকে গ্যাস উৎপাদন শুরু করা, ৪) দেশের চলমান গ্যাসক্ষেত্রের কূপ প্রতি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য কূপসমূহের কারিগরি কাঠামোতে প্রয়োজনীয় সংযোজন, পরিবর্তন করা এবং এর জন্য ইতিপূর্বে নিয়োগকৃত কারিগরি পরামর্শকের সুপারিশসমূহ কার্যকর করা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. আনু মুহাম্মদ বলেন, জ্বালানি খাতের ওপর দেশের জনগণের মালিকানা ও সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত না হলে ঐ দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি হয় না। বাংলাদেশে বিদ্যমান জ্বালানি সংকটের কারণেই দেশে অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হয়েছে। ভর্তুকী মেটানোর জন্য ভবিষ্যতে বিদ্যুতের দাম আরও বাড়ানো হবে। এতে জীবনযাত্রার ব্যয় আরও বাড়বে। অথচ ভর্তুকি কারা পায়? গত ১২ বছরে বিভিন্ন কোম্পানিকে ৯৩ হাজার কোটি টাকা ভুর্তকী দেয়া হচ্ছে। দেশে জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে বিপিসি ৪৮ হাজার কোটি টাকা লাভ করেছে। সেই টাকা গেল কোথায়?
তিনি বলেন, দীর্ঘমেয়াদের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সংকট কাটাতে গ্যাস উত্তোলনে জাতীয় সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। অনেকেই বলেন, আমাদের জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা নেই। কিন্তু সরকারের সদিচ্ছা থাকলে সক্ষমতা বাড়বে। কারণ বিভিন্ন রাষ্ট্রের জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোই তো আমাদের এখানে ব্যবসা করছে। আমি মনে করি, নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি ও গ্যাস অনুসন্ধান এ দুটোই ভবিষ্যৎ সংকট কাটানোর অন্যতম প্রধান উপায়।
এনার্জি অ্যান্ড পাওয়ার ম্যাগাজিনের সম্পাদক মোল্লা আমজাদ বলেন, নিজস্ব জ্বালানি সম্পদ ব্যবহার না করার কারণে বাংলাদেশে বর্তমানে জ্বালানি সংকট দেখা দিয়েছে। এমনকি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ না হলেও এ সংকট দেখা দিত। এ অবস্থায় দীর্ঘমেয়াদে জ্বালানির সংকটের সমাধানের জন্য আমদানি নির্ভর জ্বালানি থেকে বের হয়ে আসা দরকার। কারণ এতে খরচ বেশি। বিভিন্ন সমীক্ষায় বাংলাদেশে নতুন গ্যাস ক্ষেত্র পাওয়ার সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছে। তাই এক্ষেত্রে নজর দেয়া দরকার।
পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক ও লেখক বিডি রহমতুল্লাহ বলেন, জল-জমি-জঙ্গল এ তিনটি বাদ দিয়ে আমরা বাঁচতে পারবো না। তাই প্রাণ-প্রকৃতিকে অগ্রাহ্য করে আমরা বিদ্যুৎ চাই না। তাই নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের ওপর জোর দেয়া দরকার। এর খরচও কম। সরকার চাইলে শতভাগ নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ সম্ভব।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকী বলেন, বর্তমান সরকার জ্বালানি সংকটকে পুঁজি করে কমিশন বাণিজ্য করছে। জ্বালানি ক্ষেত্রে আত্মনির্ভরশীলতা অর্জনের জন্য সরকারের কোনো ধরনের পরিকল্পনা নেই, জবাবদিহিতা নেই। সরকার নতুন নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্র করছে, কিন্তু জ্বালানির ব্যবস্থা নেই, সঞ্চালনা ব্যবস্থার সমস্যা রয়েছে।
অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও সুজন-এর নির্বাহী সদস্য ড. রুবায়েত ফেরদৌস, পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক ও লেখক বিডি রহমতুল্লাহ, জ্বালানি বিষয়ক সিনিয়র সাংবাদিক এম আবদুল্লাহ ও অরুণ কর্মকার ।