সুপারি গাছের সূত্র ধরে নারায়ণগঞ্জের ডাবল মার্ডারের খুনি শনাক্ত
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৫:১৫ পিএম, ১১ জুলাই,সোমবার,২০২২ | আপডেট: ১১:৩৭ এএম, ২১ নভেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে নৃশংসভাবে মা-ছেলে খুন হয়েছিল ২ জুলাই। কিন্তু কোনো প্রমাণ রেখে যায়নি খুনি। মা-ছেলের খুনের রহস্য উদঘাটন করতে হিমশিম খেতে থাকে পুলিশ। অবশেষে ঘরের পাশে সুপারি গাছে লেগে থাকা মাটি থেকে উদঘাটিত হয় এই হত্যা রহস্যের। দেখা গেল, আড়াইহাজার থানার গোবান্দি এলাকায় নম্র-ভদ্র হিসেবে পরিচিত সাদিকুর সাদি (২৪)। কারো সাথে কখনো বিবাদ-ঝগড়াও করেনি। অবশ্য খুনের কোনো পরিকল্পনা তার ছিল না।
পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) বলছে, আইপিএল ঘিরে জুয়া খেলে নিজের সব টাকা খুইয়েছে। ধার করে আরো ৭০ হাজার টাকা ঢালে জুয়ায়। কিন্তু জুয়ায় ভাগ্যে ফেরেনি সাদির। ধারের চাপে বিপর্যন্ত সাদি পাশের বাড়ির ভাবির কাছে ১০ হাজার টাকা ধার চায়ে। টাকা না পেয়ে স্বর্ণালঙ্কারের লোভে ভাবি রাজিয়া সুলতানা কাকুলি ও তার ৮ বছরের শিশু সন্তান তালহাকে গলাকেটে হত্যা করে।
গত ২ জুলাই রাতে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার থানাধীন গোবান্দি এলাকার নিজ বাসায় কাকুলি ও তার শিশু সন্তান তালহাকে খুনের ঘটনাটি ঘটে। ঘটনার তদন্তে ঘরের পাশে একটি সুপারি গাছে লাগা মাটি দেখে ক্লুলেস এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
পরে গত শনিবার (৯ জুলাই) নিজ বাসা থেকে সাদিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। রোববার (১০ জুলাই) হত্যাকাণ্ডে নিজের দায় স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন সাদি।
আজ সোমবার (১১ জুলাই) দুপুরে রাজধানীর ধানমন্ডি পিবিআই প্রধান কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান পিবিআই প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি বনজ কুমার মজুমদার।
হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ঘটনাস্থল পরিদর্শনের সময় পিবিআই সদস্যরা দেখতে পান কাকুলির ঘরের পেছনে একটি সুপারি গাছে মাটি লেগে আছে। দেখে মনে হচ্ছে কেউ বেয়ে উঠেছে, তবে সেই গাছে সুপারি নেই। আবার গাছ বেয়ে ওই ঘরে প্রবেশের সুযোগও নেই। তবে গাছে উঠে ঘরের বাথরুমের ভেন্টিলেটর দিয়ে ভেতরে দেখা যায়।
হত্যাকাণ্ডের ঘটনা কিংবা ঘটনার সময় গাছ বেয়ে কেউ উঠে গেছে ধারণা থেকেই খোঁজ করতে থাকেন পিবিআইর তদন্ত সংশ্লিষ্ট সদস্যরা। একপর্যায়ে জানা যায়, বাড়ির পেছনে ফ্রি ওয়াইফাই সংযোগ থাকায় কাকুলির ভাসুরের ছেলে অজিদ কাজীসহ (১৬) কয়েকজন সেখানে বসে ভিডিও গেমস খেলে।
অজিদ কাজীকে জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে জানায়, ২ জুলাই রাতে সে ওই ঘরের পেছনে বসে অনলাইনে গেমস খেলছিল। আনুমানিক সাড়ে ১০টার দিকে হঠাৎ কাকুলির ছেলে ভিকটিম তালহার চিৎকার শোনা যায়। এরপরই বাথরুমে কাউকে হাত ধুতে শোনা যায়। এরপর অজিদ কৌতুহলবশত সুপারি গাছ বেয়ে উপরে উঠে ভেন্টিলেটর দিয়ে ঘরের ভেতরে হাত ধোয়া অবস্থায় সাদিকে দেখতে পায়।
এরপর সাদিকে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে দেখে অজিদ। সেভাবে তার কাকি কাকুলির সঙ্গে সাদির অবৈধ সম্পর্ক আছে এবং বিষয়টি চেপে যায়। পরে তার দেওয়া তথ্যমতে সাদিকে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
বনজ কুমার বলেন, মালয়েশিয়া প্রবাসী স্বামী আড়াই বছর আগে মারা যাওয়ার পর কাকুলি তার সন্তানকে নিয়ে ওই ঘরেই বসবাস করতেন। তার কাছে টাকা-পয়সা আছে ভেবে টাকা ধার চাওয়ার পরিকল্পনা করে সাদি।
সাদিকে জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে পিবিআই প্রধান বলেন, গত ২ জুলাই রাতে কাকুলির ঘরের দরজায় নক করে দরজা খুলতে বলে সাদি। কাকুলি দরজা খুললে ভেতরে গিয়ে দেখতে পায় তার ছেলে তালহাকে ভাত খাওয়াচ্ছে। ভাত খাওয়ানোর পর তালহা ঘুমিয়ে যায়। এরপর সাদি কাকুলিকে আরেক রুমে ডেকে নিয়ে ১০ হাজার টাকা ধার চায়, একপর্যায়ে কাকুলির পায়ে ধরে অনুরোধ করে।
এলাকার ভালো ছেলে হিসেবে পরিচিতি পাওয়া সাদিকে বিশ্বাস করে আলমারি খুলে দেখায় তার কাছে দেয়ার মতো কোনো টাকা নেই। মাত্র ১০০ টাকা আছে। আলমারি খুললে সাদি দেখতে পায় সেখানে কিছু স্বর্ণালঙ্কার রাখা আছে। এরপর সাদি তার ভাবী কাকুলিকে চেয়ারে বসতে বলেন। তখন ওড়না দিয়ে কাকুলির গলা পেঁচিয়ে ধরলে সে অজ্ঞান হয়ে যায়। এরপর ইস্ত্রী দিয়ে মাথায় আঘাত করা হয়। তার মৃত্যু নিশ্চিত করতে বটি দিয়ে গলাকেটে দেয় সাদি।
তখন সাদি ভাবে কাকুলির ছেলেও হয়তো তাকে দেখে চিনে ফেলেছে। তাই ঘুমন্ত শিশু তালহাকেও গলা কেটে হত্যা করে সাদি। এরপর কাকুলির আলমারি থেকে স্বর্ণালঙ্কার নিয়ে চলে যান। পরে সবকিছু সাদির ঘর থেকে এবং যাদের কাছে বিক্রি করেছে তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করে পিবিআই।
বনজ কুমার মজুমদার বলেন, আইপিএল খেলায় জুয়ায় হেরে প্রায় ৭০ হাজার টাকা ঋণী হয়ে যায় সাদি। পাওনাদারদের চাপ সহ্য করতে না পেরে টাকা ধার চাইতে এসে এ হত্যাকাণ্ড ঘটায়। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে সাদি হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের মনে হয়েছে সাদির হত্যা করার উদ্দেশ্য ছিল না। ঘটনার আকস্মিকতায় পাওনাদারদের চাপ সহ্য করতে না পেরে সে এ ঘটনা ঘটিয়েছে। আমরা তদন্তের এ জায়গাটা বাকি রেখেছি, তদন্তে যদি পাওনাদারদের চাপ সৃষ্টিতে এমন কোনো ভূমিকা পাওয়া যায় তাহলে তাদেরকেও আসামি করা হবে।