সাভারে ট্যানারি নিয়ে নাখোশ স্থানীয়রা, দূষণে অতিষ্ঠ জনজীবন
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০১:২৭ এএম, ১৩ জুন,সোমবার,২০২২ | আপডেট: ০১:৫৬ পিএম, ১৮ নভেম্বর,সোমবার,২০২৪
ঢাকার সাভারের হেমায়েতপুরে নির্মিত চামড়া শিল্পনগরী এখন স্থানীয়দের কাছে অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্জ্য আর উৎকট দুর্গন্ধে অতিষ্ঠ তারা। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনে (বিসিক) বারবার জানিয়েও ফল মিলছে না বলে অভিযোগ তাদের। তরল আর কঠিন বর্জ্যে রূপ হারিয়েছে পাশ দিয়ে বয়ে চলা ধলেশ্বরী নদী। যদিও পরিবেশে অধিদফতর হতাশার কথা জানালেও বিসিক বলছে দ্রুত সমাধানের কথা। সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, ট্যানারিগুলোতে উৎপাদন চলছে। কিছু কিছু ট্যানারি আসন্ন কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে প্রস্তুতি সারছে। কেউ কেউ আবার এরই মধ্যে মজুত রেখেছেন লবণসহ কাঁচামাল পণ্য। প্রস্তুতি চোখে পড়লেও দেখা যায়নি পরিবেশ রক্ষায় হাতে নেয়া কোনো পদক্ষেপ। কারখানার পাশে ড্রেনগুলোতে জমে আছে পানি আর ট্যানারির কঠিন বর্জ্য। কোথাও আবার সেই পানি চলে এসেছে পাশের রাস্তায়। রক্ত জমানো ট্যানারির বর্জ্যগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। যেন কারও দায় নেই পরিষ্কারের। উৎকট দুর্গন্ধে টিকা দায়।
এমন পরিবেশ আক্কাস আলী বলেন, এখন তো পরিবেশ অনেক ভালো। সিজনের শুরুতে এলে বুঝতে পারতেন কেমন পরিবেশ। আসলে বড় কোনো ময়লার স্তূপ থাকলে সেটা পরিষ্কার করা হয়। তবে ছোট খাট হলে দিনের পর দিন সড়কেই পড়ে থাকে। এক সময় শুকিয়ে শুঁটকি হয়ে থাকে। আর দুর্গন্ধ ছড়ায়।
তিনি আরও বলেন, বাইরের পরিবেশের মতো ভেতরের কাজের পরিবেশও কেউ দেখেন না। হ্যান্ড গ্লাভস, বুট আর মাস্ক ছাড়া দিনের পর দিন কাজ করে যাচ্ছে শ্রমিকরা। সবাই দেখলেও কোনো প্রতিকার নেই। একটি হিসাব বলছে, সাভারের চামড়া শিল্প নগরীতে দৈনিক ৪০ হাজার ঘনমিটার বর্জ্য উৎপাদন হয়, অথচ বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সক্ষমতা রয়েছে মাত্র ২৫ ঘনমিটার। ক্রোমিয়াম শোধনের ব্যবস্থাও সাভারের চামড়া শিল্প নগরীতে নেই। অর্থাৎ দৈনিক ১৫ হাজার ঘনমিটার বর্জ্য পরিবেশের সঙ্গে মিশেছে। এ হিসেবে গত তিনবছরে এক কোটি ৬৪ লাখ ঘনমিটার বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বাইরে থেকে গেছে। যার ফলে এসব বর্জ্যরে খারাপ প্রভাব পড়েছে আশপাশের এলাকাগুলোতে।
একটি দোকানে বসা ছিলেন আয়েশা বেগম, মফিজুল মিয়া আর চন্দ্রা ভানুসহ কয়েকজন। গণমাধ্যম কর্মী পরিচয় পেয়েই ক্ষোভ ঝাড়েন তারা। আয়েশা বেগমের দাবি, তাদের সঙ্গে প্রতারণা করে জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। বলেছিল সুন্দর আধুনিক পরিবেশ দেবে। বাস্তবতা বলছে এখন নরক! দুর্গন্ধে টেকা যায় না, বিপদে না পড়লে এ অঞ্চলে কেউ আর এখন থাকে না। ভাড়াটিয়ারা আসে না, যার ফলে কলোনিগুলো ফাঁকা পড়ে আছে। আর যারা থাকেন তারা মশা-মাছির সঙ্গে যুদ্ধ করেন। বয়স্ক চন্দ্রা ভানু হাত ধরে টেনে নিয়ে যান তার বাসায়। টিনের বাসাটির জায়গায় জায়গায় ছিদ্র। জং পড়ে যাচ্ছে টিনে।
তিনি বলেন, ছয় মাস আগে লাগিয়েছে টিন। এখনই ছিদ্র হয়ে যাচ্ছে। একেবারেই টিকে না। এমনকি ট্যানারির ক্যামিক্যালে নষ্ট হচ্ছে ঘরে রেখে দেয়া তামা, কাসা, স্বর্ণ ও রুপার মতো ধাতুও। রং হারিয়ে ফেকাসে হয়ে যাচ্ছে। মফিজুল মিয়া বলেন, ধলেশ্বরী নদী আর নদী নেই। এখন হয়েছে নোংরা পানির খাল। রাতের আঁধারে ট্যানারি মালিকরা সরাসরি ময়লা পানি নদীতে ছেড়ে দেন। কেউ প্রতিবাদ করলেও কোনো লাভ নেই। তাদের সিইটিপি প্ল্যান শুধু নামেই থাকে। কাজের কাজ কিছুই নেই। প্রতিনিয়ত দূষণ হচ্ছে নদী ও তার আশপাশের এলাকা। আমাদের কাছে ট্যানারি এখন অভিশাপ।
এ বিষয়ে তেঁতুলঝোড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফখরুল আলম বলেন, আমি হতাশ। ট্যানারির চারপাশের মানুষগুলো বর্জ্য আর দুর্গন্ধের মাঝে কষ্ট করে টিকে আছে। বারবার বিসিককে জানিয়েও কোনো লাভ হচ্ছে না। তারা কোনো কথাই রাখছে না। শুধু আশ্বাস দিয়ে যায়। বিষয়টি নিয়ে কথা হয় পরিবেশ অধিদফতরের উপ-পরিচালক জহিরুল ইসলাম তালুকদারের সঙ্গে।
তিনি বলেন, ২০২১ সালে মাত্র ৮১টি কারখানা পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র নিয়েছিল। যা ফেব্রুয়ারির পর কাউকে আর ছাড়পত্র দেয়া হচ্ছে না। বিসিকের নিজেরও নেই কোনো পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র। যদিও বিসিক চামড়া শিল্প নগরীর নির্বাহী প্রকৌশলী মাহফুজুর রহমান রেজোয়ান বলেন, পরিবেশ রক্ষা করে উৎপাদন চালাতে কারখানাগুলোকে বারবার তাগিদ দেয়া হয়। উচ্চমহল থেকে পরিবেশ নিয়ে ভাবছেন। আশা করি দ্রুতই সমাধান হবে সব ভোগান্তি।