অবৈধ ওয়েবিল টিকিয়ে রাখার পাঁয়তারা
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০২:২৩ এএম, ১৬ নভেম্বর,মঙ্গলবার,২০২১ | আপডেট: ১১:৩৪ পিএম, ২০ নভেম্বর,
বুধবার,২০২৪
নব্য ভাড়ায় সীমাহীন বিপাকে পড়েছেন গণপরিবহনের যাত্রীরা। ডিজেলের দাম বাড়ার অজুহাতে রাতারাতি গ্যাসচালিত বাস ডিজেলচালিত বনে গেছে। আর সব বাসেই আদায় হচ্ছে বাড়তি ভাড়া। আজ থেকে অবৈধ ‘ওয়েবিল’, ‘সিটিং সার্ভিস‘ ও ‘গেটলক সার্ভিস’ বন্ধ হওয়ার কথা থাকলেও তা এখনো কাজীর গরু। কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই। তবে এসব গালভরা নামে যেসব অবৈধ পদ্ধতি পরিবহন খাতে রাজত্ব করছে এবং যাত্রীদের পকেট কাটছে, তার বিরুদ্ধে দেরিতে হলেও মাঠে নেমেছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বিভিন্ন বাস ও বিভিন্ন সেবা না দিয়ে উন্নত বিশ্বের কার্যক্রম অনুসরণ করে সরকারিভাবে একই ধরনের বাস পুরো রাজধানীতে চালু করা যেতে পারে।
ডিজেলের দাম বাড়ানোর কারণে গত ৭ নভেম্বর ঢাকায় ডিজেলচালিত বড় বাসে প্রতি কিলোমিটারের ভাড়া ২ টাকা ১৫ পয়সা ও মিনিবাসে ২ টাকা ৫ পয়সা নির্ধারণ করে দেয় বিআরটিএ। বড় বাসে সর্বনিম্ন ভাড়া ঠিক করা হয় ১০ টাকা, মিনিবাসে ৮ টাকা। যেসব বাস সিএনজিতে চলে, সেগুলোর ভাড়া বাড়বে না।
গত কয়েক দিন ধরে পরিবহনের বাড়তি ভাড়া আদায় বন্ধে মাঠে আছে বিআরটিএর ভ্রাম্যামাণ আদালত। সড়কে চলমান গাড়ি আটকে যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলছেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা। বাড়তি ভাড়ার অভিযোগ পেলেই করা হচ্ছে জরিমানা। তবুও বাড়তি ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্য থেমে নেই।
পরিবহন শ্রমিকদের খামখেয়ালিপনায় বিরক্ত যাত্রীরা। ভাড়া বৃদ্ধির দিন থেকে অনেকটা নড়েচড়ে বসেছেন নগরবাসী। এখন বাড়তি ভাড়া চাইলেই চালক ও চালকের সহকারীর ওপর রেগে যাচ্ছেন যাত্রীরা। যদিও তাতে খুব একটা সুফল মিলছে না।
রাজধানীর মোহাম্মদপুর থেকে ডেমরা স্টাফ কোয়াটার রুটে চলাচলকারী স্বাধীন পরিবহনে দেখা যায়, যাত্রীদের সঙ্গে চালকের সহকারীর বাগবিতন্ডা। চালকের সহকারী ভাড়া চাইছেন ওয়েবিল হিসেবে। কিলোমিটার হিসেবে ভাড়া নিতে নারাজ তিনি।
এ সময় ওই বাসের যাত্রী সাফাত হোসেন বলেন, এরা খুবই ফালতু প্রকৃতির। ভাড়া যেটা সেটা নিবে না। তারা ভাড়া চায় ওয়েবিল হিসেবে। ওয়েবিল তো বন্ধ হওয়ার কথা।
একই অভিযোগ বাসের অপর যাত্রী সায়লা মাহবুবের। তিনি বলেন, ‘সবকিছুর একটা সিস্টেম থাকা উচিত। ভাড়া যেটা সেটা দিব। কিন্তু এরা ভাড়া বেশি চায়।’
এ বিষয়ে ওই চালকের সহকারীর কাছে জানতে চাইলে তিনি কথা বলতে রাজি হননি। স্বাধীন পরিবহনের পরিচালক মো. আলাউদ্দিনের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, তার রুটে ৪৬টি বাস রয়েছে। কিন্তু রবিবার মাত্র ২২টি বাস চলছে। বাস চালানোর জন্য চালক পাওয়া গেলেও চালকের সহকারী পাওয়া যাচ্ছে না।
আলাউদ্দিন বলেন, ওয়েবিল হচ্ছে কয়জন যাত্রী উঠলো, আমরা সেটার হিসাব পাই। ওই হিসাবে আমরা ড্রাইভার, হেলপারের থেকে টাকা বুঝে নেই। কিন্তু ওয়েবিল হিসেবে তো ভাড়া নেয়া হয় না। আবার বাস চুক্তিতেও দিতে পারছি না। চুক্তিতে দেয়াও নিষেধ আছে।’
ভাড়া বাড়ানোর পরই অনেক বাসে বাড়তি ভাড়া আদায় করা হয়। বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন যাত্রীরা।
গত বুধবার ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির কার্যালয়ে বাস ভাড়া বাড়ানোর পরবর্তী অবস্থা নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব এনায়েত উল্যাহ জানিয়েছেন, রাজধানীতে ওয়েবিল সিস্টেমেও আর বাস চলবে না। গাড়িতে ভাড়ার চার্ট ঝুলিয়ে দেয়া হবে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গতকাল থেকে ওয়েবিল বন্ধ হওয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে বন্ধ হয়নি।
সরেজমিন দেখা গেছে, রজনীগন্ধা, ট্রান্সসিলভা, হিমাচল, শিকড়, ওয়েলকাম, স্বাধীন পরিবহনসহ আরও বেশ কয়েকটি বাস কোম্পানির নিজস্ব চেকাররা ছাউনিতে বসে আছেন। আগের মতো বাস আসতেই চেকাররা বাসে উঠে যাত্রী গণনা করছেন এবং ওয়েবিলে স্বাক্ষর করছেন।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব এনায়েত উল্যাহর কাছে ওয়েবিলের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি পরিষ্কার উত্তর দেননি। ওয়েবিল কবে বন্ধ হবে তা জানেন না বলে জানান পরিবহন খাতের শ্রমিক ও মালিকদের এই নেতা।
এনায়েত উল্ল্যাহ বলেন, আপাতত সিটিং সার্ভিস ও গেটলক সার্ভিস বন্ধে কাজ করছি। এরপর ওয়েবিল বন্ধে কাজ শুরু হবে। যারা বাড়তি ভাড়া আদায় করছে, বিআরটিএর মোবাইল কোর্ট তাদের জরিমানা করছে, ডাম্পিং করছে।
কবে নাগাদ ওয়েবিল বন্ধ হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সেটা এখনো বলতে পারছি না।’ ওয়েবিলের সঙ্গে ভাড়ার কোনো সম্পর্ক নেই বলে জানান এই পরিবহন নেতা।
পরিবহন মালিকরা ওয়েবিল টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে কি না জানতে চাইলে এনায়েত উতুল্ল্যাহ বলেন, ‘না, আমরা টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করব কেন?’ এরপর ব্যস্ততা দেখিয়ে কল কেটে দেন তিনি।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক ড. মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, আমরা এক লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা ইনভেস্ট করে তিনটা মেট্রো লাইন করতে পারছি। এখন চার হাজার কোটি টাকা ইনভেস্ট করে বিশ্বমানের বাস সার্ভিস ঢাকা শহরে চালু কর যায়।
ড. মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, কেন বছর বছর এর সঙ্গে ওর মিটিংয়ে বসতে হবে? কেন সড়কে ১৪ রকম সার্ভিস থাকবে, দুই-তিন রকম ফুয়েল থাকবে? এখানে কার স্বার্থ রক্ষা হচ্ছে এটা নিয়ে আমি সন্দিহান।
বিশ্বমানের পদ্ধতি অনুসরণ না করে সমস্যাকে জিইয়ে রাখা হচ্ছে বলে মন্তব্য করে এই গবেষক বলেন, সরকারিভাবে পুরো ঢাকায় এক রকম বাস সার্ভিস চালু হলে রাজধানীর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো, বিভিন্ন সরকারি দফতর ও সংস্থার জন্য আলাদা বাসের প্রয়োজন হবে না। মানসম্মত বাসসেবা চালু হলে সব শ্রেণির মানুষ একই বাসে উঠতে পারবে।