স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ‘সিদ্ধান্তে’ প্রবাসীদের ভোগান্তি
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০২:১৪ এএম, ৯ অক্টোবর,শনিবার,২০২১ | আপডেট: ০৫:০৭ এএম, ২৪ নভেম্বর,রবিবার,২০২৪
প্রবাসী শ্রমিক গিয়াস খানের সঙ্গে পাবনা থেকে তার স্ত্রী সীমা বেগম আর তিন বছরের মেয়েটাও এসেছে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। শখ করে মেয়েকে ‘রাজকুমারী’র পোশাক পরিয়েছিলেন মা-বাবা। গত বৃহস্পতিবার বেলা ২টার দিকে বিমানবন্দরের টার্মিনালের বাইরে শিশুটির পরনে দেখা গেল সাদা গেঞ্জি; সীমা ঘামছেন দরদর করে। সংযুক্ত আরব আমিরাতগামী গিয়াস তখন বিমানবন্দরের ভেতরে ঢুকেছেন করোনা পরীক্ষা করাতে।
সীমা বলেন, ‘রাত দেড়টায় উনার (গিয়াস খান) ফ্লাইট। করোনা পরীক্ষার ফলাফল হাতে পেলে উনি বের হয়ে আসবেন। তারপর আমরা চলে যাব।’ করোনা পরীক্ষায় ছয় ঘন্টা সময় লাগবে। এরপর স্ত্রী-সন্তানকে বিদায় জানিয়ে প্লেনে উঠবেন গিয়াস। ততক্ষণ পর্যন্ত টার্মিনালের বাইরে মেঝেতে মেয়েকে কোলে নিয়ে বসে থাকবেন সীমা। তিনি বললেন, এত গরম যে, মেয়েকে পরানো শখের পোশাক খুলে ফেলতে হয়েছে।
বিমানবন্দরে সংযুক্ত আরব আমিরাতগামী বেশ কয়েকজন অভিবাসী বলেন, প্লেন ছাড়ার অন্তত নয় ঘন্টা আগে তাদের বিমানবন্দরে আসতে হচ্ছে। প্রস্তুতিতে সময় লাগছে ২৪ ঘন্টারও বেশি। কেউ কেউ বাড়ি থেকে রওনা দিয়েছেন মধ্যরাতে, কেউ আবার একদিন আগে। অনেকেরই ঢাকায় আত্মীয়স্বজন নেই। তাদের উঠতে হয়েছে হোটেলে।
বিমানবন্দরের এক নম্বর টার্মিনালের কাছে গাট্টি-বোঁচকা হাতে দাঁড়িয়েছিলেন মো. শহীদ। না ঘুমানোয় চোখ দুটো তার লাল। বৃহস্পতিবার রাত দেড়টার ফ্লাইট ধরতে বিমানবন্দরে ঢুকেছেন বেলা ১২টায়। ময়মনসিংহের চুরখাই থেকে রওনা দিয়েছেন বুধবার রাত ৩টার দিকে।
শহীদ বলেন, সকালে ঢাকায় পৌঁছে আর্মি স্টেডিয়ামের কাছে একটি হাসপাতালে গিয়ে প্রথমে করোনা পরীক্ষা করিয়েছেন। ফ্লাইট ছাড়ার ১২ ঘন্টা আগে টিকিট বাতিল করা যায়। তাই আগে বাইরে একটা পরীক্ষা করিয়ে ফলাফল হাতে তারা বিমানবন্দরে ঢুকছেন।
দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে, খাওয়া-দাওয়া করেছেন কিছু? শহীদ বললেন, ভোররাতে এসে যেখানে নেমেছেন, তার আশপাশে ভাতের হোটেল ছিল না। রুটি-কলা খেয়েছেন।
টাইলস মিস্ত্রি মো. শরীফ গত ৫ মার্চ দেশে এসেছিলেন। ১২ বছর ধরে দুবাইতে কাজ করছেন। বাড়িতে মা ও অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে রেখে এসেছেন। তাকে বিদায় জানাতে এসেছেন ছোট ভাই মো. ফরিদ। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা পর্যন্ত টার্মিনালে অপেক্ষা করেছেন তিনিও। বড় ভাই করোনা নেগেটিভ ফলাফল হাতে নিয়ে বেরোনোর পর ফরিদ ময়মনসিংহের বাস ধরেন।
একই অবস্থা কুমিল্লার মো. নাঈম হাসান, নোয়াখালীর টিপু সুলতান ও শেখ জাহিদুন্নবীর। শেখ জাহিদুন্নবী বলেন, তিনি নোয়াখালী থেকে এসেছেন বুধবার সকালে। ঢাকায় কেউ নেই, হোটেলে উঠেছেন। সকালে আইসিডিডিআরবি-তে করোনা পরীক্ষা করিয়ে ফলাফল নিয়ে এসেছেন। তার ফ্লাইট রাত দেড়টায়। শুধু বিমানবন্দরেই থাকতে হচ্ছে ১৩ ঘন্টা। তার প্রশ্ন, এই সময়টা কমানো যায় না?
নাম প্রকাশ না করার শর্তে অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা জানান, চাইলেই সময় কমানো যেত। র্যাপিড পিসিআরে সময় কম লাগে। কিন্তু অধিদপ্তরের পছন্দ আরটি পিসিআর। এ কারণে বিদেশগামী প্রবাসী শ্রমিকদের এত ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে।
সূত্র জানায়, সংযুক্ত আরব আমিরাতে প্রবেশের শর্ত হিসেবে শুরুতেই র্যাপিড পিসিআরে পরীক্ষা করানোর শর্ত দিয়েছিল। ভারত, পাকিস্তান, নেপাল ও শ্রীলঙ্কার বিমানবন্দরে এই যন্ত্রের ব্যবহার শুরুও হয়েছে। যন্ত্রটির সুবিধা হলো, এতে পরীক্ষার ফলাফল দিতে সর্বোচ্চ এক ঘন্টা সময় লাগে। এক সঙ্গে ৯৬টি পর্যন্ত নমুনা পরীক্ষা করা যায়। এ জন্য আলাদা স্থাপনা বসানোরও কোনো প্রয়োজন নেই। চেয়ার-টেবিল থাকলেই চলে। বাংলাদেশেও কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান র্যাপিড পিসিআর মেশিন এনেছে। কিন্তু তাদের কাজে লাগানোর কোনো উদ্যোগ নেয়নি অধিদপ্তর।
সূত্রগুলো বলছে, আরটি পিসিআরে পরীক্ষা করতে সময় লাগে ছয় ঘন্টা। মেশিনগুলো বসাতেও ঝক্কি পোহাতে হয়। তাছাড়া একসঙ্গে অনেক যাত্রী এক জায়গায় ভিড় জমাচ্ছেন। এখন করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে। করোনা বেড়ে গেলে এত মানুষকে এক জায়গায় রেখে পরীক্ষা করানোয় কুফল ভোগ করতে হতে পারে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) মৌলিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন এম ইকবাল আর্সলান বলেন, ‘র্যাপিড পিসিআর ছাড়া এই সমস্যার সমাধান হবে না। পৃথিবীর বেশকিছু দেশ র্যাপিড পিসিআর ব্যবহার করছে। করোনা পরীক্ষার এই মেশিন দুর্লভ নয়, বাজারজাত করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দেয়ার দেড় মাস পরও এই যন্ত্র সংগ্রহের কোনো উদ্যোগ ছিল না। উল্টো ব্যবস্থাপকদের কেউ কেউ বলছেন, পিসিআর মানেই আরটি পিসিআর। তারা কাদের সঙ্গে আলোচনা করে এসব কথা বলছেন, বোধগম্য নয়।’
সূত্র জানায়, গত ১৪ সেপ্টেম্বর বিমানবন্দরে করোনা পরীক্ষার দায়িত্ব নিতে চায় এমন প্রতিষ্ঠানগুলোকে জুম বৈঠকে ডাকা হয়। সংযুক্ত আরব আমিরাতের শর্ত অনুযায়ী, র্যাপিড পিসিআর ছাড়া যারা এই সেবা দিতে চেয়েছেন তাদের আগেই বাদ দেয়ার কথা। বৈঠকের পর স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সাতটি কোম্পানির তালিকা প্রকাশ করে। ওই প্রতিষ্ঠানগুলো শুধু আরটি পিসিআর মেশিনের দাম বলেছিল। অনেক নামিদামি প্রতিষ্ঠান র্যাপিড পিসিআর মেশিনের জন্য দাম বলার পরও তাদের তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয় বলে সূত্র জানায়।
এখন সিলেটে ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও চট্টগ্রামে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরেও আরটি পিসিআর মেশিন বসানো নিয়ে আলোচনা চলছে। র্যাপিড পিসিআরের বদলে আরটি পিসিআর মেশিন বসানোয় সংযুক্ত আরব আমিরাতে যাওয়ার অনুমতি পেতেও সময় লেগেছিল বলে জানাচ্ছে অধিদপ্তরের সূত্রগুলো।
এ বিষয়ে জানতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক নাসিমা সুলতানার মন্তব্য চাইলে তিনি মুঠোফোনে বার্তা দিতে বলেন। র্যাপিড পিসিআর দেশে থাকার পরও কেন আরটি পিসিআর মেশিন বসানো হলো, জানতে চেয়ে বার্তা পাঠালে তিনি কোনো ফিরতি বার্তা পাঠাননি।