ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ডিএসসিসির অবহেলা : ডিএসসিসিতে ১০ মাস ওষুধ ছিল না
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০১:১৩ এএম, ৮ আগস্ট,রবিবার,২০২১ | আপডেট: ১২:০৩ পিএম, ২০ সেপ্টেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে বছরজুড়েই অবহেলা ছিল ঢাকার দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের। মাসের পর মাস ওষুধই ছিল না সংস্থাটিতে। ওয়ার্ড থেকে কর্মীও প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছিল। সরবরাহকারীর কাছ থেকে নেয়া হয়েছে মানহীন ওষুধ। ওষুধ ছিল না ১০ মাস!
জানা গেছে, গতবছরের শুরু থেকেই উড়ন্ত মশা মারার ওষুধ ছিটানো বন্ধ থাকে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে (ডিএসসিসি)। সংস্থাটির ভান্ডার বিভাগে আমদানি করা ওষুধ থাকলেও সেটি ফরমুলেশন (মিক্সিং) করতে না পারায় এ সমস্যা দেখা দেয়। তবে ওষুধ ফরমুলেশনের জন্য ১০ মাসে চার দফা টেন্ডার আহ্বান করে সংস্থাটি। এই দীর্ঘসময় মশার ওষুধ ছিল না ডিএসসিসিতে।
মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ ও মশককর্মী প্রত্যাহার : মাঠ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হওয়া এসিআই ফরমুলেশন লিমিটেডের সরবরাহকৃত এক লাখ লিটার ওষুধ ফেরত দেয় ডিএসসিসি। সংস্থার মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসের নির্দেশে ওষুধগুলো ফেরত দেয়া হয়। কিন্তু সেগুলো ধ্বংস না করে আবার ডিএসসিসিতেই সরবরাহ করা হয়। ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের পূর্বাভাস দেয়া হলেও মশককর্মী কমিয়েছিল ডিএসসিসি। কিছু কর্মী রেখে বাকিদের বদলি করা হয়েছিল সচিব দফতরে। ডেঙ্গুর মৌসুমের শুরুতেই কর্মী কমানোকে চরম অবহেলা হিসেবে দেখছেন কীটতত্ত্ববিদ ও নাগরিকরা। তারা বলছেন, যেখানে অর্ধেকের চেয়েও কম জনবল নিয়ে কাজ করছে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, সেখানে কর্মী কমানো কোনোভাবেই যুক্তিসঙ্গত নয়।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, গতবছরের জানুয়ারিতে ১৯৯ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৪৫, মার্চে ২৭, এপ্রিলে ২৫, মে’তে ১০, জুনে ২০, জুলাইতে ২৩, আগস্টে ৬৮, সেপ্টেম্বরে ৪৭ জন, অক্টোবরে ১৬৩ জন, নভেম্বরে ৫৪৭ এবং ডিসেম্বরে ২১৮ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন। সব মিলিয়ে ২০২০ সালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হন এক হাজার ৩৮২ জন। ওই অবস্থাতেও ‘ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আছে’ দাবি করে ওয়ার্ড থেকে কর্মী প্রত্যাহার করা হয়। যার ফল ভোগ করতে হচ্ছে চলতি বছর। এমনটাই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
তারা আরও বলেন, একটি সেক্টরে একজন লার্ভিসাইডিং, একজন অ্যাডাল্টিসাইডিং, দেখভালের জন্য একজন ও অন্যজন মশক নিয়ন্ত্রণে এলাকাবাসীকে যুক্ত করার কাজে থাকবে। এই প্রক্রিয়া অবলম্বন করলে মশার উৎপাদনস্থল থাকার কথা নয়। প্রতিটি ওয়ার্ডে কমপক্ষে ৩২ থেকে ৪০ জন লোক লাগবে। কিন্তু আছে ১২-১৩ জন করে।
মশার ওষুধ চুরি: কাজে ফাঁকি দেওয়ার পাশাপাশি মশককর্মীদের বিরুদ্ধে মশার ওষুধ চুরির অভিযোগও দীর্ঘদিনের। গত ২১ জুন সেটার প্রমাণও পেয়েছে সংস্থাটি। উড়ন্ত মশা মারার ওষুধ না ছিটিয়ে তা দোকানে বিক্রি করে দেওয়ার অভিযোগে দক্ষিণ সিটির চার মশকনিধনকর্মীকে কর্মচ্যুত করা হয়। তারা হলেন ৫০ নম্বর ওয়ার্ডের উজ্জল সিদ্দিকী, সুজন মিয়া, হাফিজুল ইসলাম ও জুয়েল মিয়া।
এ ঘটনায় করপোরেশনের মশক সুপারভাইজার মো. মনিরুল ইসলাম বাদী হয়ে কীটনাশক ক্রয় করা দোকানমালিক আবদুল মজিদ সিকদারের বিরুদ্ধে যাত্রাবাড়ী থানায় মামলাও করেন। চারগুণ বেড়েছিল কিউল্যাক্স মশা: অন্য বছরের তুলনায় এ বছর শুধু ফেব্রুয়ারিতেই কিউল্যাক্স মশা বেড়েছে চারগুণ। তখনও তথ্যটি আমলে নেয়নি দুই সিটি করপোরেশন। এতেও হু হু করে বাড়তে থাকে ডেঙ্গু। কীটতত্ত্ববিদরা জুন থেকে ডেঙ্গু বাড়ার পুর্বাভাস দিয়ে এলেও তাতে কর্ণপাত করা হয়নি।
বিশিষ্ট কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, জুনের শুরু থেকে আমরা বলে আসছি ডেঙ্গু বাড়বে। তখন থেকে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। যে কারণে এই প্রাদুর্ভাব। তিনি আরও বলেন, এখন ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করতে সিটি করপোরেশনের অগ্রাধিকারভিত্তিতে প্রতিটি ওয়ার্ডে স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে নিয়ে কমিটি করতে হবে। প্রতিটি কমিটিতে একজন লার্ভিসাইডিং স্প্রেম্যান ও একজন অ্যাডাল্টিসাইডিং স্প্রেম্যান দিতে হবে। এদের সঙ্গে একজন ক্লিনার রাখতে হবে। নেতৃত্ব দেবেন জনপ্রতিনিধিরা।
জানতে চাইলে সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজের (সিজিএস) চেয়ারম্যান ও কীটতত্ত্ববিদ ড. মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, এই মুহূর্তে প্রয়োজন উড়ন্ত মশা মারা। বেশি ফগিং করতে হবে। রোগী যেখান থেকে বেশি আসছে সেসব এলাকায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ওষুধ ছিটাতে হবে।
যা বলছে ডিএসসিসি : জানতে চাইলে ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফরিদ আহাম্মদ বলেন, নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছি। একটি নিয়ন্ত্রণ কক্ষও চালু করা হয়েছে। প্রতিটি অঞ্চলে একজন করে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কাজ করছেন। কন্ট্রোল রুম ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য নিচ্ছি। কোথাও তথ্য পাওয়া গেলে সেখানে কাউন্সিলরের নেতৃত্বে টিম পাঠানো হয়েছে। তিন ধরনের ওষুধ মজুত রাখা হয়েছে। যা দিয়ে ডিসেম্বর পর্যন্ত চলবে।
কর্মী কমানোর বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা গতকাল থেকে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকে যুক্ত করেছি। তাদের প্রায় এক হাজারের মতো লোক আছে। ওষুধে কোনও সমস্যা নেই। যে কোনও ওষুধ এক মাসের বেশি ব্যবহার করলে তার রেজিস্ট্যান্স গ্রো করে। সে কারণে আমরা তিনটি ওষুধ রেখেছি। ওষুধের কার্যকারিতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ফেরত দেয়া ওষুধগুলো যারা সরবরাহ করেছে তাদের ফেরত দেয়া হয়েছে। পরে আবার ওপেন টেন্ডার করে ওষুধ নেয়া হয়েছে। তবে ফেরত দেয়া ওষুধগুলো কী করা হয়েছে সে বিষয়ে তিনি কিছু জানাতে পারেননি।
তিনি বলেন, আমরা যে ওষুধগুলো নিয়েছি সেগুলো ৯৯ শতাংশ কার্যকর।