টিকার সংকট কাটেনি
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০১:৪৩ এএম, ৭ আগস্ট,শনিবার,২০২১ | আপডেট: ১০:১৪ এএম, ৮ সেপ্টেম্বর,রবিবার,২০২৪
বাংলাদেশে পূর্বঘোষিত পরিকল্পনা অনুযায়ী শনিবার থেকে গণ টিকাদান কর্মসূচি আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু না হলেও ‘ভ্যাকসিনেশন ক্যাম্পেইন’ শুরু হতে যাচ্ছে বলে জানানো হয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পক্ষ থেকে।
টিকাদান ‘ক্যাম্পেইন’ কীভাবে শুরু হবে, সেই বিষয়ে আজ শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে জানান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এবিএম খুরশীদ আলম।
টিকা কার্যক্রমের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী এখন পর্যন্ত টিকার প্রথম ডোজ পেয়েছেন দেশের শতকরা ৫ দশমিক ৪৪ জন এবং দ্বিতীয় ডোজ ২ দশমিক ৫২ জন। সরকারের হাতে এখন টিকা আছে মডার্নার ৪৪ লাখ ডোজ, সিনোফার্মের ৪৭ লাখ এবং অক্সফোর্ডের ১৬ লাখ ৪৩ হাজার ডোজ। সব মিলিয়ে এক কোটি সাত লাখ ১৬ হাজার ডোজ। এরমধ্যে অক্সফোর্ডের ১৬ লাখ ৪৩ ডোজ রাখা আছে দ্বিতীয় ডোজ হিসেবে। মডার্না ও সিনোফার্মেরও দ্বিতীয় ডোজ মজুত রাখতে হচ্ছে। আর ছয় দিনে এক কোটি মানুষকে টিকা দিতে হলে দুই কোটি ডোজ টিকার মজুত বা নিশ্চয়তা থাকতে হবে।
এদিকে ৭ আগস্ট যদি ৩২ লাখ ডোজ দেয়া হয় তারপর অক্সফোর্ডের টিকা বাদ দিলে হাতে থাকবে ৫৯ লাখ ডোজ। সরকার আশা পাইপলাইনে আরো যে ৬৫ লাখ ডোজ টিকা আছে তা এরই মধ্যে এসে গেলে সমস্যা হবে না।
স্বাস্থ্য মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. খুরশীদ আলম সংবাদমাধ্যমে দাবি করেছেন, কৌশলগত কারণে এই পরিবর্তন আনা হয়েছে। তারা যে কোনো পরিস্থিতিতে এই পরিবর্তন আনতেই পারেন। এটা নিয়ে এত কথা বলার কিছু নাই । তবে তিনি টিকার স্বল্পতার কথাও স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমার হাতে যে টিকা আছে আমি তো সব জায়গায় তা নিতে পারি না। মডার্নার যে টিকা আছে তা যদি গ্রাম পর্যন্ত নিতে পারতাম তাহলে তো ছড়িয়ে দিতে পারতাম।’
আর অধিদফতরের পরিচালক (এমআইএস) অধ্যাপক ডা. মিজানুর রহমান বলেন, ‘এসব ব্যাপারে আমার কাছে কোনো তথ্য নেই। কী হচ্ছে আমি জানি না। ’
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেনিন চৌধুরী মনে করেন, ‘ছয় দিনে এক কোটি মানুষকে টিকা দেয়ার যে উচ্চাভিলাষী সিদ্ধান্ত তা বাস্তবায়নে টিকার প্রাপ্যতা ও সার্বিক পরিকল্পনার অভাব ছিলো। গ্রাম পর্যায়ে টিকা দেয়ার জন্য যে প্রশিক্ষণ দরকার স্বাস্থ্যকর্মীদের তা দেয়া হয়েছে বলে আমার মনে হয় না। আর টিকা হাতে না নিয়েই চলে আসবে আশা করে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।’
নতুন তারিখ অনুযায়ী গণটিকা দেয়া হবে দিনে দুই ধাপে। সকাল ৯টা থেকে ১২টা পর্যন্ত বয়স্ক ও নারী এবং দুপুর ১২টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত সবার জন্য। ২৫ বছর বয়স হলেই টিকা পাবেন। ১৮ বছরের সিদ্ধান্ত এখন কার্যকর হচ্ছে না।
লেনিন চৌধুরী মনে করেন, ‘এটাকে বাস্তবায়ন করতে হলে আগেই তালিকা করতে হবে। নয়তো বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে।’
সাধারণ মানুষ যাতে টিকা নিয়ে আশ্বস্ত হয় সেই ব্যবস্থা করতে হবে বলে মনে করেন বিএসএমইউ’র সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কামরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘সরকার বারবার বলেছে এই মাসেই এক কোটি ডোজ টিকা আসবে। তাই যদি হয় তাহলে তো সমস্যা হওয়ার কথা না।’
স্বাস্থ্য অধিদফতর ও সরকারের সমন্বয়ের অভাব:
টিকাদান কর্মসূচি নিয়ে বারবার অবস্থান পরিবর্তন করাকে সরকারের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব হিসেবে দেখছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
গ্রাম পর্যায়ে টিকাদানের কর্মসূচি ৭ আগস্ট শুরু হওয়ার কথা থাকলেও বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য অধিদফতর সেই সিদ্ধান্ত থেকে পিছিয়ে আসে।
শেষ মুহূর্তে এসে গণটিকা কার্যক্রম শুরুর সময় পিছিয়ে দেয়ার ঘটনায় প্রস্তুতির ঘাটতি থাকতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
বৃহস্পতিবার শুরুতে জানানো হয় যে, এই গণটিকা কার্যক্রমের পরিকল্পনা পেছানো হয়েছে এবং ৭ তারিখ ‘পরীক্ষামূলক’ টিকা দেয়া হবে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা মন্তব্য করেন যে, গ্রাম পর্যায়ে টিকা দেয়ার ব্যবস্থাপনায় কোনো জটিলতা হয় কি না - সেটা দেখার জন্য এই পরীক্ষামূলক টিকাদান বা ‘টেস্ট রান’ প্রয়োজন।
টিকাদান কর্মসূচি পেছানোর কারণ হিসেবে ব্যবস্থাপনায় জটিলতার পাশাপাশি লকডাউনের সময় টিকা সরবরাহে সমস্যা হতে পারে, এমন যুক্তিও দিয়েছিলেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা।
তবে স্বাস্থ্য অধিদফতরের এসব বক্তব্যকে ‘খোঁড়া যুক্তি’ বলে মনে করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বে-নজীর আহমেদ বলেন, ‘আসলে যথাযথ প্রস্তুতি না নিয়ে টিকা কার্যক্রম শুরু করার তারিখ ঘোষণা করা হয়েছিল বলে মনে হয়।’ সরকারের পক্ষ থেকে দেড় কোটি টিকা মজুদের দাবি করা হলেও টিকার মজুদের চেয়ে টিকাদানের ক্ষেত্রে আনুষঙ্গিক বিষয়গুলোকে এ মুহূর্তে বড় সমস্যা হিসেবে মনে করছেন তিনি।
টিকাদান ক্যাম্পেইনে কোভিড ভ্যাকসিনেশনের আওতায় আসতে যাচ্ছে :
২৫ বছর ও তার চেয়ে বেশি বয়সী জনগোষ্ঠী, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পঞ্চাশের বেশি বয়সী জনগোষ্ঠী, নারী ও শারীরিক প্রতিবন্ধী দুর্গম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনগোষ্ঠী। সরকার বলছে, এই ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে সারাদেশে ৪ হাজার ৬০০টি ইউনিয়নে, এক হাজার ৫৪টি পৌরসভায় ও সিটি কর্পোরেশনের ৪৩৩টি ওয়ার্ডে টিকাদান কর্মসূচি চালানো হবে।
এই ক্যাম্পেইনের শুরুতে যেসব এলাকায় টিকা দেয়া হবে:
৭ আগস্ট সারাদেশে সব ইউনিয়ন, পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশন এলাকায়।
৭ আগস্ট ইউনিয়ন ও পৌরসভা পর্যায়ে যেসব এলাকায় টিকা দেয়া সম্ভব হবে না সেসব এলাকায় ৮ আগস্ট ও ৯ আগস্ট টিকা দেয়া হবে।
৭ আগস্ট থেকে ৯ আগস্ট সিটি কর্পোরেশন এলাকায়।
৮ ও ৯ আগস্ট দুর্গম/প্রত্যন্ত অঞ্চলে।
১০ আগস্ট থেকে ১২ আগস্ট বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যে ৫৫ বছরের বেশি বয়সীদের।
সরকার প্রাথমিকভাবে ১৮ বছরের বেশি বয়সীদের টিকা দেয়ার বিষয়ে চিন্তা করলেও পরে সেই পরিকল্পনা থেকে সরে আসে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক শুক্রবার সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘১৮ বছর বয়সের বেশি অনেকেরই জাতীয় পরিচয়পত্র নেই। পরিচয়পত্র ছাড়া টিকা কার্যক্রম পরিচালনা করতে যে বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে, তা সামাল দেয়া কঠিন হবে।’