চিকিৎসা সনদ ছাড়া ঈশিতার ডিগ্রি ও পদক সব ভুয়া
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৬:১২ পিএম, ২ আগস্ট,সোমবার,২০২১ | আপডেট: ১০:৩৪ পিএম, ২৩ নভেম্বর,শনিবার,২০২৪
অনলাইন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল থেকে শ্রেষ্ঠ গবেষকসহ নানা পরিচয় দিতেন নিজেকে। যদিও তার এসব বিশেষ ডিগ্রি বা তথাকথিত আন্তর্জাতিক পুরস্কারের সবই ভুয়া। মূলত মানুষের সাথে প্রতারণা করে অর্থ আত্মসাৎ ও খ্যাতি অর্জনে নিজেই এসব ডিগ্রি ও পদক জুড়ে দিয়েছেন নিজের নামে।
গতকাল রবিবার (১ আগস্ট) সকালে রাজধানীর মিরপুর থেকে ইশরাত রফিক ঈশিতা (৩৪) নামে এক চিকিৎসককে গ্রেফতারের পর প্রতারণার এসব কথা স্বীকার করেছে র্যাবের কাছে।
ঈশিতা ছাড়াও তার সহযোগী শহিদুল ইসলাম দিদার নামে এক যুবককেও গ্রেফতার করা হয়েছে। গতকাল বিকেলে রাজধানীর কাওরান বাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন সংস্থার আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
এ দিকে ঈশিতা গ্রেফতারের পর অনলাইনসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। সম্প্রতি অনলাইনে নানা ধরনের বিতর্কিত কাণ্ড ঘটিয়ে গ্রেফতার হওয়া হেলেনা জাহাঙ্গীরের সাথে তুলনা করা হচ্ছে তাকে। বহুরূপী প্রতারক বলা হচ্ছে ঈশিতাকে।
র্যাবের সাইবার মনিটরিং টিম ও গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে র্যাব-৪ ঈশিতাকে গ্রেফতার করে। তার বাসা থেকে ভুয়া আইডি কার্ড, ভুয়া ভিজিটিং কার্ড, ভুয়া সিল, ভুয়া সনদ, ভুয়া প্রত্যয়নপত্র, পাসপোর্ট, ল্যাপটপ, ইয়াবা, বিদেশী মদ ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদের দু’টি ইউনিফর্ম ও র্যাংক ব্যাজ উদ্ধার করা হয়েছে।
র্যাব জানায়, ঈশিতা নিজেকে চিকিৎসাবিজ্ঞানী, গবেষক, বিশিষ্ট আলোচক, ডিপ্লোম্যাট, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, পিএইচডি হোল্ডারসহ বিভিন্ন পরিচয় দিতেন। যদিও বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি ছাড়া চিকিৎসাশাস্ত্রে তার আর কোনো উচ্চতর ডিগ্রি নেই।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে নিজের পরিচয়ের সাথে জুড়ে দেয়া ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, ইন্টারন্যাশনাল ইন্সপিরেশনাল ওমেন অ্যাওয়ার্ড, বছরের সেরা নারী বিজ্ঞানী, সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে রিসার্চ অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড, ভারতের টেস্ট জেম অ্যাওয়ার্ড, থাইল্যান্ডের আউটস্ট্যান্ডিং সায়েন্টিস্ট অ্যান্ড রিসার্চার অ্যাওয়ার্ডসহ জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন পুরস্কার ও সম্মাননাসহ যত ধরনের পুরস্কার ও সম্মান পাওয়ার কথা বলেছেন সবই ভুয়া বলে স্বীকার করেছেন।
মূলত উচ্চাকাংক্ষা থেকেই প্রতারণা শুরু করেন। করোনাকালীন বিভিন্ন চিকিৎসককে প্রশিক্ষণ দিয়ে অর্থ আত্মসাৎ করেছেন এই নারী চিকিৎসক।
র্যাব জানায়, ঈশিতা ময়মনসিংহের একটি বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে ২০১৩ সালে এমবিবিএস সম্পন্ন করে পরের বছর মিরপুরে একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসক হিসেবে যোগ দেন। এরপর একটি সরকারি হাসপাতালে চুক্তিভিত্তিক কাজ করেন। তবে চার মাস পর অনৈতিক কাজ করার অভিযোগে তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়।
যেসব পরিচয়ে চলত প্রতারণা : ঈশিতা বিভিন্ন অখ্যাত পোর্টাল ও ফেসবুকে নিজেকে টকশো আলোচক, চিকিৎসাবিজ্ঞানী, গবেষক, পিএইচডিধারী, মানবাধিকারকর্মী, সংগঠক, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার সদস্যসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকার ভুয়া পরিচয় দিতেন। এর জন্য ভুয়া সনদও তৈরি করেছেন।
চিকিৎসাশাস্ত্রে কোনো উচ্চতর ডিগ্রি না থাকলেও নিজেকে এমপিএইচ, এমডি, ডিও ইত্যাদি ডিগ্রিধারী হিসেবে পরিচয় দেয়াসহ ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ, বিজ্ঞানী ও গবেষক হিসেবে পরিচয় দিতেন। সহজে খ্যাতি লাভের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশিত গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ, আর্টিকেল, থিসিস পেপার প্রকাশের দাবি করতেন।
র্যাব জানায়, তার দাবিকৃত ২০২০ সালে ভারতের উত্তরপ্রদেশে হোটেল পার্ক অ্যাসেন্টে অনুষ্ঠিত জিআইএসআর ফাউন্ডেশনের ইন্টারন্যাশনাল ইন্সপিরেশনাল ওমেন অ্যাওয়ার্ড (আইআইডব্লিউ ২০২০) প্রাপ্তি, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ‘রিসার্চ অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড’, ভারতের ‘টেস্ট জেম অ্যাওয়ার্ড ২০২০’, থাইল্যান্ডে আন্তর্জাতিক শিক্ষা সম্মেলনে ‘আউটস্ট্যান্ডিং সায়েন্টিস্ট অ্যান্ড রিসার্চার অ্যাওয়ার্ড’সহ অন্যান্য ভুয়া বলে স্বীকার করেছেন। এ ছাড়া ২০১৮ সালে জার্মানিতে ‘লিন্ডা ও নোবেল লরিয়েট মিট-মেডিসিনে’ প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে অংশগ্রহণ ও বিশ্বের ৬০-৬৫টি দেশ ভ্রমণের তথ্যও ভুয়া।
র্যাব জানায়, গ্রেফতার দিদার ছিল প্রতারণার অন্যতম প্রধান সহযোগী। তিনি টেলিফোন/অনলাইন আবার ক্ষেত্রবিশেষে সশরীরে উপস্থিত হয়ে ঈশিতার পরিচয়ের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনে সহায়তা করতেন। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অনলাইনে তিনি এ ভূমিকা পালন করতেন। দিদার ২০১২ সালে একটি ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং ও পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন ডিপ্লোমা সম্পন্ন করেন।
বর্তমানে একটি গার্মেন্টে কমার্শিয়াল ম্যানেজার হিসেবে নিযুক্ত রয়েছেন। তারা দু’জনই বিভিন্ন সংস্থার ভুয়া সদস্য, কর্ণধার বা দূত হিসেবে দেশে-বিদেশে প্রতারণা ও চাঁদাবাজির মাধ্যমে অপরাধ কার্যক্রমে যুক্ত। তিনিও ফিলিপাইনে একই সাইট থেকে অর্থের বিনিময়ে মেজর জেনারেল পদ ধারণ করেছেন বলে স্বীকার করেছেন।
এ ছাড়া নিজেকে আইন সহায়তা কেন্দ্র (আসক); ইয়াং ওয়ার্ল্ড লিডার ফর হিউমিনিটিসহ বিভিন্ন সংগঠনের ফাউন্ডার (প্রতিষ্ঠাতা) বা কর্ণধার হিসেবে উপস্থাপন করেন। একইভাবে তিনি দুর্নীতিসহ বিভিন্নবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থার দূত বা অ্যাম্বাসেডর হিসেবে পরিচয় দিতেন।
খন্দকার আল মঈন বলেন, প্রতারণার সাথে আরো বেশ কয়েকজনের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। তাদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ চলছে। ঈশিতা ও দিদারের বিরুদ্ধে পরবর্তী আইনি ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।