কম দামে পণ্য কেনার দীর্ঘ লাইনে আয় হারানো মানুষের দীর্ঘশ্বাস
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০১:১৫ এএম, ২৯ জুলাই,বৃহস্পতিবার,২০২১ | আপডেট: ১০:০২ এএম, ২২ নভেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
করোনা ভাইরাসে আয় হারানো মানুষ : “২০২০ সাল ভালো যায়নি, এখনো স্ট্রাগল করছি”। বাংলাদেশে ঈদের ছুটির পর আবারো চালু হয়েছে ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ-টিসিবির ট্রাকে করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বিক্রি। নিম্ন আয়ের মানুষ তো বটেই, করোনাভাইরাসের কারণে নতুন করে যারা দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমেছেন তারাও আসছেন এই ট্রাক থেকে পণ্য কিনতে। ২৬ জুলাই থেকে শুরু হওয়া এ দফায় ভ্রাম্যমাণ ট্রাকে করে ভোজ্য তেল, চিনি আর মশুর ডাল বিক্রি করা হচ্ছে। এর আগে ঈদের কারণে ১৮ই জুলাই থেকে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকে করে পণ্য বিক্রি বন্ধ রেখেছিল টিসিবি। চিনি ও মশুর ডাল ৫৫ টাকা কেজি এবং ভোজ্য তেল ১০০ টাকা লিটার দরে বিক্রি হচ্ছে। যা সাধারণ বাজারের পণ্যগুলোর স্বাভাবিক দামের তুলনায় প্রায় অর্ধেক। না এসে তো আর উপায় নেই : রাজধানীর মৌচাক এলাকায় ঘণ্টা-খানেক ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলেন মোহাম্মদ মাহি ফারহান। ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ-টিসিবির ভ্রাম্যমাণ ট্রাক থেকে কম দামে পণ্য কিনতে এসেছেন তিনি। দুপুরের কড়া রোদে যখন তার সাথে কথা হচ্ছিল তখন ক্লান্তি নয় বরং বার বার দীর্ঘশ্বাস আর সংকোচ ছিল চোখেমুখে।
দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী মি. ফারহান বলেন, ট্রাক থেকে পণ্য কিনতে আজই প্রথম এসেছেন তিনি। এর আগে তার বাবা আসতেন। তবে আজ প্রচন্ড রোদ থাকায় বাবার দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হবে জেনে নিজেই এসেছেন তিনি।
ফারহান জানান, করোনাভাইরাস মহামারি শুরু হওয়ার এক বছর পর থেকে সংসারে টানাটানি শুরু হলে কিছুটা কম দামে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতেই এখানে আসা শুরু হয় তাদের। ২০২০ সালটা ভাল যায়নি আমাদের। তাই এখানে আসা। এখন আমরা অনেক স্ট্রাগল করছি। ফারহানের মতোই লাইনে দাঁড়িয়েছেন আরেক ব্যক্তি। তবে নাম আর পেশার কথা প্রকাশ করতে চাননি তিনি।
ওই ব্যক্তি বলেন, তিনি যেখানে কর্মরত ছিলেন করোনাভাইরাসের কারণে সেটি টানা দুই বছর ধরে বন্ধ রয়েছে। যার কারণে আয় কমে যাওয়ায় সস্তায় টিসিবির ট্রাক থেকে পণ্য কিনতে এসেছেন তিনি। না এসে তো আর উপায় নেই। এখানে কিছুটা কম দামে পাই তাই আসি।
নিজের পেশা সম্পর্কে তিনি বলেন, পেশার কথাটা বলতে চাই না। কারণ আমরা যে পেশার সাথে জড়িত আছি সেই পেশা অনুযায়ী এখানে এসে পণ্য কেনার কথা না আমাদের। কিন্তু কী করবো? দুই বছর ধরে কর্মস্থল বন্ধ হয়ে আছে।
এদিকে রাজধানীর খামার বাড়ি এলাকায় টিসিবির ট্রাক পণ্য নিয়ে সকাল ১০টা থেকে থাকার কথা থাকলেও সেখানে আজ কোন ট্রাক যায়নি। দুপুর সাড়ে বারটার দিকে যখন সেখানেই যাই একদল নারী তখন নিজেদের মধ্যে কথা বলছিলেন। তারা জানান যে, সকাল ৮টা থেকে ট্রাকের জন্য অপেক্ষা করছেন তারা। আরো কিছুক্ষণ দেখে ট্রাক না আসলে ফিরে যাবেন। এদের একজন গার্মেন্টস কর্মী সাজেদা বেগম। চারজনের পরিবারে উপার্জন এখন শুধু তার নিজের। কম দামে পণ্য কিনতে প্রথমবার এসেছেন তিনি। আমি কখনো আসি না মা। আজই প্রথম আসছি। আমার ছেলে কাজ করতো, সেও কাজ করে না এখন, স্বামীর গাড়ির ইঞ্জিন নষ্ট। সেও কাজ করতে পারে না। তাই আসছি। অনেকটা একই ধরণের কথা জানাচ্ছিলেন, খামারবাড়ি এলাকায় টিসিবির ট্রাকের অপেক্ষায় থাকা রুশনি, শেফালি আক্তার, মনোয়ারা আক্তার, সালমা আক্তাররা। শুক্রাবাদ থেকে আসা মনোয়ারা আক্তার বলেন, আসছিলাম কিনতে, না পাইলে কি করবো, ফিরে যাবো।
ট্রাক আসতে দেরী, বিক্রি হতে দেরী হয় না : টিসিবির পক্ষ থেকে জানানো হয়, অনেক সময় গুদাম থেকে ট্রাকে পণ্য লোড করতে দেরী হওয়ার কারণে বিভিন্ন স্পটে পৌঁছাতে দেরি হয়। এছাড়া ঢাকায় দেড় শতাধিক পয়েন্টে সীমিত সংখ্যক ট্রাক দিয়ে পণ্য বিক্রি করা হয় বলে একই স্থানে প্রতিদিন ট্রাকগুলো যায় না।
টিসিবির তথ্য বলছে, ঢাকা মহানগরীতে ৭৫টিসহ সারাদেশে ৪৫১টি ডিলারের মাধ্যমে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকে করে পণ্য বিক্রি করা হচ্ছে। টিসিবির অনুমোদনের মাধ্যমে ট্রাকে করে পণ্য বিক্রি করে জাকিয়া রাইস। এই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম বলেন, ট্রাকে পণ্য লোড করে নির্ধারিত স্পটে গিয়ে প্যাকেট করতেই যা সময় লাগে তাদের। বিক্রি হতে মোটেও সময় লাগে না।
মি. ইসলাম বলেন, মঙ্গলবার চারশো কেজি চিনি, চারশো কেজি ডাল আর চারশো লিটার ভোজ্য তেল বিক্রির জন্য তুলেছেন তারা। বলছেন, মাত্র দুই থেকে আড়াই ঘণ্টার মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে সব পণ্য। বেড়েছে নতুন করে হওয়া গরীব : এদিকে চলতি বছরের এপ্রিল মাসে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার-পিপিআরসি ও ব্র্যাক ইন্সটিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট-বিআইজিডি যৌথভাবে একটি জরিপ পরিচালনা করেছিল। যেখানে দেখা যায়, করোনাভাইরাস মহামারির সময় দুই কোটি ৪৫ লাখের মতো মানুষ নতুন করে গরীব হয়েছেন। নতুন করে গরীব বলতে, কোভিডের আগে যারা দারিদ্র্যসীমার উপরে কিন্তু মধ্যম আয়ের নিচে ছিলেন এবং বর্তমানে দারিদ্র্য সীমার নিচে নেমেছেন তাদেরকে বোঝানো হচ্ছে। এই গবেষণা পরিচালনাকারীদের একজন বিআইজিডির অ্যাসেসিয়েট রিসার্চ ফেলো আতিয়া রহমান বলেন, নতুন করে যারা দরিদ্র হয়েছেন তাদের শুধু আর্থিক সহায়তা নয় বরং দক্ষতা বাড়িয়ে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে।
তিনি বলেন, যারা নতুন করে গরীব হয়েছে তাদের কর্মসংস্থান আর আগে থেকে গরীব থাকা মানুষের কর্মসংস্থানে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। এরা হচ্ছেন ছোট কিংবা মাঝারি উদ্যোক্তা ও তাদের কর্মচারী, স্বল্প দক্ষ শ্রমিক ও কর্মচারী ইত্যাদি। তারা মনে করেন, এসব মানুষকে শুধু নগদ আর্থিক সহায়তা দিয়ে তাদেরকে বর্তমান অবস্থার উন্নয়ন সম্ভব নয়। বরং তাদের দক্ষতা উন্নয়নের সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে, তাদেরকে স্বল্প সুদে ঋণ দেয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এছাড়া বিভিন্ন সংস্থার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে যাদের মাধ্যমে তারা ঘুরে দাঁড়াতে পারে। সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান বলেছেন, করোনাভাইরাসের কারণে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা যে বেড়েছে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। আর এ কারণেই যারা নতুন করে দরিদ্র হয়েছেন তাদের সহায়তায় সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচী বাড়ানো হয়েছে।
তিনি বলেন, নতুন করে তিন হাজার ২শ কোটি টাকা এ বছরের বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আর যারা কর্ম হারিয়েছেন তারা যাতে কাজের সুযোগ পান তার জন্য অর্থনীতিকে জিইয়ে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে।
এম এ মান্নান বলেন, অর্থনীতিতে জিইয়ে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। আর এ কারণেই লকডাউন চলা সত্ত্বেও পণ্যবাহী পরিবহন চলাচলে বাধা দেয়া হচ্ছে না। যাতে করে যেসব মানুষ দৈনন্দিন কায়িক পরিশ্রমের ভিত্তিতে আয় করে তারা কাজের সুযোগ পায়।
পরিকল্পনা মন্ত্রী জানান, যারা নতুন করে দরিদ্র হয়েছে তাদেরকে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হলে কাজের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। আর কাজের সুযোগও তৈরি হবে অর্থনীতি সচল থাকলে। সে বিষয়টির দিকেও নজর দেয়া হচ্ছে।