গ্রামের দিকে ছুটছে মানুষ
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১২:৫৫ এএম, ১৭ জুলাই,শনিবার,২০২১ | আপডেট: ০৬:০৪ এএম, ২০ নভেম্বর,
বুধবার,২০২৪
করোনা সংক্রমণের কারণে দুই সপ্তাহের লকডাউন শেষে আজ থেকে শুরু হয়েছে দূরপাল্লার গণপরিবহন। আজ শুক্রবার দ্বিতীয় দিনে যাত্রী চাপ কিছুটা বেড়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। সংক্রমণের ঝুঁকির মুখেও পরিবার-পরিজনের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে অনেকেই রাজধানী ছাড়ছেন। আবার অনেকেই বাস কাউন্টারগুলোতে ভিড় করছেন ঈদের আগের দু দিনের টিকিটের জন্য।
আজ শুক্রবার সকাল থেকে গাবতলী বাস টার্মিনাল ঘুরে দেখা গেছে, ছুটির দিন হওয়ায় টার্মিনালে যাত্রীর চাপ রয়েছে। কাউন্টারগুলোর সামনে বাসের অপেক্ষা করছেন ইতিমধ্যে টিকিট সংগ্রহ করা যাত্রীরা। তাদের অধিকাংশের মুখেই মাস্ক দেখা গেছে। আবার অনেক যাত্রীকেই ঈদের দু দিন আগের টিকিটের প্রত্যাশায় কাউন্টারগুলোতে ভিড় করছেন। বিকেলের নাগাদ এই চাপ আরও বাড়বে বলে মনে করছেন কাউন্টার সংশ্লিষ্টরা।
বাস টার্মিনালে অপেক্ষারত বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির বিষয়টি প্রায় সকলের জানা রয়েছে। তবে তারপরও ঝুঁকি নিয়ে গ্রামে যাচ্ছেন ঈদের আনন্দ পরিবারের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিতে। এদের মধ্যে অনেকেই রয়েছেন যারা বিভিন্নভাবে, এমনকি ভেঙে ভেঙে গ্রামে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন। গণপরিবহন ছেড়ে দেয়ায় তাদের মধ্যে স্বস্তিও দেখা গেছে।
সন্তানকে দেখতে রাজধানীতে এসেছিলেন বৃদ্ধ রাবেয়া খাতুন ও আসলাম মিয়া। ঢাকায় এসে লকডাউনের কারণে আটকে গিয়েছিলেন তারা। গণপরিবহন ছাড়ার খবরে কিছুটা হাফ ছেড়ে রাজধানী ছেড়ে যাচ্ছেন এই দম্পতি। তবে যাওয়ার সময় কিছুটা ভোগান্তির অভিযোগ করলেন তারা। আসলাম মিয়া বললেন, চুয়াডাঙ্গা পরিবহন বাসের টিকিট কেটেছি। সকাল ৯টায় ছাড়ার কথা থাকলেও দুপুর পর্যন্ত বাসের দেখা মেলেনি। বাড়ি যেতে হবে, তাইতো কিছুটা কষ্ট সহ্য করেও অপেক্ষা করছি।
বাস-টার্মিনাল
তামজীদ নামের এক যুবক গাবতলী বাস টার্মিনাল এসেছিলেন অগ্রিম টিকিট কিনতে। আগামী ১৯ জুলাই গ্রামের বাড়ি যাওয়ার জন্য অগ্রিম টিকিট নামের সোনার হরিণটা পাওয়ার চেষ্টা করছিলেন তিনি। টিকিট পাওয়ায় উচ্ছ্বসিত তামজিদ নিশ্চিন্ত মনে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন কাউন্টার থেকে। তিনি বলেন, পরিবারের সাথে ঈদ শেষ করে লকডাউনের আগেই চলে আসার চেষ্টা করবো।
পরিবারের এক সদস্যকে গ্রামে পাঠাতে রবিউল নামের আরেক যুবক এসেছেন অগ্রিম টিকিট কাটতে। কমফোর্ট পরিবহনের ১৭ তারিখের একটি টিকিটও পেয়েছেন তিনি। তবে এখনও শঙ্কা কাটেনি তার। আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, ঘাটে যে দীর্ঘ যানজটের কথা শুনতে পাচ্ছি তাতে বাড়িতে পৌঁছানো কত সময় লাগে তা নিয়ে তো কিছুটা শঙ্কা রয়েছেই।
এ এস এন্টারপ্রাইজ পরিবহনের মালিক আসাদুজ্জামান এরশাদ বলেন, শুক্রবার হওয়ায় আজ কিছুটা যাতে চাপ রয়েছে। তবে গাড়ি আসতে দেরি হওয়ার কারণে যাত্রীদের অপেক্ষা করতে হচ্ছে। ঘাটে জ্যাম থাকার কারণে যেসব গাড়ি গতকাল রাতেই ফিরে আসার কথা সেসব গাড়ি আসবে দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে।
শ্যামলী পরিবহনের কাউন্টার ম্যানেজার আলমগীর বলেন, আমাদের পরিবহনের অগ্রিম টিকিট বেশি বিক্রি হচ্ছে। ঈদের একদিন আগে টিকিট নাই বললেই চলে। ১৯ এবং ২০ তারিখের টিকিটের চাহিদাই বেশি রয়েছে।
দৌলতদিয়ায় পারাপারের অপেক্ষায় ৫ শতাধিক গাড়ি
লকডাউন শিথিল হওয়ায় চলছে গণপরিবহন। কোরবানির পশুবাহী ট্রাকের কারণে বেড়েছে যানবাহনের চাপ। তার ওপর পদ্মায় তীব্র স্রোতে বিঘিœত হচ্ছে ফেরি চলাচল। এমন সমীকরণেই রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া প্রান্তে সৃষ্টি হয়ছে পণ্যবাহী, পশুবাহী ও যাত্রীবাহী যানবাহনের দীর্ঘ সারি।
সরেজমিনে ঘাট এলাকায় দেখা যায়, দীর্ঘদিনের খরা কাটিয়ে স্বরূপে ফিরেছে দৌলতদিয়া ঘাট। এতদিন ঘাটে নদী পারের অপেক্ষায় মহাসড়কে যানবাহন দেখা না গেলেও গতকাল লকডাউন শিথিলের প্রথম দিন থেকেই দৌলতদিয়া ঘাট তার চিরচেনা রূপে ফিরে এসেছে। প্রতিটি যানবাহনকে ফেরি পারের জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে দীর্ঘ সময়।
সকাল ১০টা নাগাদ ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের দৌলতদিয়া জিরো পয়েন্ট থেকে দৌলতদিয়া ইউনিয়ন বোর্ড পর্যন্ত প্রায় ৩ কি.মি. এলাকায় তিন শতাধিক পশুবাহী ও যাত্রীবাহী যানবাহনের দীর্ঘ সারি দেখা গেছে। এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন চালক ও যাত্রীরা।
এছাড়া দৌলতদিয়া ঘাট এলাকায় যানজট এড়াতে রাজবাড়ী-কুষ্টিয়া আঞ্চলিক মহাসড়কের গোয়ালন্দ মোড় থেকে কল্যাণপুর পর্যন্ত ৩ কি.মি. এলাকায় দুই শতাধিক অপচনশীল পণ্যবাহী ট্রাক আটকে রাখা হয়েছে। যা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে রাতে সিরিয়াল অনুযায়ী পার করা হবে।
আটকে থাকা যানবাহনের যাত্রীদের দুর্ভোগের পাশাপাশি ট্রাকে করে বিক্রির জন্য নিয়ে যাওয়া গরুগুলো নিয়ে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন গরু ব্যবসায়ীরা। রোদ ও গরমে বেশির ভাগ গরু অসুস্থ হয়ে পড়ছে। পরিস্থিতি মোকাবিলা তাদের ভরসা হাত পাখা। প্রতিটি ট্রাকে ৮/১০ জন করে রাখাল গরুগুলোকে বাতাস করে চলেছে।
বরিশাল থেকে ছেড়ে আসা গোল্ডেন লাইন পরিবহনের চালক আলিম সরদার জানান, ভোরে দৌলতদিয়া ঘাটে এসে পৌঁছায়। কিন্তু এখন পর্যন্ত ফেরির নাগাল পাইনি। সিরিয়ালে দাঁড়িয়ে আছি। প্রচন্ড গরমে যাত্রীরা অতিষ্ঠ হয়ে যাচ্ছে। ফেরির নাগাল পেতে আরও ঘন্টা দুয়েক সময় লাগবে। ঘাটে পশুবাহী ট্রাক থাকায় বাড়তি চাপ রয়েছে। ফেরির সংখ্যা বাড়লে এই চাপ আর থাকবে না।
সুলতানপুর থেকে ট্রাকে গরু নিয়ে ঢাকায় যাচ্ছেন মোহাম্মদ আলী শেখ। তিনি জানান, ফজরের নামাজ পড়ে বাড়ি থেকে বের হয়েছি। এখন দৌলতদিয়া ঘাটে এসে আটকে পড়েছি। এই তীব্র গরমে গরুর স্ট্রোক করার আশঙ্কা থাকে। তাই একটু চিন্তাই আছি। ঠিকমতো গরু নিয়ে ঢাকায় পৌঁছাতে পারব কি না। তবে কখন ফেরির নাগাল পাব তা বলতে পারছি না।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিসি) দৌলতদিয়া ঘাট শাখার ব্যবস্থাপক শিহাব উদ্দিন বলেন, দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটে বর্তমানে ছোট-বড় মিলে ১৫টি ফেরি চলাচল করছে। ঈদুল আজহা উপলেক্ষ দু-একদিনের মধ্যে আরও দুটি রোরো ফেরি এ নৌরুটের বহরে যুক্ত হবে। এছাড়া ৩নং ফেরিঘাটটি সাময়িক সময়ের জন্য বন্ধ রেখে মেরামত করা হচ্ছে।
গাজীপুরে দুই মহাসড়কে তীব্র যানজট
১৪ দিনের লকডাউন শেষে গত বৃহস্পতিবার থেকে সড়ক ও মহাসড়কে যানবাহন চলাচল শুরু করেছে। সড়কে পশুবাহী ট্রাকের সংখ্যাও এখন বেশি। এ অবস্থায় শুক্রবার ছুটির দিনেও সকাল থেকেই গাজীপুরে দুই মহাসড়কে যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। ঘন্টার পর ঘন্টা যানজটে আটকা পড়ে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন যাত্রী ও পরিবহনকর্মীরা।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সকালে নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়কের গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার চন্দ্রা থেকে নবীনগর পর্যন্ত ১৬ কিলোমিটার যানজট, ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের নবীনগর থেকে হেমায়েতপুর পর্যন্ত ১৭ কিলোমিটার যানজট ছিল। এছাড়া ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের চন্দ্রা থেকে মৌচাক পর্যন্ত সড়কের বিভিন্ন স্থানে যানবাহনের জটলা লেগে ছিল। থেমে থেমে চলছিল সব ধরনের যানবাহন। একদিকে যানজটে ঘন্টার পর ঘন্টা আটকা, তার ওপর রোদের ভেতরে প্রচন্ড গরমে নাভিশ্বাস ওঠে যাত্রী ও পরিবহন কর্মীদের। সেই সঙ্গে বিক্রি করতে আনা কোরবানির পশু নিয়ে সড়কে আটকা পড়ে বিপাকে পড়েন মানুষজন।
সিরাজগঞ্জের তালগাছি গরুর হাট থেকে আটটি গরু নিয়ে ঢাকার গাবতলী হাটে যাচ্ছিলেন ব্যাপারী আবদুল মান্নান। তিনি বলেন, ‘সিরাজগঞ্জ থেকে চন্দ্রা আসতে সাধারণত সময় লাগে সাড়ে তিন ঘন্টা। কিন্তু আজ ভোর ৫টায় আমি রওনা হয়েছিলাম। চন্দ্রায় এসে পৌঁছেছি দুপুর সাড়ে ১২টায়। ঢাকায় যেতে কত সময় লাগবে, তা বুঝতে পারছি না। গরুগুলো গরমে অসুস্থ হয়ে পড়ছে।’
হাইওয়ে পুলিশ বলছে, ঈদ সামনে রেখে বিধিনিষেধ শিথিল করায় গাজীপুরের ঢাকা-ময়মনসিংহ এবং ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে যানবাহনের চাপ বেড়েছে। লোকজনের চলাচলও অনেক বেড়ে গেছে। সকাল থেকেই পণ্যবাহী বিভিন্ন ধরনের যানবাহনের সঙ্গে ব্যক্তিগত গাড়ি, দূরপাল্লার বাস কোরবানির পশুবাহী ট্রাকের সংখ্যা বেড়ে যায়। তাছাড়া বিআরটি (বাস র্যাপিড ট্রানজিট) প্রকল্পের কাজ চলমান থাকায় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তা থেকে টঙ্গী পর্যন্ত বিভিন্নস্থানে যানবাহন চলাচল করছে থেমে থেমে। সড়কের পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা কাজ করে যাচ্ছেন।
গাজীপুরের কোনাবাড়ী হাইওয়ে থানার ওসি মীর গোলাম ফারুক বলেন, পোশাক কারখানা ছুটি হলে সড়কে যানবাহনের চাপ আরও বাড়বে। তখন ভিড় বেশি হবে, তাই আগেই সাধারণ মানুষ বিশেষ করে যাদের ঢাকায় কোনো কাজ নেই, তারা আগেভাগে বাড়ি ফেরার চেষ্টা করছেন। সড়কের পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে পুলিশ চেষ্টা করে যাচ্ছে।
কালিয়াকৈর থানার ওসি মনোয়ার হোসেন চৌধুরী বলেন, কালিয়াকৈর অংশে যানজট তেমন নেই বললেই চলে। তবে নবীনগরের দিকে বেশ যানজট রয়েছে। এছাড়া গাজীপুরের ভোগড়া এলাকায়ও বেশ যানজট দেখা দিয়েছে। পুলিশ পরিস্থিতি মোকাবিলার চেষ্টা করছে।