তিন বস্তিতে আগুন উদ্দেশ্যমূলক না দুর্ঘটনা?
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৮:০৩ এএম, ২৬ নভেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২০ | আপডেট: ১০:১২ পিএম, ২২ নভেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
শীত এলেই নিম্ন আয়ের মানুষের পেছনে আগুন তাড়িয়ে বেড়ায়। শুষ্ক বাতাস আগুনকে আরও উসকে দেয়। এবারও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। সোমবার (২৩ নভেম্বর) রাত থেকে মঙ্গলবার মধ্যরাত পর্যন্ত রাজধানীর মহাখালীর সাততলা বস্তি, মোহাম্মদপুর বাবর রোডের বিহারিপট্টি ও মিরপুরের কালশী বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন বাউনিয়া বাঁধের বস্তিতে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় কেউ হতাহত না হলেও পুড়ে গেছে কয়েকশ ঘর। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নিম্ন আয়ের হাজারও মানুষ। বারবার বস্তিতে অগ্নিকান্ডের ঘটনা নাশকতা নাকি দুর্ঘটনা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
বস্তিবাসীর অভিযোগ, এসব অগ্নিকাণ্ডেন্ডর নেপথ্যে রয়েছে দখলদারিত্ব, চাঁদাবাজি এবং উচ্ছেদের কৌশল। প্রতি বছরই এসব অপতৎপরতার বলি হচ্ছেন তারা। কিন্তু তাদের পুনর্বাসনে এগিয়ে আসছে না সরকার। বস্তিতে অগ্নিকান্ডের বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতর বলছে ভিন্ন কথা।
সংস্থাটির ভাষ্য, অধিকাংশ ক্ষেত্রে বস্তিতে আগুনের পেছনে অবৈধ বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ দায়ী। তার পরও ওই তিনটি ঘটনায় আগুনের সূত্রপাত খতিয়ে দেখতে পৃথক কমিটি গঠন করেছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতর। শিগগিরই কমিটিগুলো প্রতিবেদন জমা দেবে।
এ কথা সত্যি যে, রাজধানীর কোনো বস্তিতেই আগুন নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নেই। সরু গলিতে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঢোকে না। ফলে ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয় না। এ ধরনের দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পেতে দরকার পরিকল্পিত নগরায়ন।
এসব অগ্নিকান্ড নিছক দুর্ঘটনা, নাকি উদ্দেশ্যমূলক তা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা উচিত বলে মনে করেন নগর বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম। গতকাল বুধবার দুপুরে তিনি বলেন, ‘সাধারণত বস্তিগুলো সরকার বা ব্যক্তি মালিকানাধীন পরিত্যক্ত জমিতে গড়ে ওঠে। অনেক সময় ভূমি মালিক জমি খালি করার জন্য বস্তিতে আগুন লাগিয়ে দেয়। এমন ঘটনা আগেও ঘটেছে। তাই সিটি করপোরেশন, থানা-পুলিশসহ সংশ্লিষ্টদের তদন্ত করে অগ্নিকান্ডের কারণ বের করতে হবে। পাশাপাশি ভুক্তভোগীদের সহায়তায় স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, অর্থাৎ সিটি করপোরেশনকে এগিয়ে আসতে হবে।’
মহাখালী সাততলা বস্তিতে আগুন : ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, সোমবার রাত ১১টা ৪৫ মিনিটে মহাখালীর সাততলা বস্তিতে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের ১২টি ইউনিট ঘটনাস্থলে গিয়ে এক ঘণ্টার মধ্যে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। এ ঘটনায় বস্তিটির ৬০-৭০টি বসতঘর ও দোকান পুড়ে যায়। এতে কেউ হতাহত হয়নি। গতকাল বুধবার দুপুরে এ প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত এ অগ্নিকান্ডের কারণ বের করতে পারেনি ফায়ার সার্ভিস।
ফায়ার সার্ভিসের তেজগাঁও স্টেশনের সিনিয়র স্টেশন অফিসার মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘সাত তলায় আগুনের সূত্রপাত এখনও বের করা যায়নি। বস্তিবাসীও সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলতে পারছেন না। ধারণা করা হচ্ছে, বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে এই আগুনের সূত্রপাত।’
এদিকে আগুনে নিঃস্ব হয়ে মঙ্গলবার খোলা আকাশের নিচে রাত কাটিয়েছেন সাততলা বস্তির ক্ষতিগ্রস্ত বাসিন্দারা। কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা থেকে তাদের খাবারের ব্যবস্থা করা হলেও সরকারের পক্ষ থেকে তারা কোনো ধরনের সহায়তা পাননি।
রিকশাচালক স্বামী ও দুই ছেলে-মেয়েকে নিয়ে এই বস্তির ছোট্ট একটি ঘরে থাকতেন রানু বেগম।
গতকাল বুধবার সকালে তিনি জানান, আগুনে তার ঘর পুড়ে ছাই হয়ে গেছে, কিছুই অবশিষ্ট নেই। ঘরে থাকা ৪০ হাজার টাকাও পুড়ে গেছে। এই শীতের রাতে বস্তির পাশে ফাঁকা জায়গায় বিছানা পেতে ঘুমিয়েছেন।
স্থানীয় বাসিন্দা আনোয়ার হোসেনের অভিযোগ, ‘এই বস্তির প্রতিটি ঘর এবং দোকান অবৈধ। এসব দোকান ও ঘর থেকে প্রতিমাসে ভাড়া, বিদ্যুৎ এবং গ্যাস বিল বাবদ কয়েক লাখ টাকা চাঁদা তুলতেন স্থানীয় কাউন্সিলর সমর্থক ও যুবলীগের কয়েকজন নেতা। এ নিয়ে তাদের মধ্যে দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্ব রয়েছে। ভুক্তভোগীদের ধারণা, পরিকল্পিতভাবে এই অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটানো হয়েছে।’
মোহাম্মদপুর বস্তিতে আগুন : সাততলা বস্তিতে অগ্নিকান্ডের ১৫ ঘণ্টার মাথায় মোহাম্মদপুরে বাবর রোডের বিহারী পট্টি জহুরি মহল্লার পাশে বস্তিতে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। ফায়ার সার্ভিসের ১০টি ইউনিটের দেড় ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। এতে পুড়ে যায় শতাধিক ঘর। কিন্তু এই ঘটনার সূত্রপাতও উদঘাটন করতে পারেনি ফায়ার সার্ভিস।
সেখানকার কয়েকজন বাসিন্দা জানান, এই বস্তির অধিকাংশ লোকজন মোহাম্মদপুর, হাজারীবাগের বিভিন্ন গার্মেন্টস, ফ্যাক্টরি, কারখানায় কাজ করেন। অগ্নিকান্ডের সময় তাদের অনেকেই বাসায় ছিলেন না। এ ঘটনার পেছনেও বস্তি দখলের দ্বন্দ্ব রয়েছে বলে মনে করছেন তারা।
মিরপুর বাউনিয়া বাঁধ বস্তিতে আগুন : গত বছরের ডিসেম্বরে বাউনিয়া বাঁধ পুকুর পাড় বস্তিতে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছিল। ১১ মাসের মাথায় মঙ্গলবার দিবাগত রাত ২টার দিকে মিরপুরের এই বস্তিতে ফের আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিসের ১২টি ইউনিটের চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। কীভাবে আগুনের সূত্রপাত এখনও তা আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়নি। এ ঘটনায়ও কেউ হতাহত হয়নি।
৭ বছর ধরে এই বস্তিতে থাকেন গার্মেন্ট শ্রমিক জুলহাস মিয়া। তিনি বলেন, ‘দুই-এক বছর পরপরই এই বস্তিতে আগুন লাগে। কিন্তু এসব ঘটনার সুনির্দিষ্ট কারণ কখনোই জানা যায় না।’
জুলহাস আরও বলেন, ‘বস্তির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে কয়েকটি গ্রুপ আছে বলে জানি। তারা বিভিন্ন সময় বস্তির ঘর ভাড়া, পানি, গ্যাস এবং বিদ্যুৎ বিল নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দ্বন্দ্ব লিপ্ত হন। বস্তিতে তাদের লোকজন মহড়া দেয়।’ কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের কোন নেতারা বস্তি নিয়ন্ত্রণ করেন, তা সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারেননি তিনি।
স্থানীয় বাসিন্দা রাকিব হাসান বলেন, ‘এই বস্তির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে স্থানীয় প্রভাবশালী দুটি গ্রুপের মধ্যে দ্বন্দ্ব রয়েছে। এই বস্তির একক নিয়ন্ত্রণের জন্য পরিকল্পিতভাবে এই অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটানো হয়েছে।’
অগ্নিকান্ডের পর বস্তি পরিদর্শনের সময় স্থানীয় সাংসদ ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লা সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘বস্তির ভেতর অনেকগুলো ব্যাটারিচালিত রিকশার গ্যারেজ ছিল। এসব গ্যারেজে অবৈধভাবে বৈদ্যুতিক সংযোগ নেয়া হয়েছে। সেখান থেকে অগ্নিকান্ডের সূত্রপাত বলে দাবি এই সাংসদের।’
ফায়ার সার্ভিসের তথ্যানুযায়ী, ‘গত বছর দেশে প্রায় ১৪৪টি বস্তিতে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে শুধু রাজধানীতেই ২৫ বার বস্তিতে আগুন লাগে। এসব আগুনে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছাড়িয়েছে শত কোটি টাকা। তবে চলতি বছরে দেশে কতগুলো বস্তিতে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে তা এখনও সমন্বয় করেনি ফায়ার সার্ভিস।’
জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. সাজ্জাদ হোসাইন বলেন, ‘শীতের মৌসুমে বস্তিগুলো অনেক শুষ্ক (বাঁশ, কাঠ) থাকে। ফলে কোথাও আগুন লাগলে মুহূর্তেই চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে অনেক সময় ফায়ার সার্ভিস পৌঁছানোর আগেই আগ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।’
তিনি বলেন, ‘বস্তিতে আগুন লাগলেই এর পেছনে রাজনৈতিক ইন্ধনের গুঞ্জন ওঠে। এটি দেখভালের দায়িত্ব ফায়ার সার্ভিসের নয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর।’