যে কারণে এখনও জলাবদ্ধতা
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০২:৪৮ এএম, ১১ জুন,শুক্রবার,২০২১ | আপডেট: ০৫:৩৮ এএম, ২১ নভেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
সামান্য বৃষ্টি হলেই ডুবে যায় রাজধানীর পথ-ঘাট। তবে রাজধানী ঢাকার জলাবদ্ধতা সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে বলে দুই মেয়রের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে। গত বছরের তুলনায় প্রধান সড়কগুলোতে জলাবদ্ধতা কম হলেও রাজধানীর নিম্নাঞ্চলের বাসিন্দারা এখনও দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। এর কারণ বিশ্লেষণে জানা যায়, ঢাকা দক্ষিণের ৬টি পাম্পের মধ্যে বর্তমানে তিনটিই বিকল, ওয়াসার যন্ত্রপাতির ৮০ ভাগ বিকল, ৫৫টি সুইসগেটের মধ্যে ৩৭টি বিকল, অকার্যকর ড্রেনেজ লাইন এবং উন্মুক্ত স্থানের অভাব পুরোপুরি সুফল আনার ক্ষেত্রে প্রধান বাধা।
৪৩টি খালের ২৬টির দায়িত্বে সিটি করপোরেশন : সংশ্লিষ্টদের দেয়া তথ্যমতে, বর্তমানে রাজধানীতে ৪৩টি খাল রয়েছে। এরমধ্যে ঢাকা ওয়াসার ২৬টি খালের দায়িত্ব দুই সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। বাকি ১৭টির দায়িত্ব এখনও গণপূর্ত, রাজউক, পাউবো ও জেলা প্রশাসকের কাছে রয়েছে। তবে দাফতরিকভাবে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের দায়িত্ব এখনও ঢাকা ওয়াসার। প্রশাসনিক এই জটিলতার মাঝেই বৃষ্টির পানি নিরসনে কাজ করছে দুই সিটি করপোরেশন। যদিও তার সুফল পুরোপুরি পেতে শুরু করেনি নগরবাসী। এ বিষয়ে সিটি করপোরেশন বলছে, অতিরিক্ত বৃষ্টি হলেও পানি আগের মতো দীর্ঘ সময় জমে থাকে না। আর নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু খাল আর ড্রেনকেন্দ্রিক চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে পানি নিষ্কাশনের জন্য উন্মুক্ত জায়গা সৃষ্টি করতে হবে।
বৃষ্টির পানি সরানোর দায়িত্ব এখনও ওয়াসার : ১৯৮৮ সালের আগে ঢাকার বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের দায়িত্বে ছিল জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের। কিন্তু ওই বছরের ৬ ডিসেম্বর স্থানীয় সরকার বিভাগের এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর থেকে এ দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসার ওপর ন্যস্ত করা হয়। অভিযোগ আছে, তারপর থেকে গত ৩৩ বছরে পানি নিষ্কাশনের ব্যাপারে ঢাকা ওয়াসা কোনও দায়িত্ব পালন করেনি। এ বিষয়ে ওয়াসার ভাষ্য ‘ভুল’ করে ঢাকার পানি সরানোর দায়িত্ব ওয়াসাকে দেয়া হয়েছে। এ অবস্থায় বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করতে চায় ওয়াসা। এ লক্ষ্যে চলতি বছরের ৪ জানুয়ারি একটি সংবাদ সম্মেলনও করেন ওয়াসার এমডি।
খালের দায়িত্বে সিটি করপোরেশন : গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর ঢাকা ওয়াসার মালিকানাধীন ২৬টি খালের দায়িত্ব দুই সিটি করপোরেশনকে দেয়া হয়। এর পর থেকে খাল পরিষ্কারে কোমর বেঁধে মাঠে নামে সংস্থা দুটি। যদিও নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু খাল পরিষ্কার করলেই জলাবদ্ধতা কমবে না। এজন্য সামগ্রিক ও সমন্বিতভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
ছয়টি পাম্পের তিনটিই বিকল : দুই সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ঢাকার চারদিকের নিম্নাঞ্চলগুলো দিনদিন ভরাট হয়ে যাচ্ছে। ফলে ঢাকা এখন ‘বালতির’ মতো হয়ে পড়েছে। তাই পাম্পিংয়ের মাধ্যমে পানি নিষ্কাশন করতে হয়। এরমধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটির মতিঝিল, দিলকুশা, দৈনিক বাংলা, শান্তিনগর, মালিবাগ, মৌচাক, সেগুনবাগিচা, পল্টন, বেইলি রোড, সিদ্ধেশ্বরী, সার্কিট হাউজ রোড, রাজারবাগ, শান্তিবাগ, ফকিরেরপুল ও আরামবাগের পানি সেগুনবাগিচার বক্স কালভার্ট-কমলাপুর পাম্প-মানিক নগর খাল-জিরানি খাল ও মান্ডা খাল হয়ে বালু নদী ও বুড়িগঙ্গায় পতিত হয়। কিন্তু এ এলাকায় ঢাকা দক্ষিণের একটি স্টেশনের ৩টি পাম্পের মধ্যে বর্তমানে দুটি বিকল হয়ে আছে। এখানকার প্রতিটি পাম্প প্রতি সেকেন্ডে ৫ হাজার কিউসেক পানি নিষ্কাশন করতে পারে। দুটি পাম্প বিকল থাকায় অতিরিক্ত বৃষ্টি হলে সমগ্র এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়। অপরদিকে কাপ্তান বাজার, লক্ষ্মীবাজার ও আগামসী লেনের পানি নিষ্কাশন করা হয় ইংলিশ রোড-ধোলাইখাল বক্স কালভার্ট হয়ে সূত্রাপুর পাম্প হাউজের মাধ্যমে। এখানকার ৩টি পাম্পের মধ্যে একটি বর্তমানে বিকল অবস্থায় রয়েছে। সচল পাম্প দুটি প্রতি সেকেন্ডে ৭ হাজার করে ১৪ হাজার কিউসেক পানি নিষ্কাশন করতে পারে। অর্থাৎ বর্তমানে দুই পাম্প হাউজের সচল ৩টি পাম্প দিয়ে সেকেন্ডে ১৯ হাজার কিউসেক পানি নিষ্কাশন করা সম্ভব হচ্ছে।
ওয়াসার যন্ত্রপাতির ৮০ ভাগই বিকল : ২৬টি খালের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভাগের যন্ত্রপাতিগুলোও সিটি করপোরেশনকে হস্তান্তর করেছে ঢাকা ওয়াসা। কিন্তু এসব যন্ত্রপাতির ৮০ শতাংশই বিকল বলে জানিয়েছে দুই সিটি করপোরেশন। এগুলো সচল করতে বিপুল অঙ্কের অর্থ খরচ করতে হচ্ছে সিটি করপোরেশনকে। এছাড়া জনবল দেয়ার কথা থাকলেও তা এখনও বাস্তবায়ন হয়নি।
পাউবোর ৫৫টি সুইসগেটের মধ্যে ৩৭টি বিকল : রাজধানীর চারদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন-ডিএসসিসির এলাকায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৫৫টি সুইস গেট রয়েছে। এর মধ্যে ৩৭টি সম্পূর্ণ বিকল ও ১৩টি আংশিক সচল রয়েছে। এসব সুইসগেট সংস্কার করে সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করার জন্য পাউবোকে চিঠি দিয়েছে ডিএসসিসি। তবে হস্তান্তর কার্যক্রম এখনও শেষ না হলেও গেটগুলো পরিষ্কার ও সচল করতে এরই মধ্যে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে বলে জানায় ডিএসসিসি।
দুরবস্থায় নিম্নাঞ্চলের মানুষ : ডিএসসিসিতে নতুন যুক্ত হওয়া ঢাকার পূর্বাঞ্চলের এলাকাগুলো বর্ষা এলেই পানিতে তলিয়ে যায়। নগরীর চারপাশের নদীগুলোতে পানি বাড়লে ওইসব এলাকার মানুষকে নৌকায় চলাচল করতে হয়। বছরের বেশিরভাগ সময় তাদেরকে পানিবন্দি অবস্থায় থাকতে হয়। এসব এলাকা নিয়ে এখনও পর্যন্ত কোনও উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ নেই সিটি করপোরেশনের। তবে ডিএসসিসির পূর্ব জুরাইন ও ডিএনডি বাঁধ এলাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে কাজ করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এ এলাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে পাম্পের মাধ্যমে পানি অপসারণের প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে প্রতিষ্ঠানটি। এ পর্যন্ত প্রকল্পের মাত্র ৩৭ শতাংশ অগ্রগতি হয়েছে। জানা গেছে, প্রকল্পের সুফল পেতে হলে এলাকার মানুষকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
অকার্যকর ড্রেনেজ লাইন : সূত্রমতে, ঢাকা মহানগরীতে প্রায় ২ হাজার ৫শ কিলোমিটার ছোট ড্রেনেজ লাইন রয়েছে। কিন্তু শক্ত ইটপাথর আর প্লাস্টিকের বর্জ্য জমে এসব ড্রেনের বেশিরভাগই বিকল হয়ে আছে। ফলে জমে থাকা পানি ছোট ড্রেন থেকে বড় ড্রেন বা খাল পর্যন্ত যেতে পারছে না।
সমতল নয় ঢাকা : অভিযোগ আছে, নগর পরিকল্পনার শুরু থেকে রাজধানী ঢাকাকে সমতলভাবে গড়ে তোলা হয়নি। দেখা যাচ্ছে, শহরের একটি এলাকা উঁচু হলে ঠিক তার পাশের এলাকাটি নিচু। এ কারণে উঁচু এলাকার পানি গড়িয়ে নিচু এলাকাগুলো ডুবে যায়। এছাড়া পানি নিষ্কাশনের ড্রেনগুলোও নির্মাণের সময়ও তলদেশ সমতল করে নির্মাণ করা হয় না, যে কারণে ড্রেনের পানি প্রবাহ স্বাভাবিক থাকে না।
উন্মুক্ত স্থানের অভাব : একটি আদর্শ বা বাসযোগ্য শহরে কমপক্ষে ৪০ ভাগ উন্মুক্ত এলাকা থাকা অবশ্যক। কিন্তু ঢাকায় ছিল মাত্র ১৮ ভাগ। এর মধ্যে মূল শহরে এই জায়গার পরিমাণ ১০ ভাগেরও কম। বর্ষায় যেসব এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা যাচ্ছে, সেসব এলাকায় উন্মুক্ত জায়গা বা মাটির অস্তিত্ব কম। এ কারণে জমে থাকা পানি শোষণ করে নিতে পারছে না মাটি বলে মনে করেন নগর বিশেষজ্ঞরা।
সুফল দিচ্ছে না হাতিরঝিল : রাজধানীতে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে জলাবদ্ধতা দূর করতেই হাতিরঝিল প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। কিন্তু প্রকল্পটি তার মূল উদ্দেশ্য পূরণে ব্যর্থ হচ্ছে। এ ছাড়া প্রকল্পের স্যুয়ারেজ লাইন নেটওয়ার্কের আওতায় এক হাজার ৮৩০ মিলিমিটার ব্যাসের আরসিসি পাইপ লাইনের স্বাভাবিক ধারণ ক্ষমতা ও কার্যকারিতা বজায় রাখাতে ১১টি স্পেশাল স্যুয়ারেজ ডাইভারশন স্ট্রাকচার (এসএসডিএস) নির্মাণ করা হয়েছে। এই এসএসডিএসগুলোর মধ্যে ৪টিতে মেকানিক্যাল স্ক্রিনিং মেশিন স্থাপন করা হয়।
জানা গেছে, ৪টির মধ্যে দুটি স্ক্রিনিং মেশিন বর্তমানে বিকল হয়ে আছে। ফলে এবারের বর্ষায় ঝিলের সবকটি গেট খুলে দেয়া হলেও আশপাশের জলাবদ্ধতা কমানো যায়নি।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক, নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, শুধু খাল পরিষ্কার করলেই জলাবদ্ধতা নিরসন হবে না। এই চিন্তা থেকে সিটি করপোরেশনকে বেরিয়ে আসতে হবে। নগরীতে কংক্রিটের আস্তর বাদ দিয়ে উন্মুক্ত জায়গা সংরক্ষণ করতে হবে। প্রাকৃতিক পদ্ধতির সঙ্গে সমন্বয় করে পরিকল্পনা করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, নগরীর জলাবদ্ধতার সমস্যার কোনও ‘ম্যাজিক’ সমাধান নেই। দীর্ঘদিন ধরে বিশাল একটি সমস্যা তৈরি হয়েছে, সেটি জাদুর মতো সমাধান হবে না। এই সংকট থেকে উত্তরণের বিষয়ে তিনি বলেন, জলাবদ্ধতার সমাধান চাইলে নগরীতে ২০-২৫ ভাগ সবুজায়ন থাকতে হবে। কমপক্ষে ৪০ ভাগ উন্মুক্ত এলাকা লাগবে। কিন্তু গত বছর পর্যন্ত আমাদের তা ছিল মাত্র ১৮ ভাগ। এর মধ্যে মূল শহরে উন্মুক্ত জায়গার পরিমাণ ১০ ভাগেরও কম। যেসব এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা যাচ্ছে, সেসব এলাকায় উন্মুক্ত জায়গা বা মাটির অস্তিত্ব নেই। মূলত বৃষ্টির পানি পড়ার পর কিছু অংশ মাটি শোষণ করবে, কিছু গাছপালা নেবে। বাকিগুলো খাল ও ড্রেন হয়ে নদীতে যাবে। কিন্তু আমাদের এসব ব্যবস্থা নেই বলেই জলাবদ্ধতা হয়।