বিনাভোটের সরকারকে ক্ষমতায় রাখায় বাজেটে আমলাদের বেশি বরাদ্দ : আলোচনা সভায় বিশিষ্টজনরা
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০২:৪১ এএম, ১১ জুন,শুক্রবার,২০২১ | আপডেট: ০৬:২৮ এএম, ২০ নভেম্বর,
বুধবার,২০২৪
২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট সাধারণ মানুষের জন্য নয়। এই বাজেটে আমলাদের খাতির করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন দেশের বিভিন্ন রাজনীতিবিদ ও বিশিষ্টজনরা।
আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালের বীর উত্তম মেজর হায়দার মিলনায়তনে ‘সচেতন নাগরিকদের দৃষ্টিতে ২০২১-২২ জাতীয় বাজেট’ শীর্ষক আলোচনা সভায় এসব কথা বলেন তারা।
গণস্বাস্থ্যের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, বাজেট হওয়া উচিত নাগরিকদের জন্য। আমি বাজেটটি দেখার চেষ্টা করেছি অর্থমন্ত্রীর শ্রেণি চরিত্রের আলোকে। বাজেটের প্রতিটি ক্ষেত্রে তার পেশা ও শ্রেণির প্রভাব পড়েছে। বাজেটে দুর্নীতিকে বহাল রাখার ফাঁক রয়ে গেছে। এটার উল্টাটা হওয়া উচিত ছিলো। তাদের সংসদে আসার আগে সবার সাথে আলোচনা করা উচিত ছিল। জনগণের মতামত নেয়া উচিত ছিল।
তিনি বলেন, বাজেটের ব্যাপারে আমলাদের খাতির করা হয়েছে। কারণ হলো ওনার পেশা। চার্টার্ড একাউন্টেন্ট হিসেবে উনি একটি শ্রেণিকে অনেক সুবিধা দিয়েছেন। আমলাদের বেতন অনেক বাড়ানো হয়েছে। গাড়ি কেনার জন্য ত্রিশ লাখ টাকা দেয়া হয়। পঞ্চাশ হাজার টাকা দেয়া হয় তা মেইন্টেন করার জন্য। উপকার পেয়েছে উচ্চ শ্রেণি। আমরা মধ্যম আয়ের দেশ কিন্তু মনোবৃত্তিটা পরিবর্তন হয়নি।
জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, যার আয় বছরে ৫ লাখ টাকা তার ট্যাক্সের আওতায় আসা উচিত। আমার প্রস্তাব ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ফ্রি করে দেন। তারপর থেকে ক্রমবর্ধমান হারে ট্যাক্স নিতে থাকেন। তাহলে বেশি সংখ্যক মানুষকে ট্যাক্সের আওতায় আনা যাবে। মনে রাখা দরকার সরকারের মূল আয় আসে ভ্যাট থেকে। ওষুধের কাঁচামালের ওপর কর কমিয়েছেন। কিন্তু সেটা ব্যবসায়ীদের হাতে ছেড়ে দেয়া যাবে না। নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। বেগম খালেদা জিয়ার আমলে ভুলের কারণে জনগণের এখানো ভোগান্তি হয়েছে। অগ্রিম ইনকাম ট্যাক্স দুর্নীতির একটি বড় কারণ। স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে লাভ হবে না। যদি না কিছু মৌলিক পরিবর্তন আনা যায়।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, নানা পর্যায়ে আলোচনা হওয়া উচিত। প্রথম কথা বাজেটের তিনটি দিক। বরাদ্দ, ক্ষমতাসীন দলের অর্থনৈতিক কৌশল, চলমান বাস্তবতার সঠিক প্রতিফলন। কৌশলের পেছনে অর্থনৈতিক দর্শনও কাজ করে। ক্ষমতাসীন দলের অর্থনীতির কৌশল থাকে চুইয়ে পড়া অর্থনীতির দিকে। অর্থমন্ত্রী এটার ওপরেই গুরুত্ব দিয়েছেন। শিল্পকারখানা, ব্যবসা বাণিজ্যে উন্নতি হলে সকল স্তরের মানুষ আস্তে আস্তে সুবিধা পাবে। এটাই এই নীতির মূল দর্শন।
তিনি বলেন, জিডিপির বৃদ্ধি চুইয়ে পড়া অর্থনীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এটার অসাড়তা নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। বাস্তবতার সাথে সেটা অনেকাংশেই মেলে না। আমাদের অর্থনীতিতে অবদান রাখছে কৃষি, ক্ষুদ্র ব্যবসা। সেখানে কত বরাদ্দ দেয়া হলো তা নিয়ে আলোচনা হওয়া উচিত। এটাই সত্য বাংলাদেশের জনগণ রেজিলিয়েন্ট।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. রেজা কিবরিয়া বলেন, অর্থমন্ত্রী ব্যর্থ বাজেট দিয়েছেন। উনি বড় শ্রেণির স্বার্থ রক্ষা করেছেন। কিন্তু দুঃখজনক ওনার শ্রেণির খুব বেশি মানুষ নেই। ক্যাপাসিটির তুলনায় আমরা ৪০ শতাংশ বিদ্যুৎ ব্যবহার করি। অথচ বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানিকে ৯ হাজার কোটি টাকা দেয়া হয়। শিক্ষা খাতের অবস্থা আপনারা জানেন। ছেলে মেয়েদের যে ঘাটতি হয়ে গেছে, এটা লাঘবে বরাদ্দ দেয়া উচিত ছিল। তিনি বলেন, চায়না থেকে আমরা ১০ ডলারে ভ্যাকসিন কিনেছি। ভ্যাক্সিনেশনের জন্য অনেক পরিমাণ বরাদ্দ দরকার। কিন্তু তা দেয়া হয়নি। এই ক্রিটিক্যাল সময়ে অর্থখাতে, স্বাস্থ্য খাতে অযোগ্য, বিলো এভারেজ মানুষকে দায়িত্ব দিয়ে প্রধানমন্ত্রী অপরাধ করেছেন।
জোনায়েদ সাকি বলেন, বাজেট হচ্ছে সরকারের আর্থিক নীতি। শুধু বরাদ্দ দিয়ে এটা বোঝা যায় না। যদি নীতিটাই ভুল হয় তাহলে বরাদ্দ বেড়ে লাভ নেই, বরং ক্ষতি। এখন সরকার স্বীকারই করতে চায় না যে, আড়াই কোটি মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে পৌঁছেছে। বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা যে তথ্য দিচ্ছে সরকার তা আমলে নিচ্ছে না। কারণ তাহলে তাদের নীতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। স্বাস্থ্য খাতে অগ্রাধিকার দেয়া উচিত ছিল। সব দেশই তা দিচ্ছে। ভ্যাক্সিনেশনে অগ্রাধিকার দেয়া উচিত ছিল। তা না হলে অর্থনীতি হুমকির মুখে পড়বে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ডাকসু) সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর জাতিসঙ্ঘের সরাসরি তত্ত্বাবধানে নির্বাচন চান। তিনি মনে করেন জনগণের কাক্সিক্ষত উন্নয়ন চাইলে এই ব্যবস্থা ছাড়া সামনে এগোনো সম্ভব না।
নুর বলেন, দীর্ঘদিন ধরে দেশে রাজনৈতিক সঙ্কট চলছে। আজকে সিরিয়ার নির্বাচন নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র বলছে সেখানে জাতিসঙ্ঘের তত্ত্বাবধানে একটি নির্বাচন দেয়া দরকার। সে ক্ষেত্রে আমার মনে হয় দেশের রাজনীতিবিদ ও বিশিষ্টজনদের এই বিষয়টি সামনে আনা উচিত। হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যাবস্থা ফিরিয়ে আনা এবং তার মাধমে রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসন করে অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা অন্যথায় জাতিসঙ্ঘের সরাসরি তত্ত্বাবধানে নির্বাচন করা। তাহলেই কেবল আমরা সেই জনগণের কাক্সিক্ষত বাজেট বা আমরা যে উন্নয়ন চাই তা দেখতে পাবো। গতকাল বৃহস্পতিবার বেলা ১২টায় ধানমন্ডির গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল বীর উত্তম মেজর হায়দার মিলনায়তনে এক আলোচনা সভায় তিনি এ মন্তব্য করেন। সচেতন নাগরিকদের দৃষ্টিতে ২০২১-২০২২ জাতীয় বাজেটের ওপর এ আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।
ভিপি নুরুল হক নুর বলেন, বর্তমানে যে সংসদ চলছে আমি এটাকে বৈধ মনে করি না। একটা বাজেট দিয়েছে তাই আমরা প্রতিক্রিয়া দিচ্ছি। এই তথাকথিত সংসদেও আলোচনা হয়েছে যে, মন্ত্রণালয়কে দুর্নীতির ডিপো হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। সেই দুর্নীতিবাজ স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এমনকি যারা দুর্নীতির খবর প্রকাশ করেছে তাদের গলা চেপে ধরছে, কারা? আমলারা যারা এই বিনা ভোটের সরকারকে ক্ষমতায় রেখেছে। এই বাজেট ঘোষণার নৈতিক ভিত্তি এই বিনা ভোটের সরকারের নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, যতটুকু ঘোষণা করেছে আমরা একটা দাবি জানাবো মাত্র। যে ক্ষেত্রে যতটুক বরাদ্দ দেয়া হয়েছে তা যেন নিশ্চিত করা হয়। দুর্নীতি রোধে যেন কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হয়।
নুর বলেন, যখন আমরা জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করতে পারবো সেটা হোক গণ-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। কিংবা নিরপেক্ষ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে, কিংবা জাতিসঙ্ঘের অধীনে সেই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আমরা যে বাংলাদেশ পাবো তখন আমরা জনগণের কাক্সিক্ষত বাজেট নিয়ে হয়তো আলোচনা করতে পারবো। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের গণমাধ্যম উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম মিন্টুর সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন বাসদের সাধারণ সম্পাদক কমরেড খালেকুজ্জামান, জেএসডির সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন প্রমুখ।