এম আবদুল্লাহ
তারেক রহমান থেকে কিশোর : বিবেকের বন্দীত্ব
প্রকাশ: ০৩:৪৩ এএম, ৮ মার্চ,সোমবার,২০২১ | আপডেট: ১০:৪৭ পিএম, ২১ নভেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
"রিমান্ডে থাকাকালে ৩১ ডিসেম্বর আমার ওপর নানা রকমের দৈহিক নির্যাতন করা হয়। এর মধ্যে একটি ছিল অনেক উপরে থেকে বার বার ফেলে দেয়া। অসহ্য যন্ত্রণায় আমি কুঁকড়ে উঠেছি। কিন্তু নির্যাতনকারী অফিসারদের বিন্দুমাত্র মায়া-দয়া হয়নি। ওদের দায়িত্ব ছিল আমাকে কষ্ট দিয়ে মেরে ফেলা। তার পর থেকে দীর্ঘ সময় কারাগারে। কোন ডাক্তার নেই। চিকিৎসা হয়নি। প্রতিটি দিন কেটেছে নারকীয় যন্ত্রণায়। একজন রাজনীতিকের বিরুদ্ধে মামলা হতে পারে, গ্রেফতার চলতে পারে। কিন্তু নির্যাতন করা, শরীরের অঙ্গ বিকল করার, মানবাধিকার পদদলিত করার অধিকার সভ্যজগতে কোথায় আছে?।"
তারেক রহমানের এভাবেই প্রশ্ন তুলেছিলেন তাঁর ওপর চলা নির্দয় নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে। এক-এগারোর মইন ফখরুদ্দীন সরকারের আক্রোশের শিকার তারেক রহমানকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যে বর্বরতা চালানো হয়েছিল তার খুব সামান্যই নিজ জবানিতে বর্ণনা দিয়েছেন তারেক রহমান। একটি সাক্ষাৎকারে এ নিয়ে কথা বলতে অনীহা প্রকাশের পরও খুব পীড়াপীড়িতে এটুকু বলেন মহান স্বাধীনতার ঘোষক, বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা, স্বনির্ভর বাংলাদেশের স্থপতি ও নন্দিত রাষ্ট্র নায়ক, সফল প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এবং বিএনপি চেয়ারপার্সোন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার জ্যেষ্ঠ পুত্র তারেক রহমান। তিনি এখন কোটি মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার ঠিকানা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান।
২০০৭ সালের ৭ মার্চ। কোন ওয়ারেন্ট ছাড়াই ঢাকা সেনানিবাসের শহীদ মইনুল রোডের বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় তারেক রহমানকে। মা সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বুকফাটা আর্তনাদ ও আজোর কান্নার মধ্যেই তারেক রহমানকে ওরা নিয়ে যায়। রিমান্ডে থাকাকালে তারেক রহমানের ওপর নেমে আসে নির্মম নিষ্ঠুর নির্যাতনের বিভীষিকা। বর্বরতার অনেক পদ্ধতির অন্যতম ছিল অনেক উপরে তুলে ছেড়ে দেওয়া। এটা একবার নয়, বার বার, বহুবার।
মৃতপ্রায় তারেক রহমান নির্যাতনের কিছু দিন পর ২০০৮ সালের জানুয়ারিতে আদালতে নিরাপত্তা চাইলেন। আদালতে তিনি বললেন- " জিজ্ঞাসাবাদের নামে রিমান্ডে নিয়ে অজ্ঞাত স্থানে চোখ বেঁধে ২৪ ঘন্টার মধ্যে ১৮ ঘন্টা নির্যাতন করা হয়েছে। আমি একজন রাজনীতিবিদ। কোন সন্ত্রাসী নই। রিমান্ডে আবার নির্যাতন হলে আমি বাঁচাবো না।"
অনেকের স্মরণ থাকার কথা, এম্বুলেন্সে করে আদালতে নিয়ে হুইল চেয়ারে কাঠগড়ায় উঠানো তারেক রহমানের মেরুদণ্ডের হাড় ভেঙ্গে যাওয়ার কারণে হুইল চেয়ারেও বসতে পারছিলেন না। এক পযার্য়ে আদালতের নির্দেশে বিএসএমএমইউতে ভর্তি করা হলে শারীরিক পরীক্ষায় দেখা যায় সুস্থ সবল অবস্থায় আটক তারেক রহমানের মেরুদণ্ডের ৬ ও ৭ নম্বর হাড় ভেঙ্গে গেছে। ৩৩টি হাড়ের দূরত্ব কমে গেছে। বাংলাদেশে এর চিকিৎসা সম্ভব নয় বলে ডাক্তাররা জানান।
৫৫৪ দিন কারাবাসের পর প্রথম পিজি হাসপাতালে মা বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা হয়। সেদিন কান্নায় ভেঙ্গে পড়া মায়ের বুকে মাথা রেখে বেদনার্ত তারেক রহমান রোদন ও বাষ্পরুদ্ধ কথোপকথন হাসপাতালের বাতাসকে ভারী করে তুলেছিল। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার সংগ্রামে আপোষহীন নেত্রী খ্যাতি পাওয়া বেগম খালেদা জিয়ার সেই কান্নার আলোকচিত্র এখনও ভার্চুয়াল জগতে ভাসছে।
আজ কার্টুনিস্ট কিশোরের ওপর নির্যাতন নিয়ে বিবেকবান মানুষ সোচ্চার। আমিও কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছি। মুশতাকের মৃত্যুতে সচেতন জনগণ ফ্যাসিবাদের পতন চাইছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুলকে দেখলাম, প্রেস ক্লাবের সামনে মুশতাকের জন্য নিজেই শ্লোগানে ধরতে। শীর্ষ সংবাদপত্রে কলাম দেখছি ধরাবাহিক। মুশতাক-কিশোরের ওপর নির্যাতনের প্রতিকার চাইবোইতো।
কিন্তু ফ্যাসিবাদ কি এক দিনে দানবীয় রূপ নেয়? না। দিনে দিনে ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দানব তৈরি হয়। আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে একটি সংবাদের জেরে ২৮ মামলা দিয়ে তুলে নিয়ে ক্যান্টমেন্ট থানা, ডিবি অফিসসহ নানা গোপন কুঠুরিতে কি আদর করা হয়েছিল? তা জাতি দেখেছে। ক্যান্টনমেন্ট থানার সেলে মধ্যরাতে অচেনা ঘাতক দল বিবস্ত্র করে, নির্যাতনের পর মৃত ভেবে দ্রুত চলে যাওয়ার বর্ণনা তাঁর লেখা 'জেল থেকে জলে' বইতে পড়ে অশ্রু সংবরণ করা যায়নি। তারেক রহমানের মতই ভাগ্যজোরে তিনি বেঁচে যান। জ্যেষ্ঠ সম্পাদক শফিক রেহমানকে ভুয়া অভিযোগে দিনের পর দিন রিমান্ডে ও কারাগারের মেজে শুইয়ে রেখে কি মানবাধিকার সমুন্নত করা হয়েছিল? ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনকে একটি বাক্য উচ্চারণের মূল্য কিভাবে পরিশোধ করতে হয়েছিল? গুণী লেখক, সম্পাদক আবুল আসাদ এক বছর জেলে কি জামাই আদরে ছিলেন? এখনও দুই সাংবাদিক নেতা রুহুল আমিন গাজী ও সাদাত হোসাইন কারাপ্রকোষ্টে ধুঁকছে কি খুন করে? শাপলা চত্বরে গণবিস্ফোরণের পর হেফাজতের বর্তমান আমীর জুনায়েদ বাবুনগরীর গ্রেফতার-রিমান্ড পরবর্তী অবস্থা ভুলে যেতে হবে? শিবির সভাপতি দেলোয়ারকে পাঁজা কোলে করে আদালতে ওঠানোর দৃশ্য কে দেখেনি?
এভাবে ১২ বছরের উদাহরণ দিতে ১২ হাজার ফর্মার বই প্রকাশ করতে হবে।
তারেক রহমানের সব কাজ আমি পছন্দ করি, তা মনে করার কোন কারণ নেই। তিনিও আমার সবকিছু পছন্দ করবেন এমনটা প্রত্যাশা করি না। ভুল ত্রুটির উর্ধ্বে আমরা কেউ নই। তাই বলে প্রতিশোধ নিতে পৈশাচিক কায়দায়? তার প্রতিবাদ হবে না? তারেক রহমানের ওপর যা হয়েছে তার প্রতিবাদ আমরা করেছি? তাঁর বিরুদ্ধে আনা কোন অভিযোগ নিরপেক্ষ তদন্ত ও বিচারে আজ পর্যন্ত প্রমানিত হয়েছে?
আজ যারা অজ্ঞাত নীপিড়কদের বিরুদ্ধে এতটা সোচ্চার তারা কি মিন মিন করেও তারেক রহমানের ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়েছিলেন। মাহমুদুর রহমাননের ক্ষেত্রে প্রতিবাদ যেটুকু হয়েছে তা দায়সারার। কেন এই ডাবলস্ট্যান্ডার্ড? কথিত সুশীলীয় প্রতিবাদ কি শুধু প্রগতিশীলতার মোড়কে ইসলামবিদ্ধেষীদের জন্য? যদি তাই হয়, মনে রাখবেন, তারেক বা মাহমুদুর রহমান থেকে মুস্তাক-কিশোর পর্যন্ত আসতে দশ-বারো বছর লাগলেও কারো কারো ক্ষেত্রে ভাগ্যের পরিণতি এত সময় নাও লাগতে পারে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলে যারা মুখে খই ফোটাচ্ছেন, কলমে ঝড় তুলছেন, সংবিধানের মৌলিক অধিকারের বিধান পদদলিত করে তারেক রহমানের বক্তব্য প্রচারে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার বিরুদ্ধে টু শব্দটিও কি তার করেছেন? জগতের কোথাও কি এমন আদেশের নজীর পাওয়া যাবে? আগে বিবেকের বন্ধ্যাত্ব ও চিন্তার বন্দীত্ব থেকে মুক্ত হতে হবে, তবে ফ্যাসিজমের কবল থেকে মুক্তির পথ সুগম হবে।
লেখকঃ এম-আবদুল্লাহ
সাংবাদিক, কলামিস্ট ও সভাপতি বিএফইউজে