অ্যাডভোকেট মুহাম্মদ শাহ্ আলম
প্রাকৃতিক দুর্যোগ কোভিড-১৯
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৬:৩৮ পিএম, ২৯ এপ্রিল,বৃহস্পতিবার,২০২১ | আপডেট: ০৬:৩৭ এএম, ২৩ নভেম্বর,শনিবার,২০২৪
আবহমান কাল থেকে বাংলায় একটি প্রবাদ চালু আছে ‘সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের দশ ফোঁড়’। অর্থাৎ ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র তথা জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যা কিছু অবদান রেখেছে সবকিছুতেই সময়ের বিশেষ ভূমিকা বিদ্যমান। সময়মত সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হলে অনেক মূল্যবান বিষয় নষ্ট হয়ে যায়। ফলে অনেক সময় দিতে হয় চরম মূল্য।
সময় মানে সেকেন্ড, মিনিট, ঘণ্টা, দিন, মাস, বছর পেরিয়ে যুগ ও শতাব্দী। এই সময়কে উপলব্ধি করা এবং মানব সভ্যতার কাজে গতিশীলতার জন্য বিভিন্ন সময়ে প্রবর্তন করা হয়েছে হিজরি বা খ্রিষ্টপূর্ব, ইংরেজি ও বাংলাসহ বিভিন্ন বর্ষপঞ্জিকা। নভোমন্ডল এবং পৃথিবী তথা গ্রহ- উপগ্রহ, চন্দ্র-সূর্য সৃষ্টির পর থেকেই সময় তার আপন মহিমায় সম্মুখগতিতে কালাতিক্রম করে চলেছে। কাজেই মানব জীবনে সময় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। সময় যেমন কারও জন্য কিংবা কোনো কিছুর জন্য অপেক্ষা না করে তার আপন গতিতে অতিবাহিত হয়, তেমনি সময়ের গতির সাথে তাল মিলিয়ে ভূপ্রকৃতিতে কমবেশি পরিবর্তন ঘটে থাকে।
নদ-নদী, পাহাড়, সমুদ্র, বনভূমি, জলবায়ুসমূহে সময়ের সাথে ন্যাচার্যালি পরিবর্তন সাধিত হয়, তেমনি ভূমিকম্প, বন্যা, খরা ইত্যাদি নানান কারণে সমতল ভূমিতে ক্ষেত্র বিশেষে বিভিন্ন গুণগত পরিবর্তন সাধিত হয়ে থাকে। বিশেষ করে মানবসভ্যতা এবং ব্যক্তিজীবনে সময়ের প্রভাব মারাত্মকভাবে বিদ্যমান। পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকে শুরু করে দীর্ঘ সময়ের পরিক্রমায় যেমন অনেক নগর-বন্দর গড়ে উঠেছে তেমনি সময়ের ব্যবধানে অনেক নগরী এবং এর নাগরিকরা ধ্বংস হয়ে গিয়েছে মানবসৃষ্ট যুদ্ধ-বিগ্রহ এবং ভূমিকম্প, বন্য, খরা, জলোচ্ছ্বাসসহ নানান প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে।
তাছাড়া রাজনৈতিক বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামেও স্বল্প কিংবা বৃহৎ পরিসরে ইতিহাসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে থাকে। সময়ের উত্তাল চাহিদায় বিশ্বের বিভিন্ন জনপদে সংঘটিত এইসব ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর মধ্যে যেমন মানবকল্যাণকর অনেক ঘটনা আমাদেরকে উজ্জীবিত করে, তেমনি ক্ষমতালোভী রাজা-বাদশা ও স্বৈরশাসকগণ নিজের ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী ও দীর্ঘায়িত করতে দীর্ঘ সময় ক্ষমতার স্বাদ ও গন্ধ উপভোগ করতে হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসলীলা সাধিত করে থাকে। এমনকি ক্ষমতার জন্য নিজের পিতা, ভাই কিংবা নিকট আপনজনদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র, বন্দি এমন কি হত্যা করতেও দ্বিধাগ্রস্ত হয়নি, ইতিহাসে যার ভূরি ভূরি প্রমাণ রয়েছে। যদিও ওই সমস্ত স্বৈরশাসকদের অধিকাংশের প্রস্থান বা ক্ষমতা থেকে বিধায় নেওয়ার দৃশ্য ছিল নির্মম বেদনাদায়ক। কিন্তু কোন ক্ষমতাসীন স্বৈরশাসকই ইতিহাস থেকে কিংবা ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে নাই।
মানুষের ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনেও সময়ের প্রভাব অনস্বীকার্য। সে রাজা-বাদশা, পাইক-পেয়াদা, ধনী-গরিব যে শ্রেণী-পেশার মানুষই হউন না কেন সময়মত সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হয়ে অনেক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হতে হয়, ক্ষেত্রমতে চরম মূল্য দিতে হয়।
সময়ের ব্যবধানে পারিপার্শ্বিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে লোভ-লালসা, ক্ষমতার দম্ভ ও স্বার্থপরতায় নিপতিত হওয়ার কারণে বন্ধু-শত্রুতে, শত্রু-বন্ধুতে, নিকটতম ব্যক্তি দূরে সরে যায়। ন্যায় নীতি পরিহার করে অনেকে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছে রূপান্তরিত হয়। আবার ভাগ্যের নির্মম পরিহাসের কারণে কিংবা সময়মত সঠিক সিদ্ধান্তের অভাবে প্রতিষ্ঠার সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সর্বস্বান্ত হয়ে যাচ্ছে। অলসতা এবং কর্মের সঠিক সময় উপলব্ধি করতে না পারার কারণে মানুষ অনেক মূল্যবান কর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আবার চলমান সময় মানুষকে অনেক ক্ষেত্রে পরিপক্ব করে বোধশক্তিকে জাগ্রত করে তুলতে সাহায্য করে।
অনেক ক্ষেত্রে চলমান বাস্তবতা শিক্ষক ও জ্ঞানীগুণীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। ফলে মানুষ বাস্তবতার নিরিখে অভিজ্ঞতার ভান্ডার পূর্ণ করে। প্রশ্ন হচ্ছে সময়ের পরিক্রমায় যে অভিজ্ঞতা অর্জিত হয় তার কতটুকু আমরা কাজে লাগাতে পারছি বা নিজের ক্ষেত্রে প্রয়োগের জন্য কি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পেরেছি। আমরা সকলেই অবগত আছি মানুষ জন্মের পর যেকোন সময় মৃত্যুবরণ করতে পরে, তথাপি একজন শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর ব্যতিক্রম ছাড়া তাকে তিনটি অধ্যায় অতিক্রম করতে হয়। শিশু থেকে কৈশোর যে সময়টাতে তাকে পিতা-মাতা, ভাই-বোন, আত্মীয়দের কল্যাণে বেঁচে থাকতে হয় এবং নিজের ভবিষ্যতের সিঁড়ি তৈরি হয়। দ্বিতীয় ধাপ মানুষের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময় যৌবন, যখন মানুষ অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলতে পরে। নিজস্ব ভুবনে প্রতিষ্ঠার চূড়ায় পৌঁছে নিজের পরিবারের সদস্যদের জন্য সম্ভব সবকিছু করে থাকেন অকাতরে। তৃতীয় বা শেষ ধাপ মানুষের অবসর বা অন্তিম সময়। যে সময়টাতে মানুষ নিজেকে, পরিবারকে ও রাষ্ট্রকে কিছুই দিতে পারে না বরঞ্চ সেই অন্তিম সময়ে বৃদ্ধ মানুষগুলো তাদের একাকীত্ব দূর করতে রাষ্ট্রের কাছে বিশেষ করে পরিবার তথা আপনজনদের কাছে সঙ্গ চায়।
এই লেখায় কথাগুলো এই কারণে উল্লেখ করলাম অতিসম্প্রতি আমাদের একজন সম্মানিত সিটিজেন যেভাবে একাকী নিজ বাসায় শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন তা অত্যন্ত বেদনাদায়ক, একই সঙ্গে প্রতিটা মানুষের জন্য শিক্ষণীয় এই কারণে যে আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে কি ভাবছি। এতক্ষণ যার কথা বলছি তিনি হলেন বিশিষ্ট লেখক, খ্যাতনামা কলামিস্ট, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রফেসর তারেক শামসুর রাহমান। এ গুণী ব্যক্তির লাশ নিজের বাসা থেকে দরজা, তালা ভেঙে উদ্ধার করা হয়েছে, বাসায় তিনি ছিলেন একা। স্ত্রী ও কন্যা আছেন যথারীতি ‘স্বপ্নের দেশ’ যুক্তরাষ্ট্রে, অসুস্থ ও মৃত্যুর সময় কেউ ছিল না তাঁর পাশে, আপনজনদের কেউ কিছু জানেনি বা হৃদয় থেকে জানার তাগিদ অনুভব করেনি বলেই মনে হয়েছে। অথচ উনার টাকা-পয়সা, যশ-খ্যাতি, পরিচিতি সবই ছিল। কিন্তু পাশে ছিল না নিজ পরিবারেব আপনজনদের কেউ।
এই প্রথম বা একমাত্র ঘটনা নয়, এমন অসংখ্য ঘটনা আছে। প্রশ্ন হচ্ছে এমন বেদনাবিধুর অন্তিমযাত্রা থেকে আমরা কি শিক্ষা নিচ্ছি? আসলে সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে নিজের এবং পরিবারের সদস্যদের প্রতিষ্ঠার স্বপ্নিল বাসর গড়তে গিয়ে একজন মানুষ যুবক ও মধ্যবয়সে প্রচুর পরিশ্রম করে নিজের এবং স্ত্রী-সন্তানদের সুখ-সমৃদ্ধির জন্য পারিবারিক মমত্ববোধ ও দায়দায়িত্ব পালনে সম্ভব সবকিছু করে থাকে অথচ সেই মানুষটা বয়ঃসন্ধিকালে হয়ে যায় চরমভাবে একা। সমাজ-সংসারে উপেক্ষিত। পরিবারেব অন্য সদস্যরা নিজেদর স্বপ্নের মত প্রতিষ্ঠার জন্য ছুটছে যে যেভাবে পারে।
তাদের খেয়াল করার অবকাশ নেই, একসময় তাদেরকেও বয়ঃসন্ধিকালে পৌঁছতে হবে তখন কি হবে? শুধুই কি নিরন্তর একাকীত্ব? তাছাড়া এমনিতেও বর্তমান সময়টা মানবজাতির জন্যে মোটেও ভাল যাচ্ছে না। গত প্রায় এক বছরের বেশি সময় ধরে বিশ্ব এক জটিল ও কঠিন সময় পার করছে।
বিশ্ববাসীর সামনে নতুন এক বিপদ, এক সমস্য, নতুন এক আতংক এসে উপস্থিত হয়েছে যার নাম কোভিড-১৯ বা করোনা ভাইরাস। যার সাথে ইতিপূর্বে মানবসভ্যতার পরিচয় ছিল না। এটি এমন এক ভাইরাস যা এক মানুষ থেকে অন্য মানুষের শরীরে অতি দ্রুততার সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে। ২০২০ সালের নববর্ষের শুরুতেই বিশ্ববাসীর জন্য এটি মূর্তমান আতংক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
এ ভাইরাসটি ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে প্রথমে ধরা পড়ে চীনের উহান প্রদেশে। পরবর্তীতে এটি নিয়ন্ত্রণহীনভাবে ছড়িয়ে পড়ে গোটা বিশ্বে। এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকাসহ পৃথিবীর ২১০ ও বেশি দেশে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছে প্রাণঘাতী এ সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত। বিশ্বব্যাপী এই প্রাণঘাতী করোনায় ইতোমধ্যে মৃত্যু ৩০ লাখ ছাড়িয়েছে। আক্রান্ত হয়েছে ১৪ কোটির বেশি। গত বছর ৮ মার্চ আমাদের দেশে প্রথম করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ে। করোনা শনাক্ত হওয়ার পর থেকে ইতোমধ্যে দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ৭ লাখ ৩৬ হাজারের বেশি।
এর মধ্যে সুস্থ হয়েছেন ৬ লাখ ৪২ হাজারের বেশি মানুষ। দেশে এ পর্যন্ত করোনায় মৃত্যুবরণ করেছে প্রায় ১১ হাজার। প্রাণঘাতী এ করোনা মানুষের জীবন কেড়ে নেওয়ার পাশাপাশি বিশ্ব স্বাস্থ্য এবং বিশ্ব অর্থনীতিতে মারাত্মক রকমের ক্ষতিকর প্রভাত ফেলেছে। অনেক শিল্প-কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। মানুষ বেকার হয়ে আনেক পরিবার নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। লেখাপড়ার মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই অবস্থায় সময়ই বলে দেবে আগামী দিনগুলোতে আমাদের জন্য কি অপেক্ষা করছে। ভাগ্য আমাদেরকে কোন পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড় করায়।
লেখক : আইনজীবী ও কলামিস্ট