মোদির বাংলাদেশ সফরে ক্ষোভ দিল্লির জন্য সতর্কবার্তা : বিবিসি
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ০১:৩৫ এএম, ২ এপ্রিল,শুক্রবার,২০২১ | আপডেট: ০৭:০৭ পিএম, ২২ নভেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
বাংলাদেশ আশা করেছিল স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে গত সপ্তাহে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির উপস্থিতি স্মরণীয় হয়ে থাকবে। কিন্তু তার এ সফর ভয়াবহতায় পরিণত হয়েছে। মোদির বিরুদ্ধে সহিংস বিক্ষোভ হয়েছে। তাতে কমপক্ষে ১২ জন নিহত হয়েছেন। দেশে এবং বিদেশে মোদি একজন ‘পোলারাইজিং ফিগার’। হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদী ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) নেতৃত্বাধীন তার সরকার মাঝে মাঝেই অভিযুক্ত হয়েছে নীতি গ্রহণের ক্ষেত্রে, যে নীতিতে মুসলিম সংখ্যালঘুদের টার্গেট করা হয়েছে। মুসলিমদের বিরুদ্ধে সহিংসতা কমাতে তার সরকার যথেষ্ট করেনি। তবে এসব অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে বিজেপি। মোদির বিতর্কিত ভাবমূর্তি দৃশ্যত বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় প্রতিবাদ বিক্ষোভ এবং সহিংসতা ছড়িয়ে দিয়েছে বলে মনে করা হয়। এতে সন্দেহ নেই যে, এ ঘটনায় উভয় দেশই বিব্রতকর অবস্থায়। এছাড়া ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিদ্যমান বলে সব সময় বলা হয়। কিন্তু সেই সম্পর্কে এতে ছায়া ফেলবে।
কি ঘটেছে বাংলাদেশে?
বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে ২৬ মার্চ দু দিনের সফরে ঢাকা আসেন মোদি। কাকতালীয়ভাবে এই স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর সময়ে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী। অনুষ্ঠানগুলোতে গেস্ট অব অনার হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা, ভুটান ও নেপালের নেতারা। কিন্তু ১০ দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের সূচনাপর্বে যোগ দিতে মোদির সফরকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভ শুরু হয়। ২৬ মার্চ ঢাকার একটি মসজিদে নামাজের পর মুসলিমদের একটি গ্রুপ প্রতিবাদ বিক্ষোভ করেন। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যে সেখানে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে, লাঠিচার্জ করে তাদেরকে ছত্রভঙ্গ করতে। এরপরই দেশের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে বিক্ষোভ। নরেন্দ্র মোদির সফরের বিরুদ্ধে র্যালিতে হামলার প্রতিবাদে ২৮ মার্চ দেশজুড়ে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল আহ্বান করে ইসলামপন্থি গ্রুপ হেফাজতে ইসলাম। বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস এবং রাবার বুলেট ছুড়েছে। পক্ষান্তরে বিক্ষোভকারীরা নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের বিরুদ্ধে ইটপাটকেল ছুড়েছে। এর মধ্যে ঢাকা এবং পূর্বাঞ্চলীয় ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় দেখা গেছে সবচেয়ে ভয়াবহ সহিংসতা। বাস, একটি ট্রেন, একটি মন্দির এবং বেশ কিছু সম্পত্তির ক্ষতি করা হয়েছে। বন্দুকের গুলিতে আহত বেশ কিছু মানুষকে ভর্তি করা হয়েছে হাসপাতালে। হেফাজতে ইসলামের ভাইস চেয়ারম্যান ড. আহমেদ আবদুল কাদের বলেছেন, মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা র্যালি বের করলে তাদের ওপর হামলা করেছে নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনী এবং আওয়ামী লীগের সমর্থকরা। এ থেকেই লড়াই সৃষ্টি হয়েছে। তাই বলে নিরস্ত্র মানুষের ওপর সরাসরি গুলি করার কোনো প্রয়োজন ছিল না।
সরকারি হিসাবে বলা হয়েছে নিহত হয়েছেন কমপক্ষে ১২ জন বিক্ষোভকারী। তবে হেফাজতের দাবি নিহতের সংখ্যা অনেক বেশি। এ বিষয়ে বাংলাদেশের আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল হক বলেছেন, বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক দেশ। প্রতিজন মানুষের কথা বলার অধিকার আছে। তাই বলে তারা আইনশৃংখলা নিজের হাতে তুলে নিতে পারেন না। তারা (বিক্ষোভকারী) সীমা লঙ্ঘন করেছে। দেশের নাগরিকদের এবং আইনশৃংখলা রক্ষা করতে পরিস্থিতিতে হস্তক্ষেপ করেছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা।
কেন তারা প্রতিবাদ করছিলেন?
এই প্রতিবাদের নেতৃত্বে আছে ইসলামপন্থি, মাদ্রাসার শিক্ষার্থী এবং বামধারার কিছু গ্রুপ। তারা বাংলাদেশে মোদির সফরের বিরোধিতা করেছে। মোদির বিরুদ্ধে তারা মুসলিমবিরোধী অবস্থান নেয়ার অভিযোগ এনেছেন। যারা এসব বিক্ষোভ, প্রতিবাদের আয়োজন করেছিলেন তারা, এমনকি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সমর্থকরাও বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে নৃশংসতার অভিযোগ এনেছেন নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি। এই ঘটনা বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলাকারীদের বিচার দাবিতে সমাজের প্রথম সারির কিছু নাগরিক ও অধিকারকর্মীদের একটি খোলা বিবৃতি দিতে উদ্বুদ্ধ করেছে। উভয় দেশের মধ্যে সুসম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও সব সময় বাংলাদেশিদের একটি অংশের মধ্যে সব সময়ই ভারতবিরোধী সেন্টিমেন্ট প্রবহমান।
নারী অধিকারকর্মী শিরীন হক বলেন, ভারতে ২০১৪ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশে ভারতবিরোধী সেন্টিমেন্ট পরিণত হয়েছে অধিকহারে মোদি বিরোধী সেন্টিমেন্টে। বিক্ষোভকারীরা কিন্তু ভারত বা ভারতের জনগণের বিরোধী ছিলেন না। তাদের ক্ষোভ ছিল মোদিকে আমন্ত্রণ জানানো নিয়ে। কারণ মোদি চরমমাত্রায় বিতর্কিত। তিনি মুসলিম বিরোধী অবস্থান নেয়ার জন্য সুপরিচিত। এক্ষেত্রে ভারতের প্রেসিডেন্টকে আমন্ত্রণ জানাতে পারতো বাংলাদেশ। সেটা করলে সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেতো। কিন্তু সরকার মোদিকে আমন্ত্রণ জানানোই যথার্থ হবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
ব্যারিস্টার আনিসুল হক বলেছেন, যেদেশ আমাদের ৯ মাসের স্বাধীনতা যুদ্ধের সরাসরি সহায়তা করেছে, সেই দেশের কোনো একজনকে আমন্ত্রণ জানাতে চেয়েছে সরকার এবং বাংলাদেশের জনগণ।
সহিংসতা কি দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে প্রভাব ফেলবে?
বাংলাদেশ এবং ভারত ঐতিহাসিকভাবে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছে। বাংলাদেশ হলো সাবেক পূর্ব পাকিস্তান। ১৯৪৭ সালে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারত এবং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পাকিস্তান হিসেবে এই উপমহাদেশ ভাগ করে দেয় বৃটেন। এভাবেই পাকিস্তানের অংশ হয়ে যায় পূর্ব পাকিস্তান। কিন্তু ১৯৭১ সালে যুদ্ধে মাধ্যমে পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জন করে বাংলাদেশ। যুুদ্ধে সামরিক হস্তক্ষেপ করে ভারত। এর ফলে স্বাধীন একটি রাষ্ট্র হিসেবে আলাদা হয় বাংলাদেশ। কিন্তু ভারতের ক্ষমতায় বিজেপির উত্থান সেই অবস্থাকে জটিল করে তুলেছে। সীমান্তবর্তী পশ্চিমবঙ্গ এবং আসামের বিধানসভা নির্বাচনের সাম্প্রতিক প্রচারণায় মোদি এবং বিজেপির সিনিয়র নেতারা ঘন ঘন বাংলাদেশ থেকে যাওয়া অবৈধ অভিবাসীর ইস্যু উত্থাপন করেছেন। তবে বাংলাদেশ সরকার এমন অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন। ২০১৯ সালের এক নির্বাচনি র্যালিতে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ অবৈধ অভিবাসীদের ‘উইপোকা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। একই সঙ্গে তিনি এও বলেন যে, বিজেপি সরকার একজন একজন করে অনুপ্রবেশকারীকে বেছে বের করবে এবং তাদেরকে বঙ্গোপসাগরে ছুড়ে ফেলবে। অমিত শাহের এমন মন্তব্যে অধিকার বিষয়ক গ্রুপগুলো থেকে তীব্র সমালোচনা করা হয় এবং বাংলাদেশেও মারাত্মক ক্ষোভ দেখা দেয়। কিন্তু বার বার বাংলাদেশ থেকে মুসলিম অবৈধ অভিবাসীর ইস্যু উত্থাপন করে, বিশেষ করে নির্বাচনি প্রচারণাকে মেরুকরণ করার সময়ে এসব ইস্যু উত্থাপন করায়, ঢাকায়ও অসন্তোষ দেখা দেয়। বিরোধীরা শেখ হাসিনার সরকারকে দেখে থাকে ভারতপন্থি হিসেবে। ঢাকায় সেই সরকার এখন আভ্যন্তরীণ চাপের মুখে।
২০১৯ সালে মোদি সরকার বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইন পাস করে। এই আইনে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে পালিয়ে গিয়েছেন ধর্মীয় সংখ্যালঘু যেসব মানুষ তাদের আশ্রয় দেয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এতে মুসলিমদেরকে বাদ রাখা হয়েছে। নাগরিকত্ব সংশোধন আইনকে দেখা হয় মুসলিমবিরোধী হিসেবে। এ আইন নিয়ে সমালোচনা করেছে ভারতের বিরোধী রাজনৈতিক দল ও গ্রুপগুলো। বিতর্কিত এই আইন ঢাকাকেও বিস্মিত করেছে। প্রধানমনত্রী শেখ হাসিনা আত্মরক্ষামূলক অবস্থানে গিয়ে বাংলাদেশ থেকে ধর্মীয় নির্যাতনের কারণে সংখ্যালঘুদের পালিয়ে যাওয়ার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের কমপক্ষে ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে শতকরা প্রায় ৮ ভাগ হিন্দু সম্প্রদায়ের। এক পর্যায়ে নাগরিকত্ব আইন এবং প্রস্তাবিত এনআরসি নিয়ে দেশের ভিতরে সমালোচনার মুখে উচ্চ পর্যায়ের কয়েকজন মন্ত্রীর ভারত সফর বাতিল করে বাংলাদেশ। আসামে চূড়ান্ত এনআরসি থেকে প্রায় ২০ লাখ মানুষকে তালিকার বাইরে রাখা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছেন হিন্দু ও মুসলিম। তারা প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট দেখাতে পারেননি। তারা প্রমাণ করতে পারেননি যে, তারা বাংলাদেশের অবৈধ অভিবাসী নন। কট্টর হিন্দুত্ববাদীরা এসব মুসলিমকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর কথা বলা হয়েছে।
দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে আরো একটি কাঁটা হলো সীমান্তে ভারতীয় নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের হাতে বাংলাদেশি বেসামরিক লোকজনকে হত্যা। অধিকার বিষয়ক গ্রুপগুলো বলে, ২০১১ সাল থেকে সীমান্তে কমপক্ষে ৩০০ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। এসব গুলির ঘটনা বাংলাদেশে বড় আকারে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। তবে ভারতের কর্মকর্তাদের দাবি, যারা মারা গেছেন তাদের বেশির ভাগই অপরাধ চক্রের পাচারকারী। কিন্তু বাংলাদেশের দাবি, এসব মানুষের বেশির ভাগই বেসামরিক সাধারণ মানুষ। অধিকারকর্মীরা পয়েন্টআউট করেছেন যে, দিল্লি থেকে বার বার নিশ্চয়তা দেয়া সত্ত্বেও এই সীমান্ত হত্যাকান্ড বন্ধ হয়নি।
শিরীন হক বলেন, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক একমুখী। বিনিময়ে যথেষ্ট না পেয়েই ভারতকে অনেক বেশি ছাড় দিয়েছে বাংলাদেশ। এখনও আমাদের নদীর পানিবন্টনসহ অনেক ইস্যু সমাধানের বাকি আছে। উভয় দেশের মধ্যে একটি বাদে ৫৪টি অভিন্ন নদী আছে। বঙ্গোপসাগরে পতিত হওয়ার আগে এসব নদী উজানে ভারতের ভিতর দিয়ে এসে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। তারপর তার গতির শেষ হয়েছে বঙ্গোপসাগরে। তাই এসব নদীর পানি প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা আছে ভারতের হাতে। গঙ্গা বাদে অন্য কোনো নদীর পানি বন্টনের জন্য দুই দেশ কোনো চুক্তি করতে সক্ষম হয়নি। এতে বাংলাদেশে যথেষ্ট অসন্তুষ্টি রয়েছে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নিরাপত্তার জন্য বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপগুলো তাদের ভূখন্ডে কর্মকান্ড পরিচালনা করে। ঢাকার সহায়তায় তাদের অনেককে দমন করা গেছে। বাংলাদেশের সঙ্গে মাঝে মাঝেই চমৎকার পর্যায়ে সম্পর্ক নিয়ে যায় ভারত। এটাকে দেখা হয় দিল্লির জন্য কূটনীতির একটি ‘সিলভার লাইনিং’ হিসেবে, যখন পাকিস্তান ও চীনের মতো অন্য প্রতিবেশীদের সঙ্গে দিল্লির সম্পর্কে সমস্যা আছে।
তাই মোদির সফরকে ঘিরে যে ক্ষোভ দেখা গেছে, তা স্পষ্টভাবে দিল্লির জন্য ‘ওয়ার্নিং’। যদি প্রতিবেশীর সংবেদনশীলতার তোয়াক্কা না করা হয়, তাহলে ঢাকায় শুধুমাত্র সরকারের বন্ধু হয়ে থাকবে ভারত। জনগণের বন্ধু হতে পারবে না।