দুই লাখে শব্দ ও ধোয়াবিহীন দুই সিটের গাড়ি
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৯:২৯ পিএম, ৩১ মার্চ,
বুধবার,২০২১ | আপডেট: ১২:৪৬ পিএম, ২০ নভেম্বর,
বুধবার,২০২৪
রংপুরে শব্দ ও ধোয়াবিহীন দুই সিটের একটি কার তৈরি করে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন একটি কেমিক্যাল কারখানার মেকানিক সেলিম মিয়া। মাত্র দুই লাখ টাকা খরচ করে এই ছোট্ট গাড়িটি তৈরি করছেন তিনি।
পরিবেশ বান্ধব ব্যাটারি চালিত দুই সিটের গাড়ি তৈরি করার কারিগর রংপুর সদর উপজেলার সদ্যপুস্করনী ইউনিয়নের পালিচড়া কেশবপুর উত্তরপাড়া গ্রামের সেলিম মিয়া। গাড়িটি পরীক্ষামূলকভাবে চালিয়েছেন তিনি।
গাড়িটির উদ্ভাবক সেলিম মিয়া বলেন, তিনি ঢাকার নারায়ণগঞ্জের সামুদা ক্যামিকেল নামের একটি কোম্পানিতে মেকানিক হিসেবে চাকরি করার পাশাপাশি নানান ধরনের জিনিস তৈরি করতাম। মাথায় চিন্তা আসে অল্প টাকায় গাড়ি তৈরি করা যায় কি না। সেই চিন্তা থেকে দীর্ঘ এক বছর ধরে চেষ্টার পর ব্যাটারি চালিত পরিবেশ বান্ধব দুই সিটের গাড়ি তৈরি করি। গাড়িটির চাকার সঙ্গে একটি প্লেনাম লাগিয়ে চালালে অটো চার্জ হবে অথবা বিদ্যুৎ দিয়ে চার্জ দেয়া যাবে।
তিনি আরও জানান, শব্দ নেই, ধোঁয়া বিহীন পরিবেশ বান্ধব তার উদ্ভাবিত চার চাকার ইলেকট্রিক গাড়িটি ১০০০ ওয়াটের হাইস্পিড মোটর ও ৬০ ভোল্টের ব্যাটারিতে চলবে। এখন একবার চার্জ দিলেই ১০০ থেকে ১২০ কিলোমিটার পথ যেতে পারবে। চার্জার মেশিন দিয়ে ব্যাটারি ফুল চার্জ হতে সাড়ে আট ঘণ্টা সময় লাগে। তবে ভবিষ্যতে এ গাড়িটিতে নতুন ডায়নামা সংযোজন করা হবে। এতে গাড়ির চাকা যত ঘুরবে, ব্যাটারি ততই চার্জ হবে। তখন প্রতিদিন চার্জার মেশিনে ব্যাটারি চার্জ করার প্রয়োজন হবে না। এই গাড়িটি তৈরি করতে তার খরচ হয়েছে প্রায় দুই লাখ টাকা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেলিম মিয়া কৃষক কফিল উদ্দিনের পাঁচ সন্তানের মধ্যে বড় ছেলে। অভাবেরর তাড়নায় পড়ালেখায় মাধ্যমিকের গন্ডি পার করেননি। নুন আনতে পান্তা ফোরানোর সংসার। তাই শৈশবে বইখাতা তাকে উঠিয়ে হয়ে ওঠেন কৃষক বাবার সহযোগী।
কিন্তু স্বপ্ন দেখতেন একদিন একটি গাড়ি বানাবেন, নিজের বানানো গাড়িতে চড়ে বেড়ানোর। সেই স্বপ্ন পূরণে গাড়ি বানানোর কাজ শুরু করেন। তখন প্রতিবেশীরা নানা ধরণের উপহাস করতে থাকেন। শত কষ্ট-বেদনার মাঝেও ইচ্ছাপূরণে সেলিমের মনোবল ছিল অবিচল।
সেই অদম্য ইচ্ছাশক্তির জোরে নিজের বানানো গাড়িতে চড়ে বেড়ালেন গ্রামে, যা দেখে অবাক এখন গ্রামের লোকজন। প্রতিদিনই এখন দুর দুরান্ত থেকে মানুষজন ভিড় করছেন সেলিমের বাড়িতে। সবাই দেখছেন উদ্ভাবিত গাড়িটি।
কথা হয় সেলিমের মা সিদ্দিকী বেগমের সাথে। তিনি জানান আমার ছেলে গাড়ি বানানোর জন্য ব্যাকুল ছিল। ছুটি পেলে বাড়িতে এসে ঠিকমতো খাওয়া দাওয়াও করত না। দুই ভাই মিলে পড়ে থাকত গাড়ি নিয়ে। খুব কষ্ট করেছে গাড়িটা নিয়ে। এখন গাড়িটা দেখে মনটা আমার আনন্দে ভরে যাচ্ছে। প্রথমে আমাকে গাড়িতে তুলে নিয়ে সেলিম নিজে গাড়ি চালিয়েছে। গ্রামের সবাই তখন দেখে প্রশংসা করেছে। এটাই তো আমার বড় পাওয়া।
সেলিমের বাবা কফিল উদ্দিন বলেন, আমার ছেলেরা যখন গাড়ি বানানোর কাজ শুরু করে। তখন আমি তাদের উৎসাহ দিয়েছি। আমার তো টাকাপয়সা নেই। ছেলেরা যা রোজগার করে, তার মধ্য থেকে একটু একটু করে গাড়িতে ব্যয় করেছে। বড় ছেলের (সেলিম) সঙ্গে ছোট ছেলে (নিয়ামুল) মিলে কাজ করে গাড়িটা তৈরি করেছে। এখন সবাই বাড়িতে এসে গাড়িটা দেখে যাচ্ছে। আমার খুব ভালো লাগছে। ছেলেরা আমাকে গাড়িতে তুলে গ্রামে ঘুরিয়েছে। এটাই আমার মনের শান্তি। আমি জানতাম আমার ছেলে একদিন গাড়ি বানাতে পারবে। এখন ছেলের স্বপ্ন পূরণ হয়েছে, আমি অনেক খুশি।
সদ্যপুস্করিনী ইউপির মহিলা সদস্য আফরোজা বেগম বলেন, সেলিমের বাড়ি আমার বাড়ির পাশে। তিনি ঢাকার নারায়ণগঞ্জে থাকেন। কয়েকদিন আগে জেনেছি তিনি একটি গাড়ি তৈরি করেছেন। এত কম খরচে দুই সিটের যে গাড়িটি তৈরি করেছেন তা অবাক করার মতো। গাড়িটি দেখেছি। এটি আমাদের গর্ব করার মতো কাজ। তাকে সব ধরনের সহায়তা করা হবে।
তিনি আরও বলেন, পরিবেশবান্ধব ব্যাটারি চালিত দুই সিটের গাড়িটি দেশে ব্যাপক সাড়া ফেলুক এবং সরকারি-বেসরকারি যে কোনো প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানি সেলিমের উদ্ভাবনী গাড়িটি দেখে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনে এগিয়ে আসুক এটি আমার চাওয়া।
রংপুর সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নাছিমা জামান ববি বলেন, সমাজের উচিত এ ধরনের উদ্ভাবনকে উৎসাহ দেওয়া। গাড়ি তৈরির বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং সরকারের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে পরামর্শ করে গাড়িটির নকশা উন্নত করা যেতে পারে। গাড়িটি রাস্তায় নামানো হলে তা যেন নিরাপদ, স্বস্তি ও দক্ষতার সঙ্গে চলতে পারে, তার জন্যও বিভিন্ন সংস্থার পরামর্শ দরকার। আমার বিশ্বাস সেলিমের উদ্ভাবন বৃথা যাবে না।