হারিয়ে যাচ্ছে পুরান ঢাকার সামাজিক ক্লাবগুলো
প্রকাশ: ০৯:২৫ পিএম, ২৫ সেপ্টেম্বর,
বুধবার,২০২৪ | আপডেট: ০৮:৫২ পিএম, ৩ অক্টোবর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
★ অধিকাংশই কার্যক্রমহীন ★ কর্মী সংকট ★ আসেনা কোনো অনুদান বা ভর্তুকি ★ সাধারণ মানুষের ক্লাবের প্রতি অনিহা
বাংলাবাজার রূপচাঁন দাস লেনে অবস্থিত মাহফুজ স্মৃতি সংসদ ও পাঠাগার। পৌড় একটি বাড়ির দোতলায় ঝুলছে পরিচিতি বোর্ড। সেখানেই বড় করে লেখা ক্লাবের নাম। দেখে মনে হয় এটি যেকোনো সময়ই ভেঙে পড়তে পারে। তবুও নিচ তলায় মানুষের বসবাস। দোতলায়ও বড় দুই রুম ভাড়া দেওয়া। সিড়ি দিয়ে দোতলায় উঠেই ডান হাতে একটি তালাবদ্ধ দরজা। এটিই ক্লাব! একসাথে মানুষের বেশ আনাগোনা ছিলো এই ক্লাবে। সামাজিক বিষয়াবলিকে প্রাধান্য করেই কার্যক্রম চলতো। দুস্থ মানুষদের সহায়তাসহ জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিতো আশপাশ মহল্লায়। এক সময়ের সেই তারুণ্য উদ্দীপ্ত ক্লাব আজ ভুগছে জরাজীর্ণতায়। নেই কর্মী,পরিচর্যা, কার্যক্রম। সমাজকে পরিচর্যা করার জন্য গড়ে উঠা প্রতিষ্ঠানটিই আজ ভুগছে পরিচর্যাহীনতায়।
স্থানীয় বাসিন্দা রুহুজ্জেল শেখ দৈনিক দিনকালকে বলেন, এটা এখন আর ক্লাব নেই। অনেক আগে কার্যক্রম ছিলো শুনেছি। কিন্তু এখন কেউ আসে না। দেখাশোনা করে না। আসলে এটার কোন নিবন্ধনই নেই এখন।
বুড়িগঙ্গার তীরে গড়ে ওঠা শহর পুরান ঢাকার রয়েছে গৌরবোজ্জল ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি। এখানে মহল্লায় মহল্লায় গড়ে ওঠে বিভিন্ন ক্লাব- সংঘ সামাজিক কল্যান ভ্রাতৃত্ববোধ গড়ে তুলতে ছিলো অতুলনীয়। স্থানীয়রা বলছেন মানুষের মধ্যে মেলবন্ধন, সামাজিকতা, মানবিকতা এখন কমে এসেছে। এছাড়া কোনো অনুদান বা ভর্তুকি ক্লাবে আসেনা। ক্লাবে খেলাধুলার সারঞ্জাম থাকলেও তা সীমিত পর্যায়ে। মাত্র দু একটি ক্লাবের মাঠ থাকলেও বাকিগুলো ভাড়ে ভবানি। অনেক জায়গায় যথাযথ পরিচর্যা না থাকায় বন্ধের পথে। কোনটি আবার শুধু নামেই ক্লাব। ভাড়া দিয়ে থাকছেন শ্রমিকরা।
সরেজমিনে, পুরান ঢাকার মাহফুজ স্মৃতি সংসদ ও পাঠাগার, মুক্তি খেলাঘর আসর, কাগজীটোলা সোশ্যাল ক্লাব, মুরগিটোলা যুব সংঘ, দক্ষিণ মৈশুন্ডি যুব ক্লাব, ফরাশগঞ্জ স্পোর্টিং ক্লাবসহ আরো কয়েকটি পর্যবেক্ষণ করা হয়। জানা যায়, পূর্বে এ ক্লাবগুলোর অন্যরকম কার্যক্রম বা জৌলুস থাকলেও কালের বিবর্তনে তা এখন অতীত। ক্লাবগুলো থাকলেও এর কার্যক্রমগুলো এখন মলিন। যেনো প্রাণহীন। যে ভবনগুলোতে ক্লাবগুলোর অবস্থান তার অবস্থাও জরাজীর্ণ। কিছু কিছু ভবন আছে যা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এদিকে শুরুতে সামাজিক সেবা মুলক ক্লাব প্রতিষ্ঠার রূপরেখা বা উদ্দেশ্য এক রকম হলেও পরে তা পরিবর্তন হয়েছে। মুল উদ্দেশ্যে থেকে সরে গেছে অনেকাংশেই। সামাজিক সম্প্রীতির পরিবর্তে ঘটছে বিপরীত।
মোহনীদাস লেনে মুক্তি খেলাঘর আসরে গিয়ে দেখা যায়, অফিস কক্ষ বন্ধ। তবে এ প্রতিষ্ঠানের প্রচার সম্পাদক মোঃ আলমগীরের কাছ থেকে জানা যায়, এটি কেন্দ্রীয় খেলাঘরের একটি শাখা। কেন্দ্রীয় খেলাঘর প্রতিষ্ঠার পরপরই এটির প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৭৩ সালে। তবে মাঝে রাজনৈতিক কারণে দীর্ঘ আঠার বছর এর কোনো কার্যক্রম ছিলনা। এখন আবার চালু হয়েছে। বিভিন্ন জাতীয় দিবসগুলোতে এটি থেকে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ভেতরে ছোট একটি মাঠ আছে যেখানে এলাকার স্থানীয় যুবক ও শিশুরা খেলাধুলা করে। তবে পুরনো জৌলুস নেই।
মুক্তি খেলাঘর আসরের একটু পাশেই নাসির বিন কুতুব বিন রহমান মক্তব ও কুতুবখানা। তবে শুরুতে এটি ক্লাব ছিলো। ক্লাবের কার্যক্রম হারালে পরবর্তীতে মক্তব হিসাবে ঘোষণা করা হয়। মক্তবের দায়িত্বরত হাফেজ বলেন, পূর্বে এটি ক্লাব ছিল এখন মক্তব হয়েছে। ৫-৭ বছর পূর্বেই এটিকে মক্তবে রূপান্তর করা হয়েছে।
কাগজীটোলা সোশ্যাল ক্লাব পরিদর্শন করে দেখা যায়, ভবনের নিচতলায় বড় করে ক্লাবের নাম লেখা। এখানে ক্যারাম বোর্ড, দাবা, লুডু খেলার ব্যবস্থা রয়েছে। একটি পাঠাগারও আছে। সন্ধ্যার পরেই বেশি খোলা থাকে। স্থানীয়রা আড্ডা দেয়। খেলাধুলা করে। তবে এই ক্লাবের সৃষ্টি খেলাধুলা কেন্দ্রীক নয়। সামাজিক সহযোগিতা ও পরষ্পরকে কল্যানের উদ্দেশ্যে গড়ে উঠে বলে জানান স্থানীয় বাসিন্দা জলিল আমিন জামাল। তিনি বলেন, শুরু ক্লাবটি সামাজিক, সহযোগিতা মূলক কার্যক্রম সম্পন্ন করলেও এখন তা নেই। খেলাধুলা, আর রাজনৈতিক কর্ম চলে।
পুরান ঢাকার অন্যতম এক ক্লাব হল ফরাশগঞ্জ স্পোর্টিং ক্লাব। পূর্বে এর অন্যরকম জৌলুস থাকলেও এখন এর কার্যক্রমে ভাটা পড়েছে। খেলাধুলা নিয়ে তেমন জাঁকজমক নেই।
স্থানীয় বাসিন্দা হাজী এনায়েতুল্লাহ হাশীম দৈনিক দিনকালকে বলেন, পাড়া মহল্লার ইউনিটি রাখতে ক্লাবের প্রয়োজন হতো। সকলের সাথে পরামর্শ করে কোন কাজ করা হতো। সামাজিক উন্নয়ন মূলক কাজও সহজেই করা যেতো জোট বেধে। কিন্তু এখন আর এসব নেই। কেউ কাউকে চেনে না। মেলবন্ধন নেই। ক্লাব এখন মোবাইলে চলে গেছে।
আদি ঢাকা সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি মানস বোস বাবুরাম দৈনিক দিনকালকে বলেন, ঢাকায় স্থানীয় মানুষ গুলো আগে বেশি ছিলো। কিন্তু এখন বহিরাগত বেশি। সেই সাথে মানুষ এখন ফেসবুক ও কম্পিউটার নির্ভর। ফলে ক্লাব গুলোর পরিচর্যা নেই। মানুষ এখন আত্নকেন্দ্রীক হয়ে গেছে। ফলে ক্লাবের কার্যক্রমের পরিবর্তন ঘটছে এবং আগের ঐতিহ্য হারিয়ে যাচ্ছে।
দিনকাল/এসএস