রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত ৭০, বিচারবহির্ভূত হত্যা ১৯, ধর্ষণ ১৪৯৬
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৮:৩৫ পিএম, ৩১ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২২ | আপডেট: ১১:৪৮ এএম, ২১ নভেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
স্থানীয় নির্বাচনসহ রাজনৈতিক কারণে দেশের ৬৪ জেলায় চলতি বছরে ৪৭৯টি সংঘাত ও সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এতে নিহত হয়েছেন ৭০ জন এবং আহত হয়েছেন প্রায় ৬ হাজার ৯১৪। দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটেছে ঢাকা জেলায়। ঢাকাতে ২৯টি ঘটনায় প্রায় ৪৫৯ জন আহত হয়েছেন এবং নিহত হয়েছেন ৩ জন। এছাড়া কুমিল্লা জেলায় ২৮টি ঘটনায় প্রায় ২৬৯ জন আহত হয়েছেন এবং নিহত হয়েছেন ২ জন। চট্টগ্রাম জেলায় ২৫টি ঘটনায় আহত হয়েছেন প্রায় ৩৩২ জন এবং নিহত হয়েছেন ৭ জন। এছাড়াও রাজনৈতিক সহিংসতায় বগুড়া জেলায় ১০টি ঘটনায় ৭ জন নিহত হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন প্রায় ৭৬ জন। মত প্রকাশের স্বাধীনতা বিষয়ে আসকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় ৮টি বিভাগের মধ্যে শুধুমাত্র রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও ঢাকা বিভাগেই মামলা হয়েছে ২ হাজার ২৪৯টি।
বিচারবহির্ভূত হত্যা ও নির্যাতন : বিচারবহির্ভূত হত্যা ও নির্যাতন বিষয়ে বলা হয়েছে, আসকের তথ্য সংরক্ষণ ইউনিটের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০২২ সালে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন ১৯ জন। আসক তথ্য সংরক্ষণ ইউনিটের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২২ সালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে শুধুমাত্র র্যাবের সঙ্গে ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধ ও গুলিবিনিময়ের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৪ জন। সংঘটিত ঘটনাগুলো কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, কক্সবাজার ও নারায়ণগঞ্জ জেলায় ঘটেছে।
হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু : ২০২২ সালে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে মারা গেছেন ১৫ জন। তাদের মধ্যে গ্রেফতারের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শারীরিক নির্যাতনে ৪ জন, হার্ট অ্যাটাকে ১ জন এবং গ্রেফতারের আগে শারীরিক নির্যাতনে ৪ জন মারা গেছেন। এছাড়া থানা হেফাজত আত্মহত্যা করেছেন ২ জন এবং অসুস্থ হয়ে মারা যান ৪ জন।
কারা হেফাজতে মৃত্যু : এ বছর দেশের কারাগারগুলোর মধ্যে ২১টি কারাগারে অসুস্থতাসহ বিভিন্ন কারণে মারা গেছেন ৬৫ জন। এর মধ্যে কয়েদি ২৮ এবং হাজতি ৩৭ জন। গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে সর্বাধিক ১৬ জন, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ১৪ জন এবং চট্টগ্রাম কারাগারে ১২ জন মারা গেছেন। ২০২২ সালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ, গুম ও নিখোঁজের শিকার হন ৫ জন। তাদের মধ্যে ৪ জনকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। পরবর্তীতে ফিরে এসেছেন ১ জন।
সীমান্ত হত্যা ও নির্যাতন : আসক তথ্য সংরক্ষণ ইউনিটের হিসাব মতে, ২০২২ সালে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের গুলিতে ১৬ জনসহ মোট ২৩ জন বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে সর্বাধিক লালমনিরহাট জেলার সীমান্তবর্তী এলাকায় ৭ জন, কুড়িগ্রাম জেলায় ৩ জন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় ৩ জনসহ দেশের অন্যান্য সীমান্তবর্তী জেলায় আরও ১০ জন নাগরিক নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন সীমান্ত এলাকায় ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ কর্তৃক ১৫ জন নাগরিক মারাত্মক শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
গণপিটুনি : গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে আসকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০২২ সালে গণপিটুনির ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৩৬ জন।
সাংবাদিক নির্যাতন ও হয়রানি : বছরজুড়ে ২২৬ জন সাংবাদিক বিভিন্নভাবে নির্যাতন, হয়রানি, হুমকি ও পেশাগত কাজ করতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হয়েছেন। যাদের মধ্যে পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে হামলার শিকার হয়েছেন অন্তত ৭৯ জন সংবাদকর্মী। দুর্বৃত্তদের গুলিতে কুমিল্লায় নিহত হয়েছেন ১ জন সাংবাদিক। এছাড়াও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্তৃক লাঞ্ছিত ও পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় বাধা প্রদানের শিকার হয়েছেন ১৪ জন।
ধর্মীয় সংখ্যালঘু : আসকের তথ্য সংরক্ষণ ইউনিটের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২২ সালে দেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দু সম্প্রদায়ের পূজামন্ডপ এবং বাড়ি-ঘর, ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান ও মন্দির ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগের ১২টি ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় হিন্দু সম্প্রদায়ের কমপক্ষে ৫ জন আহত হয়েছেন।
ধর্ষণ : ২০২২ সালে সারাদেশে ধর্ষণ ও সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৯৩৬টি। ধর্ষণে পর হত্যা করা হয়েছে ৪৭ জনকে এবং ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন ৭ জন। ধর্ষণের ঘটনা সর্বাধিক ৮৮টি ঘটেছে ঢাকা জেলায়। এছাড়া নারায়ণগঞ্জে ৮৩টি, চট্টগ্রামে ৫২টি, গাজীপুরে ৪৯টিসহ বাকি সব জেলাতেই ধর্ষণের মত ঘটনা ঘটেছে। গতবছর ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল ১ হাজার ৩২১টি।
নির্যাতন, উত্ত্যক্তকরণ ও যৌন হয়রানি : ২০২২ সালে যৌন হয়রানি ও উত্ত্যক্তকরণের শিকার হয়েছেন কমপক্ষে ২৪৭ জন নারী। এসব ঘটনার প্রতিবাদ করতে গিয়ে নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হন ৭৮ জন পুরুষ। এ বছর উত্ত্যক্তকরণের কারণে আত্মহত্যা করেছেন ৭ জন নারী। এ ছাড়া যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করতে গিয়ে ৮ জন পুরুষ খুন হয়েছেন।
পারিবারিক নির্যাতন ও যৌতুক : এ বছর পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৪৭৯ জন নারী। নির্যাতনের কারণে মারা গেছেন ২৯২ জন এবং আত্মহত্যা করেন ৯৭ জন। ২০২১ সালে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন ৬৪০ জন নারী। অন্যদিকে ২০২২ সালে যৌতুকের জন্য নির্যাতনের শিকার হয়েছেন মোট ১৭৪ নারী। তাদের শারীরিক নির্যাতনের পর হত্যার শিকার হন ৭৯ জন নারী এবং আত্মহত্যা করেন ৭ নারী।
সালিশের মাধ্যমে নির্যাতন : আসকের তথ্য সংরক্ষণ ইউনিটের হিসাব মতে, ২০২২ সালে সালিশ ও ফতোয়ার মাধ্যমে ৬ নারী নির্যাতনের শিকার হন। তাদের মধ্যে সালিশে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন ৫ নারী, নির্যাতন পরবর্তী সময়ে আত্মহত্যা করেন ১ নারী। ২০২১ সালে সালিশ ও ফতোয়ার শিকার হয়েছিলেন মোট ১২ জন নারী।
গৃহকর্মী নির্যাতন ও অ্যাসিড নিক্ষেপ : ২০২২ সালে ২৬ জন নারী গৃহকর্মী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তাদের মধ্যে শারীরিক নির্যাতনের পরবর্তী সময়ে মারা যান ১২ জন নারী। অন্যদিকে এ বছর অ্যাসিড নিক্ষেপের শিকার হয়েছেন ১৩ জন নারী।
শিশু অধিকার : ২০২২ সালে শারীরিক নির্যাতনের কারণে মৃত্যু, ধর্ষণের পরে হত্যা, ধর্ষণ চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে হত্যা, অপহরণ ও নিখোঁজের পর হত্যাসহ বিভিন্ন কারণে নিহত হয়েছে ৫১৬ জন শিশু। নিহতদের মধ্যে ঢাকা জেলায় সর্বাধিক ৬৪, গাজীপুরে ৩৬ এবং নারায়ণগঞ্জে ৩৩ শিশু নিহত হয়েছে। ২০২১ সালে নিহত শিশুর সংখ্যা ছিল ৫৯৬ জন।
এছাড়া ২০২২ সালে বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয় ১ হাজার ৮৮ জন শিশু। তাদের মধ্যে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৫৬০টি ধর্ষণ চেষ্টা ও যৌন হয়রানি করা হয় ১০০ জনকে। বলাৎকার করা হয়েছে ৫২ ছেলে শিশুকে। এ বছরে বলাৎকার করা ৫২ ছেলে শিশুর মধ্যে কমপক্ষে ৩৪ জন ছেলে শিশুকে বিভিন্ন মাদ্রাসায় বলাৎকার করা হয়েছে।