রিজার্ভের সাতকাহন
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১০:৩৬ পিএম, ৫ নভেম্বর,শনিবার,২০২২ | আপডেট: ১২:৪১ পিএম, ২০ নভেম্বর,
বুধবার,২০২৪
বর্তমানে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ কমে দাঁড়িয়েছে ৩৬ বিলিয়ন ডলারেরও নিচে। গত ২০ অক্টোবর বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদকৃত নতুন তথ্যমতে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার বর্তমান রিজার্ভ ৩৫ দশমিক ৯৮ বিলিয়ন ডলারে। যা বিগত ১৬ মাসের মাঝে সর্বনিম্ন।রেকর্ড আমদানি দায় ও বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের কারণে প্রতিদিনই রিজার্ভ থেকে ডলার হারাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের দেয়া তথ্য মতে ১৯ অক্টোবর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ ছিলো ৩৬ দশমিক ১১ বিলিয়ন ডলার। যা এক মাসের ব্যাবধানে প্রায় ১৩ মিলিয়ন ডলার কমে গেছে। গত বছরের একই দিনে অর্থাৎ ২০২১ সালের ১৯ অক্টোবর রিজার্ভের পরিমাণ ছিলো ৪৬ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এই এক বছরে রিজার্ভ থেকে কমে গেছে ১০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি।
আবার ২০২১ এর আগস্ট মাসে রিজার্ভের পরিমাণ ছিলো ৪৮ বিলিয়ন ডলার, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। কিন্তু এর ঠিক এক বছর দুই মাসের মাথায় সেই রেকর্ড রিজার্ভ থেকে ১২ বিলিয়ন ডলার কমে গিয়েছে। অর্থাৎ এই এক বছরে রিজার্ভ ক্ষয় হয়েছে ১২ বিলিয়ন ডলার।
সল্প সময়ে রিজার্ভের এই পতনের জন্য কিছু অর্থনীতিবিদ ও আওয়ামী লীগের রাজনীতিবিদরা ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধ কে দায়ী করতে পছন্দ করেন। তাদের দাবী এই যুদ্ধের ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে তেল ও গ্যাসের দাম বেড়েছে এর কারণে অতিরিক্ত অর্থ ব্যায় করতে হচ্ছে সরকারকে। যার ফলে নাকি দেশের রিজার্ভ কমতে শুরু করেছে।
কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে বাংলাদেশ সর্বশেষ ডলার ক্রয় করেছে ২০২১ সালের আগস্ট মাসে৷ সেসময় ২১ মিলিয়ন ডলার ক্রয় করে সরকার। এরপর আর ডলার ক্রয় করতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর শুধু ডলার বিক্রি করতেই হয়েছে সরকারকে। অর্থাৎ গত বছর থেকেই অর্থাৎ যুদ্ধ শুরুর আগে থেকেই রিজার্ভে ভাঙন শুরু হয়েছে যা মোটেও ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধের কারণে শুরু হয়নি।
আবার এরই মাঝে বিগত তিন মাস ধরে রিজার্ভ থেকে প্রায় দেড় বিলিয়ন ডলার চলে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকের মতে এই সংখ্যা অচিরেই দুই বিলিয়ন ডলারে গিয়ে ঠেকবে। যা আমাদের অর্থনীতির জন্য মোটেই সুখকর নয়।
কেন এই রিজার্ভ ধ্বস? এর নানা রকম উত্তরই দেয়া যায়। এই যেমন প্রধানমন্ত্রী বললেন খাদ্যও প্রয়োজনীয় দ্রব্য আমদানিতে খরচ হয়েছে। কিন্তু অতিগুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন হলো খাবার কেনো আমাদের আমদানি করতে হবে? আমরা নাকি খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ, খাদ্য নাকি আমরাই রপ্তানি করি?
আসলে কঠিন বাস্তবতা হলো আমরা হাতেগোনা কয়েকটি খাদ্য বাদে বিশাল এক অংশ আমদানি করি। কিন্তু তাই বলে এই পরিমাণটা এতোটাও বেশিনা যে মাত্র পাঁচ ছয় মাসের মাঝে হুহু করে রিজার্ভ কমবে। আবার অতি প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মাঝে রয়েছে বিভিন্ন শিল্পের কাঁচামাল যা আমাদের বাইরে থেকে আমদানি করতে হয়। কিন্তু এখানে কথা হলো এগুলোতো আবার রপ্তানি যোগ্য পণ্য হিসেবে বাইরে চলে যাওয়ার কথা। তাহলে কেনো এতো বাণিজ্য ঘাটতি? পর্যাপ্ত ব্যবস্থাপনা থাকলেতো এমন ধ্বস নামার কথা নয়।
আবার সরকারের অপ্রয়োজনীয় উন্নয়ন প্রকল্পের নামে বিদেশি ঋণও এই রিজার্ভ হ্রাসের কারণ হিসেবে দেখানো যেতে পারে৷ ২০২২ সালের আগস্ট মাসে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে একটি রিসার্চ ওয়ার্ক প্রকাশ করে। যেখানে আমাদের জিডিপি নিয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করে বিশ্বব্যাংক। জিডিপি বাড়াতে সবচেয়ে বড়ভূমিকা রাখে অবকাঠামোগত উন্নয়ন। কিন্তু বিগত ১০ বছরে অবকাঠামোগত উন্নয়নের কারণে জিডিপি বৃদ্ধির হার এইচ. এম. এরশাদের সময়ে অবকাঠামোগত উন্নয়নের কারণে জিডিপি বৃদ্ধির হারের চেয়েও কম। অর্থাৎ জিডিপির উন্নয়নে অবকাঠামো উন্নয়ন কোনো উল্লেখযোগ্য ভূমিকাই রাখতে পারছে না।
কিন্তু এইতো সেদিন প্রধানমন্ত্রী ১০০ টি ছোট-বড় সেতু উদ্ভোদন করলেন। প্রতিনিয়ত অসংখ্য সড়ক, ফ্লাইওভার সেতু উদ্ভোদন করে যাচ্ছেন। যার বড় একটি অংশ বিদেশিদের অর্থায়নে নির্মিত হয়েছে। কিন্তু কঠিন বাস্তবতা হলো এগুলো দেশের জিডিপি গ্রোথে কোনো ভূমিকাই রাখতে পারছেনা।
আমরা সংবাদ মাধ্যম গুলোতে এমনও অনেক সেতু দেখেছি যেগুলোর কোনো সংযোগ সড়ক নেই। তবুও কোটি টাকা ব্যায় করে সেতু গুলো বানানো হয়েছে। এমন অসংখ্য সেতু হয়েছে যা কেবল লোক দেখানো উন্নয়নের জন্য বানানো হয়েছে। যা কলেবরে উন্নয়নের কথা বলছে কিন্তু জনগণ কিংবা অর্থনীতির কোনো উন্নয়ন এসকল সেতু কিংবা উন্নয়ন প্রকল্পের দ্বারা হয়নি। কিন্তু এসব প্রকল্পের জন্য বিদেশি ঋণ এসেছে। যা অবশ্যই আমাদের পরিশোধ করতে হবে। এসব ঋণ যখন পরিশোধ করতে হবে তখন এগুলো দেশের রিজার্ভকেই চাপে রাখবে।
আবার উন্নয়ন প্রকল্পের দীর্ঘসূত্রিতা ও ব্যায়বৃদ্ধি রিজার্ভ তথা সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর চাপ বাড়াচ্ছে। এরজন্য একটি ছোট্ট দুটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। পদ্মাসেতুর প্রাথমিক বাজেট ধরা হয়েছিলো প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা যা বেড়ে বর্তমান খরচ দাঁড়িয়েছে ৭০ হাজার কোটি টাকা।এর মাঝে ৩০ হাজার কোটি টাকা বাংলাদেশ সরকার দিয়েছে যা দিয়ে সড়ক সেতুর কাজ শেষ হয়েছে৷ বাকি ৪০ হাজার কোটি টাকার ৮৫ ভাগ টাকা দিচ্ছে চীনের একটি দাতা সংস্থা। যা ডলারের হিসেবে প্রায় ৪ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার, যা দিয়ে রেল সংযোগের কাজ চলছে। কিন্তু এই অতিরিক্ত টাকা যার মাঝে প্রায় চার বিলিয়ন ডলার বিদেশি ঋণ রয়েছে। যা পরিশোধ করতেই হবে। কিন্তু ব্যায় বৃদ্ধি না হলে এই চার বিলিয়ন ডলার ঋণ নেয়ার কোনো প্রয়োজনই পড়তোনা। অন্যদিকে এই প্রকল্প ২০১৮ তে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও ব্যয় বৃদ্ধি ও সময় ক্ষেপনের কারণে ২০২২ সালে এর কাজ শেষ হয়। আবার এই সেতু থেকে যে আয় হচ্ছে তা আশানুরূপ নয়। এর চেয়ে বেশি টাকা আয় হচ্ছে ২৫ বছর আগে নির্মিত যমুনা সেতু থেকে। ব্যয় বৃদ্ধির অত্যন্ত বাজে উদাহরণ এটি।
আরেকটি উদাহরণ হিসেবে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের কথা বলা যেতে পারে। যার ব্যায় ধরা হয়েছে ১২ বিলিয়ন ডলার। যা আমাদের তৈরি করে দিচ্ছে রাশিয়া। এবং সিংহভাগ টাকাও সরবরাহ করে দিয়েছে রাশিয়া। কিন্তু সম-সক্ষমতা সম্পন্ন পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করতে ভারত খরচ করছে তিন বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি টাকা। আরও অবাক করা বিষয় হলো দুটো কেন্দ্রই নির্মাণ করে দিচ্ছে রাশিয়া। অর্থাৎ আমরা অতিরিক্ত নয় বিলিয়ন ডলার বেশি খরচ করছি। আবার এটি ২০১৮ সালে নির্মাণ কাজ শেষ হয়ে উৎপাদনে যাওয়ার কথা থাকলেও এখনো এর কাজ শেষ হয়নি। কিন্তু রাশিয়ার দেয়া ঋণের রিটার্ন শুরু হবে ২০২৩ সাল থেকে। অথচ আমরা উৎপাদনেই যেতে পারিনি। এটিকে প্রকল্পের দীর্ঘসূত্রিতার একটি বাজে উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে।
রিজার্ভের এই ধ্বস নামার কথা জানুয়ারি মাসেই বাংলাদেশ ব্যাংকে বলে রেখেছিলো বিভিন্ন অর্থনীতিবিদেরা। তবে এই কথা সেভাবে গুরুত্বের সঙ্গে নেয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু বাজেটের সময় যখন এই অসঙ্গতি চোখে পড়লো তখন সরকারের পক্ষ থেকে IMF এর কাছ থেকে ঋণ নেয়ার চেষ্টা শুরু করে সরকার। সরকার এসময় বাজেট সহায়তা হিসেবে IMF এর কাছ থেকে সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার ঋণ চায়। এনিয়ে গত ২৬ তারিখ আইএমএফ এর একটি প্রতিনিধি দল ঢাকায় এসেছে এবং বেশকটি বৈঠক করেছে। সেখানে তাঁরা ঋণ প্রদানের শর্ত নিয়ে বিভিন্ন দপ্তরে আলোচনা করে।
বৈঠকে আইএমএফ’র পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, রিজার্ভ থেকে অর্থ নিয়ে আলাদাভাবে বিভিন্ন তহবিল গঠন ও সেখান থেকে ঋণ দেওয়া হচ্ছে। আবার ওইসব অর্থ রিজার্ভে দেখানো হচ্ছে। যা আদতে বাংলাদেশের রিজার্ভে নেই। এতে রিজার্ভের পরিমান বেশি দেখাচ্ছে, যা আন্তর্জাতিক বাজারে এক ধরনের বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে। এভাবে রিজার্ভের হিসাব দেখানো ভুল, রিজার্ভের প্রকৃত চিত্র আড়াল করায় বাংলাদেশেরই ঝুঁকি বাড়বে বলে তারা মন্তব্য করেছে। এই গরমিলে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থার সংকট তৈরি করবে। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আস্থার সংকট তৈরি করবে।যা আমাদের দেশের রপ্তানি আয়কে কমিয়ে দেবে। আর তাই বাংলাদেশের স্বার্থেই এ হিসাব আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী করার শর্ত দিয়েছে আইএমএফ।
তারা বলেছেন ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কাসহ আইএমএফ’র সদস্য সবদেশই আইএমএফ’র প্রচলিত আন্তর্জাতিক মান মেনে রিজার্ভের হিসাব করে এবং তা প্রকাশ করে। কিন্তু বাংলাদেশ রিজার্ভের হিসাবের ক্ষেত্রে আইএমএফ’র মান মানছেনা। নিজেদের মতো করে হিসাব করে বেশি রিজার্ভ দেখাচ্ছে। যা বাংলাদেশের প্রকৃত রিজার্ভের অবস্থা বা প্রকৃত অর্থনৈতিক অবস্থা সঠিক ভাবে প্রকাশ করতে দিচ্ছেনা।
উল্লেখ্য সরকার রফতানি উন্নয়ন তহবিলের সরবরাহ করা সাত বিলিয়ন ও শ্রীলঙ্কাকে দেওয়া ২০ কোটি ডলার রিজার্ভে দেখাচ্ছে। যা আসলে রিজার্ভে নেই। এছাড়া গ্রিনট্রান্সফরমেশন ফান্ড ২০ কোটি, লংটার্মফিন্যান্সিং ফ্যাসিলিটি তহবিলে ৩ কোটি ৮৫লাখ, সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিমানকে ৪ কোটি ৮০ লাখ এবং ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ট্রেড ফাইন্যান্স করপোরেশনের আমানতকে রিজার্ভে দেখাচ্ছে। সব মিলিয়ে বর্তমানে রিজার্ভে যে অর্থ দেখানো হচ্ছে। যা মূলত বাংলাদেশের রিজার্ভেই নেই। তাই বাংলাদেশ ব্যাংককে মোট রিজার্ভের টাকা থেকে ৮ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলার বাদ দিতে বলেছে আইএমএফ। ফলে বাংলাদেশের মোট রিজার্ভ হবে ২৭ বিলিয়ন ডলার।
রিজার্ভের এই ভয়াবহ পতনের পরথেকে কিভাবে এই পতন ঠেকানো যায় তা নিয়ে কথা শুরু হয়েছে বিভিন্ন মহলে। বাংলাদেশ সরকার চাইছে আমদানি কমিয়ে ও রপ্তানি বাড়িয়ে এই পতন ঠেকাতে। কিন্তু এটাকি আদৌ সম্ভব? এছাড়াও আরও যেসব পদক্ষেপ সরকার নিয়েছে তা আদৌও কি এই রিজার্ভ ধ্বস থামাতে পারবে?
রিজার্ভ নিয়ে শঙ্কার পর সরকার বেশকিছু কঠিন সিদ্ধান্ত হাতে নেয় রিজার্ভের পতন আটকাতে। প্রথমে বিলাসী পণ্যের আমদানি নিষিদ্ধ করে সরকার। ফলে মোট আমদানি ব্যায়ের বেশ কিছু অংশ কমে যায়। কিন্তু সার্বিক বিবেচনায় যা মোটেও সন্তোষজনক নয়।আবার আমদানিতে বেশ কড়াকড়ি আরোপ করে সরকার। বিশেষ করে আমদানির জন্য এলসি খুলতে বেশ কঠোর হয় সরকার। ফলে আমদানি করতে গিয়ে বেশ বাধার সম্মুখীন হচ্ছে আমদানীকারকরা। ফলে অনেকে আমদানিতে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়ছেন।
কথা হতে পারেযে, যেহেতু কেউ কেউ আমদানিতে নিরুৎসাহিত হচ্ছে তাহলেতো আমদানি ব্যায় কমার কথা যা আমাদের রিজার্ভ থেকে চাপ কমাবে। কিন্তু পরিস্থিতি ঠিক উল্টো। এলসির ওপর কড়াকড়ি আরোপ করার কারণে অতিপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের জন্য আমদানি এলসি খুলতেও ঝামেলায় পড়ছেন ব্যবসায়ীরা। এর ফলে আমদানি কমেছে। আবার একই ভাবে আমদানি কমে যাওয়ায় রপ্তানিতে ভাটা পড়েছে। কাঁচামালের অভাবে অনেক কলকারখানা উৎপাদনের মাঝে থাকলেও সক্ষমতার চেয়ে কম উৎপাদন করতে হচ্ছে৷ ফলে রপ্তানি আয় নিম্নমুখী হয়েছে। এছাড়া ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধের কারণে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার দেশ গুলো আমদানি কমিয়ে দিয়েছে ও নতুন অর্ডার কমে গেছে। যার ফলে ব্যবসায়ীরা সহসাই রপ্তানি আয় বাড়িয়ে রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে পারছেনা। তাই বাণিজ্য ঘাটতির কারণে যে চাপ রিজার্ভের ওপর রয়েছে তা কমানো সম্ভব হচ্ছেনা।
বাংলাদেশ সরকারের রিজার্ভের আরেকটি উৎস হলো প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। প্রতি বছর বেশ মোটা অঙ্কের টাকা আমাদের প্রবাসী ভাইয়েরা বৈধ কিংবা অবৈধ হুন্ডির মাধ্যমে পাঠায়। বিদায়ী অর্থবছরে বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশীরা প্রায় ১৬ বিলিয়ন ডলার বৈধ পথে বাংলাদেশে পাঠিয়েছে। যদিও হুন্ডির মাধ্যমে আরও বেশি টাকা এসেছে বলে ধারণা করা হয়। মূলত বৈধ ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা পাঠানোর সময় ব্যাংকিংয়ের ঝামেলা না মোকাবিলার জন্য অনেকে হুন্ডির পন্থা বেছে নেন। তবে হুন্ডি ব্যবসায়ীরা হুন্ডির মাধ্যমে টাকা লেনদেনে সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি টাকা প্রদান করে। নিজ পরিবারকে বেশি টাকা পাঠানোর জন্যই অধিকাংশ প্রবাসী হুন্ডির পন্থা বেছে নেন।
হুন্ডি প্রথা বন্ধ করতে সরকার কার্যকর ব্যবস্থা নিতে ব্যার্থ হওয়ার কারণে বৈধ পথে টাকা আসা কমে গিয়েছে। এছাড়াও ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য কমে গেলেও সরকার প্রবাসীদের পাঠানো টাকার জন্য যে মূল্য নির্ধারণ করেছে, হুন্ডি ব্যবসায়ীরা এই মূল্যের চেয়ে ১০-১৫ টাকা বেশি দিচ্ছে। যার কারণে অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে হুন্ডিতে বেশি পরিমাণে টাকা আসছে। অন্যদিকে সরকার হারাচ্ছে রাজস্ব। এছাড়া অক্টোবর মাসে এই বছরের রেকর্ড পরিমাণ কম রেমিট্যান্স এসেছে। যা গত তিন মাস ধরে চলমান। পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দেয়া হলেও হুন্ডি ব্যবসায়ীদের দেয়া অর্থ বেশি হওয়ায় ও ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা পাঠানো কিছুটা কঠিন হওয়ায় প্রবাসী আয় প্রতি মাসে কম হচ্ছেই।
বর্তমানে রিজার্ভ নিয়ে সবচেয়ে আলোচিত আরেকটি বিষয় হলো রিজার্ভের ভবিষ্যৎ কি? এই রিজার্ভ কতদিন চলবে? কিংবা দেশকে ও দেশের অর্থনীতিকে বাঁচাতে সরকার কি কি পদক্ষেপ নিচ্ছে?
আমেরিকান কলামিস্ট ও টেকনোলজিক্যাল কনসালটেন্ট ফরেস্ট কুকসন বাংলাদেশের রিজার্ভের ভবিষ্যৎ নিয়ে বেশ দারুণ একটি গবেষণাধর্মী লেখা প্রকাশ করেন বিদায়ী অর্থবছরের শেষে। সেখানে তিনি বিভিন্ন তথ্য ও উপাত্তকে বিশ্লেষণ করে দেখান ২০২২-২৩ অর্থবছরে সম্ভব্য প্রায় ১৩ বিলিয়ন ডলার শুধু বাণিজ্য ঘাটতি থাকবে। অর্থাৎ চলমান অর্থবছরে আমদানি ব্যায় ও রপ্তানি আয়ের পার্থক্য ও বৈদেশিক ঋণের রিটার্ন সহ সবমিলিয়ে প্রায় ১৩ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করতে হবে। এবং বর্তমান প্রবৃদ্ধি চলমান থাকলে ২০২৩-২৪ অর্থবছরেও সমপরিমাণ অর্থ পরিশোধ করতে হবে।
দেশের বৈদেশিক মুদ্রাবাজার নিয়ে করা এক পর্যবেক্ষণে সরকারি-বেসরকারি খাতের বিদেশী ঋণ নিয়ে একটি পূর্বাভাস দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের দাবি আগামী বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালের শেষনাগাদ বাংলাদেশের বিদেশী ঋণের পরিমাণ ১১৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়াবে। যা ২০২৪ সালের শেষে গিয়ে দাঁড়াবে ১৩০ বিলিয়ন ডলারে।
এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী ২০২১ সালে রিজার্ভ থেকে সর্বমোট ১১ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ পরিশোধ করা হয়েছে এবং চলতি অর্থবছরে শুধুমাত্র ২৩ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার শুধুমাত্র বিদেশি ঋণই পরিশোধ করতে হবে। যার মাঝে ৫ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করবে সরকার, বাকি ১৮ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। যদিও রিজার্ভ থেকেই পুরো টাকা পরিশোধ করতে হবে। অর্থাৎ বর্তমানের ২৭ বিলিয়ন ডলার কতদিন চলবে তা অবশ্যই আর বলে দিতে হবেনা।
রিজার্ভের এই পতন দেশের অর্থনীতিতে খারাপ প্রভাব ফেলবে। রিজার্ভে ডলার না থাকলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য করা অসম্ভব হবে। কিছুদিন আগেই সৌদি আরব সোনালী ব্যাংকের চারটি এলসি বাতিল করেছে। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে ব্যাংক গুলো টাকা শোধ করতে পারবে কিনা এ বিষয়ে সৌদি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানটি সন্দিহান। রিজার্ভের এমন পতন ঠেকানো না গেলে আমরা যেসব দেশ থেকে আমদানি করি তাদের সবাই আমাদের পণ্য দিতে অস্বীকার করবে। কারণ দিনশেষে তারাও ব্যবসা করে। টাকা না পেলে বা টাকা পাওয়ার নিশ্চয়তা না পেলে কোনো দেশই পণ্য রপ্তানি করবেনা।
আমাদের আমদানির বেশির ভাগ পণ্যই আমাদের অতি জরুরি পণ্য ও শিল্পের কাঁচামাল। আমদানি কমে গেলে আমাদের দেশীয় উৎপাদন কমে যাবে। কমে যাবে রপ্তানি। ইতোমধ্যেই এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। রিজার্ভ সংকটের কারণে জ্বালানি তেল ও তরল এলএনজির আমদানি কমে গেছে। এলএনজি আমদানি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে৷ যার ফলে ডিজেল চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র গুলো বর্তমানে আংশিক বা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে দেশে আবারও শুরু হয়েছে ভয়াবহ লোডশেডিং। লোডশেডিং এর কারণে কাঙ্ক্ষিত উৎপাদন করতে পারছেনা কারখানা গুলো। যার কারণে বিদেশি বায়ারদের ঠিক সময়ে পণ্য ডেলিভারি নিয়ে তাঁরা শঙ্কিত।
গ্যাস সংকটের কারণে সার কারখানা গুলো কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য মাত্রায় উৎপাদন করতে পারছেনা। যার সরাসরি প্রভাব পড়বে কৃষি খাতে, কমবে উৎপাদন, বাড়বে পণ্যের মূল্য, বৃদ্ধি পাবে মুদ্রাস্ফীতি। আর এই সমস্যার সূত্রপাত এই রিজার্ভ সংকট থেকে।
একই ধরনের সমস্যায় পড়েছিলো দক্ষিণ এশিয়ার দেশ শ্রীলঙ্কা। রিজার্ভের টাকা তলানিতে ঠেকে যাওয়ায় অতি প্রয়োজনীয় কোনো কিছুই আমদানি করতে পারেনি দেশটি। জ্বালানি সংকটের কারণে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো বন্ধ হয়ে যায়। কাগজ আমদানি করতে না পারার কারণে ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষা পর্যন্ত বন্ধ করে দিতে হয় তাদের। তবুও সংকট সমামধান না হওয়ায় দেশকে দেউলিয়া ঘোষণা করতে বাধ্য হয় শ্রীলঙ্কা সরকার।
এখন দেখার বিষয় বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার কিভাবে এই সংকট মোকাবিলা করে। কিংবা তারা কি আদৌ এই সংকট থেকে বের হয়ে আসতে পারবে? নাকি রিজার্ভ সমস্যার কারণে শ্রীলঙ্কার যে অবস্থা হয়েছিলো সেই একই অবস্থা হবে বাংলাদেশে।
লেখক : মোঃ মেহেদী হাসান রুমী, ফজলুল হক মুসলিম হল ছাত্রদল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।